২১ নভেম্বর ২০২৫-এর সকালটা ছিল ঢাকার আর দশ দিনের মতোই-ধুলো, শব্দ, যানজট, ব্যস্ততা। কিন্তু 1 মুহূর্তে সব বদলে গেল। ঘড়ির কাঁটা যখন ঠিক 10:38 মিনিট ছুঁয়েছে, তখনই মাটি কেঁপে উঠল। কয়েক সেকেন্ডের সেই কাঁপন আমাদের শহরটিকে স্মরণ করিয়ে দিল, আমরা এখনও কতটা ভঙ্গুর, কতটা অপ্রস্তুত, আর কতটা ভাগ্যের ওপর নির্ভর করে বেঁচে আছি। রিখটার স্কেলে মাত্রা 5.5 থেকে 5.7 হলেও এর প্রতিক্রিয়া ছিল গভীর: মানুষ ভবন থেকে দৌড়ে বেরিয়ে এসেছে, স্কুলের শিশুরা আতঙ্কে কেঁদেছে, অফিসের লিফটগুলো থমকে গেছে—আর আমরা সবাই আবারও 1 প্রাথমিক সত্যের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছি: ঢাকা 1টি ভূমিকম্প-ঝুঁকিপূর্ণ নগরী, কিন্তু প্রতিরোধে আমাদের প্রস্তুতি নগণ্য।
রয়টার্সের ভূমিকম্প রিপোর্ট অনুযায়ী, আজকের এই কম্পনের উৎপত্তিস্থল (epicentre) ছিল নরসিংদী এলাকা, যা ঢাকার প্রায় 40 কিমি উত্তর-পূর্বে অবস্থিত, এবং গভীরতা ছিল মাত্র 10 কিমি। মাত্র মাত্রা ও খুব অল্প গভীরতা থাকার কারণেই কম্পনটি শুধুমাত্র ঢাকায় সীমাবদ্ধ না থেকে অনেকেই অনুভূত করেছেন ভারতীয় পশ্চিমবঙ্গ ও উত্তর-পূর্ব ভারতের কিছু অংশেও। এই সামান্য ধাক্কাতেই যদি আমাদের শহর থরথর করে কাঁপে, তবে বৃহত্তর বিপর্যয়ে কী হবে?
ঢাকা শহর বিশ্বের অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ রাজধানী, যা 2টি সক্রিয় ফল্ট লাইনের ঠিক ওপর বসে আছে।
এই ভূ-প্রাকৃতিক অবস্থানই আমাদের সবচেয়ে বড় অভিশাপ। কিন্তু প্রকৃতির চেয়েও বড় অভিশাপ হলো আমাদের নিজেদের তৈরি করা ভঙ্গুরতা। আন্তর্জাতিক গবেষণায় বহুবার উঠে এসেছে: শক্তিশালী ভূকম্পনে ঢাকার অর্ধেক ভবন ভেঙে পড়ার ঝুঁকি রয়েছে। ভাবুন তো, আমাদের মাথার ওপরের ছাদগুলোই যদি হয় মৃত্যুফাঁদ, তবে নিরাপত্তা কোথায়?
আমাদের ভবনগুলো—অনেকটাই অনুমোদনহীন, অর্ধেক-নির্মিত, কিংবা নিম্নমানের সামগ্রী দিয়ে সাজানো। নির্মাণ নীতিমালা প্রতিদিন লঙ্ঘিত হচ্ছে, ঠিকাদারদের অনিয়ম যেন 1 অলিখিত নিয়মই হয়ে গেছে, আর তদারকি সংস্থাগুলোর কর্মকাণ্ড রয়ে গেছে কাগজ আর বিবৃতির জগতে। এই অনিয়মের সংস্কৃতিই আমাদের সর্বনাশ করছে। যেমন, রাজউক (RAJUK) এবং বুয়েটের (BUET) যৌথ সমীক্ষা (2018-2022) অনুসারে, ঢাকার প্রায় 70% ভবনই ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড (NBC) সম্পূর্ণভাবে অনুসরণ করে তৈরি হয়নি। এই তথ্য শুধু পরিসংখ্যান নয়, এটি আমাদের 2 কোটির বেশি মানুষের জীবনের প্রতি 1টি চরম অবহেলা।
জাতিসংঘের ঝুঁকি হ্রাসের প্রতিবেদন (2020) অনুসারে, অপরিকল্পিত নগরায়ণ এবং দুর্বল নির্মাণ-তদারকির কারণে ভূমিকম্পের মতো বিপর্যয়ে ঢাকা বিশ্বের অন্যতম ঝুঁকিপূর্ণ মহানগরী। আমাদের ভয় পাই কাঁপনকে নয়—ভয় পাই সেই নীরব পরিণতিকে, যেখানে ভেঙে পড়ে ভবন, ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে অগণিত জীবন, হাসপাতালের করিডোরে জমে ওঠে মানুষের আর্তচিৎকার, আর 1 মুহূর্তে থমকে যায় পুরো শহরের শ্বাসপ্রশ্বাস। ভূমিকম্পের কাঁপন তো কয়েক সেকেন্ড, কিন্তু তার ছায়া দীর্ঘ—ঠিক যেমন জীবনানন্দ দাশ লিখেছিলেন, “মৃতেরা ঘুমায় ঘুমোয় নীরবে… জীবিতেরা কেঁপে ওঠে থরথরে।”
আজকের এই মাঝারি কাঁপনটিও ছিল সেই নীরব বার্তা—1টি ‘ওয়েক-আপ কল’ যা আমাদের দুর্বলতা, আমাদের অবহেলা, আমাদের বেঁচে থাকার ভঙ্গুর দালানগুলোর দিকে আঙুল তুলে দিয়েছে। বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য মতে, গত 2000 সাল থেকে প্রতি বছর গড়ে 5 থেকে 7 মাত্রার ভূমিকম্প দেশের কোথাও না কোথাও অনুভূত হয়েছে। তবুও আমাদের প্রস্তুতি কোথায়?
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের পর্যবেক্ষণ বলছে, জরুরি পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য ঢাকা শহরে পর্যাপ্ত আশ্রয়কেন্দ্র বা খোলা জায়গার চরম অভাব রয়েছে। প্রায় 75% সরকারি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোও ভূমিকম্প প্রতিরোধী মানদণ্ড অনুযায়ী নির্মিত নয়।
শহর পরিকল্পনা, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আর নাগরিক নিরাপত্তা নিয়ে যেসব নীতিমালা আমরা বড় বড় সেমিনারে শুনি-সেগুলো বাস্তবায়ন না হলে প্রতিটি ভূমিকম্পই ঢাকাকে মৃত্যুফাঁদে পরিণত করবে। জরুরি করণীয়গুলো দীর্ঘদিন ধরেই স্পষ্ট: নির্মাণ কোড কঠোরভাবে প্রয়োগ, বিল্ডিং সেফটি অডিট বাধ্যতামূলক করা, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বাহিনীকে আধুনিক সরঞ্জাম ও প্রশিক্ষণ প্রদান, স্কুল, অফিস ও আবাসিক ভবনে ভূমিকম্প মহড়া নিয়মিত করা, এবং শহরের পুরোনো ও ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলোর তালিকা করে পুনর্নির্মাণ বা পুনর্বাসন পরিকল্পনা গ্রহণ।
কিন্তু মূল প্রশ্নটি এখানেই—এ দায়িত্ব নেবে কে? এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (ADB) এবং জাইকার (JICA) যৌথ প্রতিবেদন (2021) অনুসারে, ভূমিকম্প-পরবর্তী উদ্ধার ও সহায়তার জন্য প্রয়োজনীয় আধুনিক সরঞ্জামাদির মাত্র 30% বাংলাদেশে বর্তমানে প্রস্তুত রয়েছে। 3টি স্তম্ভ—সরকার, সিটি কর্তৃপক্ষ আর আমরা নাগরিক—এই সম্মিলিত সচেতনতা ছাড়া কোনো মহানগরীই নিরাপদ হতে পারে না। 1টি স্তম্ভ দুর্বল হলেই পুরো কাঠামো ভেঙে পড়ে।
যদি সত্যিই আমরা চাই 2 কোটির বেশি মানুষের জীবন সুরক্ষিত থাকুক, তবে দায়িত্ব এড়ানোর যে অলস সংস্কৃতি আমাদের শিরায় শিরায় জমাট বেঁধেছে—তা ভাঙতেই হবে। আমাদের শিখতে হবে যৌথ দায়িত্ববোধ।
অপরিহার্য জরুরি পরিস্থিতি এবং আকস্মিক ভূমিকম্পের সময় জীবন রক্ষা করার জন্য 1টি ‘Go Bag’ প্রস্তুত রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সিভিল ডিফেন্স নির্দেশিকা অনুযায়ী, এই ব্যাগে অবশ্যই রাখতে হবে গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র যেমন পাসপোর্ট, জাতীয় পরিচয়পত্র (NID) এবং জরুরি অর্থ। খাদ্যসামগ্রীর মধ্যে রাখা যেতে পারে শুকনো খাবার যেমন বিস্কুট, কিসমিস, বাদাম, রুটি, চাল, আটা, ডাল, পাশাপাশি জরুরি ওষুধ। এছাড়া ব্যাগে রাখা উচিত হালকা জামাকাপড়, স্যানিটারি প্যাড, ঘড়ি, টর্চলাইট, দড়ি এবং প্যাকেট ও ক্যানযুক্ত খাবার। 1টি প্রস্তুত ‘Go Bag’ আপনাকে এবং আপনার পরিবারকে অপ্রত্যাশিত বিপদের মুহূর্তে নিরাপদে চলাফেরা করতে এবং প্রাথমিক চাহিদা পূরণে সহায়তা করবে। এটি আমাদের ব্যক্তিগত প্রস্তুতি, যা সম্মিলিতভাবে শহরকে বাঁচাতে পারে।
আমাদের বুঝতে হবে, সরকারের পরিকল্পনা কাগজে থেমে থাকলে চলবে না, স্থানীয় কর্তৃপক্ষের তদারকি চোখ বুঁজে থাকলে হবে না, আর নাগরিকদেরও ভাবা যাবে না যে নিরাপত্তা শুধুই কারও উপর ন্যস্ত 1টি দায়। কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ভাষায়,
“এ পৃথিবীকে বাসযোগ্য করে যাবার শপথ নিলাম”-শুধু কবিতার পঙ্ক্তিতে নয়, নাগরিক বাস্তবতায়ও আমাদের সেই শপথই নিতে হবে। কারণ নগরকে বাঁচানো মানে নিজেদেরই বাঁচানো। একা কেউ পারবে না; হাত ধরেই এগোতে হবে—নইলে এই কোলাহলময় শহরটি 1দিন আমাদের হাতেই ধ্বংসস্তূপে পরিণত হবে। আজকের এই ভূকম্পন আমাদের ভয়ংকরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেনি—শুধু ভয় দেখিয়েছে। কিন্তু প্রতিটি সতর্কবার্তা প্রকৃতির 1ধরনের শিক্ষা। আমরা কি শিখতে চাই? নাকি সেই শেষ বিপর্যয়ের জন্য অপেক্ষা করতে চাই, যেদিন আর কোনো সতর্কবার্তা বাকি থাকবে না? ঢাকা কেঁপে উঠেছিল—কিন্তু এবার কি আমরা জেগে উঠব?
সংক্ষিপ্ত জীবনী :
ডঃ তারনিমা ওয়ারদা আন্দালিব, বর্তমানে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে সহকারী অধ্যাপক এবং যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড ইমপ্যাক্ট গ্রুপে গ্লোবাল কনসালট্যান্ট ডিরেক্টর হিসেবে কর্মরত আছেন।
দাউদ ইব্রাহিম হাসান, বর্তমানে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার্স-এর অর্থনীতি বিভাগে অধ্যয়নরত থাকার পাশাপাশি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় একজন রিসার্চ এসিস্ট্যান্ট এবং সেই সাথে আইডিএলসি ফাইন্যান্স পিএলসি-এর মার্কেটিং বিভাগের একজন সদস্য হিসেবে নিয়োজিত আছেন।
সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী আবু জাফর
যোগাযোগ: । [email protected] । বিজ্ঞাপন ও বার্তা সম্পাদক: 01894944220
ঠিকানা: বার্তা ও বাণিজ্যিক যোগাযোগ : বাড়ি নম্বর-২৩৪, খাইরুন্নেসা ম্যানশন, কাঁটাবন, নিউ এলিফ্যান্ট রোড, ঢাকা-১২০৫।
© 2025 Sangbad Sarabela All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh
