রাঙামাটির রাজস্থলী উপজেলার একেবারে দুর্গম এলাকায় চুশাক পাড়া। বিদ্যুৎহীন রাত, ভাঙাচোরা সীমান্ত সড়ক, নেটওয়ার্কহীন এলাকা - সব মিলিয়ে আধুনিক জীবনের সুবিধা যেন এখান থেকে বহু দূরের গল্প। সেই দুর্গম পাড়ার মাচাং ঘর থেকে উঠে এসে আন্তর্জাতিক মঞ্চে আলো ছড়িয়ে এখন দেশের গর্ব হয়ে উঠেছেন মাত্র ১৮ বছরের কিশোরী খই খই সাই মারমা। যে গ্রামে কোন আলো নেই, সেই গ্রামেরই আলো হয়ে উঠেছেন খই খই সাই মারমা। আন্তর্জাতিক টেবিল টেনিস অঙ্গনে তার দ্যুতি আজ শুধু রাঙামাটির নয়, পুরো বাংলাদেশের গর্ব।
চুশাক পাড়া থেকে উপজেলা সদরে পৌঁছাতে এখনও প্রায় দুই ঘণ্টা পাহাড়ি পথ অতিক্রম করতে হয়। বর্ষায় পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ -পাহাড় ধস, বন্যা, কাদা ও ভাঙাচোরা রাস্তায় চলাচল প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। তবুও খই খই প্রতিদিনই সকাল-সকাল কষ্টের এই পথ পেরিয়ে অনুশীলনে যেতেন।
দক্ষিণ এশিয়ার বাইরে আন্তর্জাতিক টেবিল টেনিস প্রতিযোগিতায় পদক জয় করে খই খই প্রমাণ করেছেন - দুর্গমতা কখনো স্বপ্নের পথে বাধা হতে পারে না, যদি থাকে ইচ্ছাশক্তি, পরিশ্রম আর সাহস।
দক্ষিণ এশিয়ার বাইরে আন্তর্জাতিক কোনো প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের হয়ে প্রথমবারের মতো টেবিল টেনিসে রূপা এনে রিয়াদের মঞ্চে ইতিহাস গড়েছেন তিনি। ইসলামিক সলিডারিটি গেমসে জাবেদ আহমেদের সঙ্গে মিশ্র দ্বৈতে রৌপ্যপদক জিতে দেশে ফিরতেই খই খই এখন সারাদেশের ক্রীড়াপ্রেমীদের প্রশংসার কেন্দ্রে।
রাজস্থলী সদর থেকে আরও প্রায় ৩০-৩৫ কিলোমিটার গভীরে চুশাক পাড়া। সীমান্ত সড়কের কিছু অংশ ভেঙে পড়ে থাকায় প্রতিদিনই ঝুঁকি নিয়ে যাতায়াত করতে হয় এলাকাবাসীর। এমন পরিবেশে বড় হওয়া খই খইয়ের সাফল্য তাই আরও বিস্ময়কর।
ছোটবেলায় পরিবারিক অভাবের কারণে দ্বিতীয় শ্রেণিতে মা’র হাত ধরে বান্দরবানের লামায় কোয়ান্টাম কসমো স্কুল অ্যান্ড কলেজে ভর্তি হন তিনি। সেখানেই শুরু হয় তার টেবিল টেনিস খেলা। স্কুলের হলরুমের টেবিল টেনিস বোর্ডেই গড়ে ওঠে খই খইয়ের ভবিষ্যতের ভিত্তি।
খই খইয়ের সাম্প্রতিক সাফল্যগুলোও চমকপ্রদ - জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপে অনূর্ধ্ব ১৯ বিভাগে চ্যাম্পিয়ন, সিনিয়র বিভাগে কোয়ার্টার ফাইনালে, ফেডারেশন কাপে চ্যাম্পিয়ন, টিটি র্যাঙ্কিং প্রতিযোগিতায় অনূর্ধ্ব-১৯ একক ও সিনিয়র এককে দুই শিরোপা, বর্তমানে মেয়েদের জাতীয় র্যাঙ্কিংয়ে ২য় অবস্থান, এমন ধারাবাহিক সাফল্যই তাকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তুলে দিয়েছে।
খই খই যখন রিয়াদ থেকে রূপার পদক নিয়ে ঘরে ফেরেন, তখন চুশাক পাড়া যেন উৎসবে ফেটে পড়ে। বিদ্যুৎহীন মাচাং ঘরে সবাই মোবাইলের আলো জ্বেলে তাকে স্বাগত জানান। মা, বোন, পাড়ার কার্বারি - সবাই আপ্লুত গর্বে।
মা, মোহ্লাচিং মারমা বলেন,“আমরা কখনও স্বপ্নেও ভাবিনি আমাদের মেয়েটা দেশের হয়ে এভাবে খেলে পদক আনবে। কত কষ্ট করে মানুষ করেছি। আজ ওর সাফল্য দেখে মনে হয় -সব কষ্ট সার্থক। সরকার যদি রাস্তাঘাট ঠিক করে, তাহলে আমাদের গ্রামের আরও মেয়েরা বড় কিছু করতে পারবে।”
বড় বোনের হ্লাহ্লাউ মারমা বলেন,“খই খই ছোটবেলা থেকেই পরিশ্রমী। খেলাটার প্রতি ওর ভালোবাসা অসাধারণ। অভাবের মধ্যেও কখনো দমে যায়নি। আমরা চাই ও আরও অনেক দূর যাক। খই খইয়ের মনোবল এত শক্ত ছিল যে কিছুতেই তাকে থামানো যেত না। আজ তার অর্জনে পুরো দেশ ও পরিবার গর্বিত।”
(কার্বারি, ৩২৭ নং মৌজা, গাইন্দ্যা, রাজস্থলী) চুশাক পাড়া কারবারি উনুমং মারমা বলেন - “খই খইয়ের সাফল্য শুধু তার নিজের নয়; এটি পুরো বাংলাদেশ এবং আমাদের রাজস্থলীর গর্ব। এই এলাকা থেকে কেউ আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এমন সাফল্য এনে দেবে - এটা ভাবতেই পারিনি। তবে আমরা চাই সরকার জরুরিভাবে আমাদের রাস্তাটির দিকে নজর দিক। রাস্তা ঠিক হলে আরও অনেক প্রতিভা উঠে আসবে। খই খই এই এলাকার একটি আলোকবর্তিকা।”
স্থানীয় যুবক উথোয়া ইহ্লা মারমা বলেন,“সরকার যদি একটু এই রাস্তাটা করে দিত, খই খইয়ের মতো আরও ছোটরা উঠে আসতে পারত। খই খই আমাদের আশা, আমাদের অনুপ্রেরণা।
খই খই সাইং মারমা বলেন, ‘কোয়ান্টামে ভর্তি হই ২০১৫ সালে। আমাদের আর্থিক অবস্থা ভালো না থাকার কারণেই ছোটবেলায় কোয়ান্টামে পাঠানো হয় আমাকে। ওখানে বাছাই হতো কে কোন খেলায় যাবে। কোচরা আমাকে টিটিতে দেন। প্রথমে মজা করে খেলতাম। পরে খেলাটা ভালো লেগে যায়। খুব গুরুত্ব দিয়ে খেলা শুরু করি ২০১৭-১৮ সালে।’
এরপর আর পেছন ফেরা নয়। নিজেই বলেন, ‘কোয়ান্টাম থেকে হাসান মুনীর সুমন স্যার আমাকে, রেশমীকে, ঐশীকে ও রাম-হিম ভাইকে তিন বছরের জন্য ফেডারেশনে এনে খেলা, থাকা-খাওয়া, এমনকি বিকেএসপিতে ভর্তি করিয়ে পড়াশোনার ব্যবস্থাও করে দেন। এখান থেকেই আমার খেলার উন্নতি শুরু।’
তিনি আরও বলেন “আমি আমার পরিবার, কোয়ান্টাম স্কুল, কোচ, ফেডারেশন, বিকেএসপি, সেনাবাহিনী - সবাইকে ধন্যবাদ জানাই। তাদের সহায়তা ছাড়া এতদূর আসা সম্ভব হতো না। আমার স্বপ্ন - একদিন অলিম্পিকে বাংলাদেশের পতাকা হাতে নিয়ে দাঁড়ানো। আমার যাত্রা সহজ ছিল না। গ্রামের রাস্তাগুলো বর্ষায় ভয়ংকর হয়ে যায়। কতদিন পড়ে গেছি, কতদিন হাঁটতে হাঁটতে পা ব্যথা করেছে। কিন্তু আমি কখনো থামতে চাইনি। দেশের জন্য আরও ভালো ফল আনতে চাই। আমার গ্রামের রাস্তাগুলো ঠিক হলে আমি বিশ্বাস করি - আমার মতো আরও মেয়েরা খেলাধুলায় এগিয়ে আসবে।”
দুর্গম পাহাড়ি গ্রামের মাচাং ঘর থেকে উঠে আসা খই খই আজ সারা দেশের ক্রীড়াঙ্গনে আলোড়ন তুলেছেন। তার সাফল্য শুধু ব্যক্তিগত নয় - দুর্গম অঞ্চলের হাজারো কিশোরীকে সাহস ও অনুপ্রেরণা দিচ্ছে।“অদম্য ইচ্ছা থাকলে ভাঙাচোরা রাস্তা, কাদা কিংবা দারিদ্র্য -কোনো কিছুই পাহাড়ি মেয়ের স্বপ্ন থামাতে পারে না।”
দুর্গম রাজস্থলীর ছোট্ট মেয়েটি আজ বিশ্বমঞ্চে দেশের পতাকা উড়িয়েছে - এটাই নতুন ইতিহাস,পাড়াবাসীর একটাই প্রত্যাশা - “দুর্গম এলাকার খই খই মারমা আরও এগিয়ে যাক, অলিম্পিকে খেলুক, দেশের নাম আরও উজ্জ্বল করুক।”
সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী আবু জাফর
যোগাযোগ: । [email protected] । বিজ্ঞাপন ও বার্তা সম্পাদক: 01894944220
ঠিকানা: বার্তা ও বাণিজ্যিক যোগাযোগ : বাড়ি নম্বর-২৩৪, খাইরুন্নেসা ম্যানশন, কাঁটাবন, নিউ এলিফ্যান্ট রোড, ঢাকা-১২০৫।
© 2025 Sangbad Sarabela All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh
