মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জে কুরমা, আদমপুর ও কামারছড়া এলাকার ২০ হাজার ২৭০ একর এলাকা নিয়ে রাজকান্দি হিল রিজার্ভ ফরেস্ট। এই রেঞ্জে গাছ, বাঁশ, পাহাড়, টিলা, খাসিয়া ও স্থানীয় ভিলেজারদের বসতি রয়েছে। সম্রতি আদমপুর রেঞ্জের সাঙ্গাইসাফী এলাকায় নিরীহ এক ভিলেজারের কাঁচা ঘর উচ্ছেদ করেছে। অপরদিকে কুরমা বন বিটের সংরক্ষিত জায়গায় কৌশলে টিলা ও গাছ কেটে সমঝোতায় টিলার পাদদেশে গড়ে উঠেছে প্রায় ঝুঁকিপূর্ন অবস্থানে শতাধিক পাকা স্থাপনা। ফলে বন বিভাগের এই দুই মূখি কার্যক্রম নিয়ে জনমনে নানা প্রশ্ন উঠেছে। ফলে বনের স্বাভাবিক প্রাকৃতিক পরিবেশ বিনষ্ট সহ জীববৈচিত্রের ওপর বিরুপ প্রভাব পড়ছে। স্থানীয়দের অভিযোগে এসব চিত্র বেরিয়ে এসেছে। এ ধরনের কার্যক্রমে বনভূমি ধ্বংস,জীববৈচিত্র্য বিনষ্ট ও পরিবেশগত সমস্যার সৃষ্টি হবে।
জানা যায়, ২০ হাজার ২৭০ একর এলাকা নিয়ে রাজকান্দি হিল রিজার্ভ ফরেস্ট। আদমপুর, কুরমা ও কামারছড়া বনবিটের আওতাধীন এই বন। এলাকাটি আদমপুর-কালেঞ্জি, কামারছড়া ও কুরমাসহ বিস্তীর্ণ এলাকা নিয়ে বিশাল প্রাকৃতিক বনভূমি। বলা হয়ে থাকে ‘ইন্দো-বার্মা’ প্রাণবৈচিত্র্য সমৃদ্ধ অঞ্চল-এর অংশ। ২০১৮ সালে ‘বাংলাদেশ জার্নাল অব প্লান্ট ট্যাক্সোনমি’তে প্রকাশিত গবেষণায় বলা হয়, বনটিতে ১২৩টি উদ্ভিদ পরিবারের প্রায় ৫৪৯ প্রজাতির সপুষ্পক উদ্ভিদ শনাক্ত হয়েছে। প্রায় ১২ প্রজাতির বটগাছ এবং ১০ প্রজাতির কাষ্ঠল লতার বৈচিত্র্য খুব কম বনেই আছে।
স্থানীয় ভিলেজার ও বন সংলগ্ন বাসিন্দারা জানান, রাজকান্দি বনরেঞ্জটি এক সময় গাছ ও বাঁশে ঘন অন্ধকারাচ্ছন্ন বন ছিল। বর্তমানে বনের সে চিত্র আর নেই। বনবিভাগের কতিপয় কর্মকর্তা, কর্মচারীদের নানা কার্যক্রমের ফলে বন ধ্বংস হচ্ছে। বন বিভাগের ভিলেজার হিসাবে বাঙালি ও খাসিয়ারা বসবাস করেন। কতিপয় বন কর্মকর্তার সাথে সমঝোতার মাধ্যমে বনের মধ্যে ইটের স্থাপনা তৈরি নিষিদ্ধ থাকলেও বাঙ্গালী ও খাসিয়া সম্প্রদায়ের কতিপয় বন ভিলেজার বনের ভিতরে কৌশলে গাছ ও টিল কেটে টিলার পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণ ভাবে ইটের তৈরী পাকা বসতঘর তৈরী করেছেন।
এতে স্থানীয় বন বিভাগ কোন আপত্তি করছেন না। অথচ চাহিত সুবিধা না দেওয়ায় গত ২৫ এপ্রিল রেঞ্জের প্রশিক্ষণরত সহকারী বন কর্মকর্তা ও রাজকান্দি রেঞ্জ কর্মকর্তা প্রীতম বড়ুয়ার নেতৃতে কামারছড়া বনবিটের অধীন আদমপুর ইউনিয়নের সাঙ্গাইসাফী এলাকায় নিরীহ এক ভিলেজারের কাঁচা ঘর ও মৃত আরজান মিয়ার স্ত্রী মরিয়ম বিবির বাঁশের টিনসেড ঘরটি ভেঙ্গে উচ্ছেদ করা হয়েছে। ফলে নিরীহ ওই মহিলা আর্থিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন এবং তার মাথা গোজার ঠাঁই টুকুও হারিয়েছেন। অথচ এই মহিলা বনবিভাগকে অবহিত করে ঘর তৈরি করেছিলেন।
অনুসন্ধানে তথ্যসূত্রে জানা যায়, রাজকান্দি বনরেঞ্জের আদমপুর ইউনিয়নের কালেঞ্জি গ্রামে প্রায় শতাধিক ভিলেজার পরিবার বসবাস করছেন। বন বিভাগের অনুমতি সাপেক্ষে তারা দীর্ঘদিন ধরে কাঁচা ঘরবাড়ি তৈরি করে বনের এই গ্রামে বসবাস করে আসছেন। সেখানেই গত কয়েক বছরে রাস্তার পাশেই কয়েকটি পাকা বাড়ি নির্মিত হয়েছে। বন বিভাগের লোকজনের সম্মুখেই এসব ঘর তৈরি হয়েছে। কালেঞ্জি গ্রামের খালিক মিয়ার পুত্র নুরনবী, আব্দুল নবী, পার্শ্ববর্তী বাড়ির মহেব উল্ল্যাসহ পাশাপাশি তিনটি বাড়িতে পাকা ঘর নির্মাণ করেছেন। তাদের ঘর নির্মাণে বন বিভাগের তরফে কোনো বাঁধা দেওয়া হয়নি। ঘর নির্মাণের বিষয়টি জানার জন্য এসব বাড়িতে গিয়েও তাদের পাওয়া যায়নি।
অপরদিকে, কুরমা পুঞ্জিতে বন বিভাগের জমিতে খাসিয়া সম্প্রদায়ের প্রায় ৫০/৬০টি পরিবার কাঁচা ঘর তৈরী করে বসবাস করে আসছেন দীর্ঘ দিনধরে। সেখানে বসবাসের পাশাপাশি তারা বনে পান (খাসিয়া) চাষাবাদ করে জীবিকা নির্বাহ করে আসছে। তবে বিগত ২০২৪ ইং থেকে বন বিভাগের কতিপয় অসাধু কর্মকর্তাদের সাথে সমঝোতার মাধ্যমে কৌশলে বনের গাছ ও টিলা কর্তন করে টিলার পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে পাকা দালান কোটা নির্মান করছেন। টিলার পাদদেশে তৈরী দালান গুলোতে যে কোন মুহুর্তে টিলা ধবসে পড়ে ঘটতে পারে অনাঙ্খাকিত ঘটনাও।
সম্প্রতি কুরমা বন বিটের খাসিয়া পুঞ্জিতে গিয়ে দেখা যায়, বনের টিলা ও গাছ কেটে পুঞ্জির পরর্মি, বারেক, বিউটি পাকা দালান কোটা নির্মাণ কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন।
অনুসন্ধানে আরো জানা গেছে, ইতিমধ্যে বনের বাঁকে বাঁকে বনের জমিতে কৌশলে টিলা ও গাছ কর্তন করে প্রায় ১৫/২০টি পাকা ঘর নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করেছে।
কুরমা পান পুঞ্জির মন্ত্রী জামিনীর সাথে বনের ভিতর গাছ কেটে টিলার পাদদেশে পাকা ঘর তৈরী করার ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন।
কুরমা বন বিট কর্মকর্তা মো. জুয়েল রানা বলেন, ‘আমি কিছু দিন হয়েছে এখানে এসেছি। এসেই দেখতে পাই এখানে খাসিয়ারা টিলা ও গাছ কেটে পাকা দালান ঘর তৈরী করছেন। পুঞ্জির মন্ত্রীর কিভাবে ঘর তৈরি করছেন জানতে চাইলে কোন সদুত্তর দেননি। তাই পুঞ্জিতে টিলা ও গাছ কেটে পাকা ঘর নির্মান না করার জন্য মৌখিক ভাবে পুঞ্জির মন্ত্রীকে অনুরোধ করেছি এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অবহিত করেছি।’
রাজকান্দি বন রেঞ্জ কর্মকর্তা মো. মামুনুর রশীদ বলেন,‘ সংরক্ষিত বনের মধ্যে পাকা ঘর স্থাপনের কোনো অনুমতি নেই। আমি অল্প কিছু দিন হয়েছে এখানে এসেছি। এখনো সবকিছু ভালো ভাবে দেখা হয়নি। তবে আপনাদের মাধ্যমে জানতে পেরে তদন্ত করে সত্যতা পেয়েছি। কিভাবে পূর্ববর্তী কর্মকর্তাদের সময় ঘর নির্মান কাজ শুরু করেছে বলতে পারিনা। পুঞ্জির মন্ত্রীকে কাজ বন্ধ রাখার জন্য মৌখিক ভাবে অনুরোধ জানিয়েছি।