ইতিহাস আর ঐতিহ্যের চাঁদরে মোড়ানো কবি নজরুল সরকারি কলেজ। হাজার হাজার শিক্ষার্থীর প্রাণকেন্দ্র এই কলেজটি। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত কলেজটির অবকাঠামো, শিক্ষার মানোন্নয়ন ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মুখরিত কলেজটির চারিদিক। ঐতিহ্যবাহী কলেজটি ১৮৭৪ সালে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশের অন্যতম প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী একটি কলেজ। লাল ইটের এই ঐতিহ্যবাহী কলেজটি ১.২ হেক্টর (৩ একর) জায়গা নিয়ে পুরান ঢাকার লক্ষ্মীবাজারে অবস্থিত। কারও কারও কাছে এটা দ্বিতীয় কার্জন হল নামেও পরিচিত। 

হাজী মুহাম্মদ মহসিন ১৮৭৪ সাল থেকে এই প্রতিষ্ঠানটির যাত্রা শুরু করান।  প্রথমে ঢাকা মোহসীনিয়া মাদ্রাসা নামে পরিচালিত হলেও কালের বিবর্তনে অনেক কিছুরই পরিবর্তন ঘটে, পর্যায়ক্রমে ১৯৭২ সালে কবি নজরুল সরকারি কলেজ নামে অধিক পরিচিতি লাভ করে। কলেজটিতে ১৯৯২ সাল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় এর অধীনে হলেও ১৬ই ফেব্রুয়ারি ২০১৭ সাল থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হয় ঐতিহ্যবাহী এই কলেজটি। ১৯৭৯ সালে প্রথমে কলেজটিতে বিজ্ঞান, মানবিক ও ব্যাবসায় শিক্ষা শাখার স্নাতক পর্যায়ের শিক্ষা চালু হয়। 

১৯৮৫ সালে ইসলামিক স্টাডিজ বিষয়ে প্রথম স্নাতক (সম্মান) কোর্স চালু হয়। ১৯৯৩ সালে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে আরবি, ইসলামিক স্টাডিজ ও ব্যবস্থাপনা বিষয়ে প্রথম পর্ব মাস্টার্স কোর্স চালু হয়। এরপর ২০০৪ সালে বাংলা, অর্থনীতি, রসায়ন, গণিত, প্রাণিবিদ্যা, দর্শন, রাষ্ট্রবিজ্ঞান,  ইতিহাস, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি, উদ্ভিদবিদ্যা, ভূগল ও পদার্থবিজ্ঞানসহ মোট ১২ টি বিষয়ে অনার্স কোর্স চালু হয়। এরপরে ২০০৬ সালে বাংলায়  প্রথম পর্ব স্নাতকোত্তর কোর্স চালু হয়। বর্তমানে এখানে মোট ১৯ টি বিষয়ে অনার্স, ৫ টি বিষয়ে প্রথম পর্ব মাস্টার্স এবং ৪ টি বিষয়ে শেষপর্ব মাস্টার্স কোর্স চালু আছে।

ঐতিহ্যবাহী এই কলেজটিতে বর্তমানে বেশ কয়েকটি ক্লাব ও সংগঠন রয়েছে, এই ক্লাব ও সংগঠনগুলো বিভিন্ন অনুষ্ঠান আয়োজন ও কার্যক্রম গ্রহণের মাধ্যমে কলেজের শিক্ষার্থীদের উৎসাহ প্রদানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে যাচ্ছে। আর এই ক্লাব ও সংগঠন গুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-বাংলাদেশ ন্যাশনাল ক্যাডেট কোর (বিএনসিসি), কবি নজরুল সরকারি কলেজ সাংবাদিক সমিতি (কনকসাস), রোভার স্কাউট গ্রুপ, বিতর্ক ক্লাব, বাঁধন ইউনিট কবি নজরুল সরকারি কলেজ শাখা, কবি নজরুল সাংস্কৃতিক সংসদ, কবিয়াল সাহিত্য পরিষদ, জেলা ছাত্রকল্যাণ পরিষদগুলোসহ বিভিন্ন ক্লাব ও সংগঠন।

এই কলেজ থেকে বের হয়েছে অনেক কৃতিত্ববান শিক্ষার্থী এবং বাংলাদেশের অন্যতম প্রখ্যাত ব্যক্তিবর্গ। তাদের মধ্যে রয়েছেন- সাবেক উপরাষ্ট্রপতি ও বিচারপতি নুরুল ইসলাম,  কবি ও সাহিত্যিক কায়কোবাদ,  প্রখ্যাত সাংবাদিক, সাহিত্যিক এবং গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা হারুন হাবীব,  বাংলাদেশ চলচিত্র অভিনেতা ইলিয়াস কাঞ্চন,  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ড.সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন প্রমুখ।

কলেজের বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী মির্জা কাদের বলেন, কবি নজরুল সরকারি কলেজ পুরান ঢাকার প্রাচীনতম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।  ইতিহাস আর ঐতিহ্য কোনো কিছুরই কমতি নেই এই কলেজের।  কলেজের ভিতরে প্রবেশ করলে মনটা এক অদ্ভুত আনন্দে মেতে ওঠে। এই ঐতিহ্যবাহী কলেজটিতে মিশে আছে অনেক ইতিহাস, ঐতিহ্য আর কৃতিত্বের ছোয়া। 

কবি নজরুল সাংস্কৃতিক সংসদ এর সিনিয়র সহ-সভাপতি প্রীতি বিশ্বাস বলেন, কবি নজরুল সরকারি কলেজ বাংলাদেশের প্রাচীনতম শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে একটি। যুগের সাথে তাল মিলিয়ে কলেজটি আজও দাঁড়িয়ে আছে এক অন্যরকম সাজে। এই কলেজের সাথে জড়িয়ে আছে অনেক স্মৃতি। হাজার হাজার শিক্ষার্থীদের এক আবেগের জায়গা কবি নজরুল সরকারি কলেজ। 

কবিয়াল সাহিত্য পরিষদের আহ্বায়ক আবদুন নুর বলেন, ঐতিহ্য কেবল অতীতের গল্প নয়; এটি এক জীবন্ত শক্তি, যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মকে পথ দেখায়। কবি নজরুল সরকারি কলেজ সেই ঐতিহ্যের দীপ্ত উদাহরণ। ইতিহাস, সংস্কৃতি ও শিক্ষার যে মশাল এ প্রতিষ্ঠান বহন করে চলছে তা আমাদেরকে আজও আলো দেয়, দিশা দেয় ও অনুপ্রেরণা যোগায়। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে শিক্ষার মানোন্নয়নে এ কলেজের নাম যেমন বদলেছে, তেমনি বদলেছে এর দায়িত্ব ও স্বপ্নের পরিমাণ। নতুন ভবন, আধুনিক কক্ষ, প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষাব্যবস্থা, সবই যুক্ত হচ্ছে উন্নয়নের পথে। পাশাপাশি কলেজটি তার পুরনো গৌরব, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও মানবিক মূল্যবোধকে আগলে রেখেছে আপন মর্যাদায়। ঐতিহ্যের চাঁদরে মোড়ানো আমাদের এই প্রিয় শিক্ষালয়কে আরও এগিয়ে নিতে, নতুন স্বপ্নে সাজাতে এবং আধুনিক জ্ঞানে সমৃদ্ধ করতে আমরা সবাই একসঙ্গে কাজ করব, এ আমার প্রত্যাশা।