ছবি: সংবাদ সারাবেলা।
মহান স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন সময়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসরদের হাতে শহীদ হওয়া বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে নারায়ণগঞ্জের পাঁচজন রয়েছেন। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা না হলেও প্রনীত প্রাথমিক তালিকায় পাঁচশ ৬১ জনের মধ্যে নারায়ণগঞ্জের পাঁচজন রয়েছেন। অথচ জেলায় বুদ্ধিজীবী ডা: মোহাম্মদ আবদুল জব্বার, এ এফ জিয়াউর রহমান,ডা: হাসিময় হাজরা,ডা:লেফটেন্যান্ট মোহাম্মদ আমিনুল হক ও মতিলাল ঘোষকে ৫৫ বছরের মধ্যে ৫৫ সেকেন্ডও স্মরণ করা হয়নি।
রমনার রেসকোর্স ময়দানে ১৯৭১ সালের ৭ মার্চে শেখ মুজিবুর রহমান "এবারের সংগ্রাম - স্বাধীনতার সংগ্রাম" বলেছিলেন। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ২৫ মার্চ কালো রাতে হায়েনার মতো বাংলাদেশের মানুষের উপর হত্যাযজ্ঞ শুরু করে। চট্রগ্রামে ২৬ মার্চ আব্দুল আজিজ এবং মেজর জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষনা দেন।পাকিস্তানী বর্বর বাহিনীর বিরুদ্ধে বাংলাদেশের সেনা বিমান নৌ এবং পুলিশ বাহিনী ও আপামর জনতা মুক্তিযুদ্ধ শুরু করেন। পাকিস্তানী বাহিনী মুক্তিযুদ্ধে দুই লাখ মা- বোনের ইজ্জত লুন্ঠন করে।পাক হানাদার বাহিনী নয় মাসে আনুমানিক ৩০ লাখ মানুষকে শহীদ করে।হানাদার বাহিনী ১৬ ডিসেম্বর আত্মসমর্পণ করে। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়।মার্চ থেকে ডিসেম্বরে সারা দেশে হানাদর বাহিনী শিক্ষক,সাংবাদিক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, চলচ্চিত্রকারসহ বুদ্ধিজীবীদের হত্যা,লাশ গুম করে।সারা দেশের মতো নারায়ণগঞ্জের বুদ্ধিজীবীদেরও হত্যা করা হয়।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকা প্রণয়নে ২০২০ সালে একটি জাতীয় কমিটি গঠন করে। তালিকা যাচাই-বাছাইয়ের জন্য একটি উপ-কমিটি করা হয়। মন্ত্রনালয় ওই কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে চার বছরে পাঁচশ ৬১ জন বুদ্ধিজীবীর নাম তালিকাভুক্ত করে। মন্ত্রণালয় চারটি গেজেট পাঁচশ ৬১ জনের নাম প্রকাশ করে।সেখানে নারায়ণগঞ্জের বুদ্ধিজীবী ডা: হাসিময় হাজরা, ডা: মোহাম্মদ আবদুল জব্বার, এ এফ জীয়াউর রহমান, ডা: লেফটেন্যান্ট মোহাম্মদ আমিনুল হক ও মতিলাল ঘোষের নাম অন্তর্ভূক্ত করা হয়। মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ৫৫ বছর আগে দেশ স্বাধীন হয়। নারায়ণগঞ্জ জেলায় প্রতি বছর ২৬ মার্চ মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা দিবস,১৪ ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবি দিবস, ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস উদযাপন হয়।অনুষ্ঠানে বিভিন্ন বুদ্ধিজীবী, শহীদ ও আহত মুক্তিযোদ্ধাকে স্মরন করা হয়।কিন্তু ৫৫ বছরের মধ্যে ৫৫ সেকেন্ডও জেলার ওই পাঁচজন বুদ্ধিজীবিকে নামোল্লেখ করে স্মরণ করা হয়নি।জেলাবাসীকে ওই পাঁচজন সম্পর্কে জানতেই দেয়া হয় নি।
ডা. মোহাম্মদ আবদুল জব্বার
ডা. মোহাম্মদ আবদুল জব্বার ১৯৩০ সালে (১৩৩৬ বঙ্গাব্দ, আনুমানিক) নারায়ণগঞ্জ জেলার ফতুল্লা থানার কাশীপুর গ্রামের সরদার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা আহমেদ আলী সরদার এবং মাতা আঞ্জুমান আরা বেগম। তিনি ছিলেন এক ভাই ও এক বোনের মধ্যে বড়। ছোটবেলা থেকেই তিনি ছিলেন ধর্মপ্রাণ, মানবিক ও সেবামূলক কর্মকাণ্ডে উৎসাহী। ১৯৫০ সালের ৭ মে তিনি হালিমা খাতুনের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তাঁদের আটজন সন্তান রয়েছে, যাদের মধ্যে তিনজন পুত্র এবং পাঁচজন কন্যা।
ডা. মোহাম্মদ আবদুল জব্বার তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করে নারায়ণগঞ্জ হাই স্কুল থেকে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাস করেন।তিনি ঢাকা কলেজ থেকে আইএসসি পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস ডিগ্রি অর্জন করেন এবং ১৯৬৪ সালে আমেরিকান ইউনিভার্সিটি অব বেইরুট থেকে পাবলিক হেলথে ডিপ্লোমা লাভ করেন।
ডা. জব্বার ১৯৫৮ সালে জামালপুরে মহকুমা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা হিসেবে তাঁর পেশাগত জীবন শুরু করেন। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় ডা. জব্বার দিনাজপুর সদর হাসপাতালে সহকারী সিভিল সার্জন হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। যুদ্ধের প্রথম দিক থেকেই তিনি আহত মুক্তিযোদ্ধা, ইপিআর সদস্য এবং অন্যান্য রোগীদের চিকিৎসাসেবা দিতে অগ্রগামী ছিলেন। ১৩ এপ্রিল পাক হানাদার বাহিনী দিনাজপুর দখল করলে তিনি হাসপাতাল ছেড়ে যেতে অস্বীকৃতি জানান। ২৯ এপ্রিল সন্ধ্যায় বাসা থেকে তাঁকে চিকিৎসার নাম করে হাসপাতালে ডেকে নিয়ে হত্যা করা হয়।
দেশ স্বাধীন হবার পর দিনাজপুর সদর হাসপাতালের পাশের মাটি খুঁড়ে ডা. জব্বারের দেহাবশেষ উদ্ধার করা হয়। তাঁর মরদেহ দিনাজপুরের চেহেলগাজী মাজার সংলগ্ন গোরস্থানে ধর্মীয় মর্যাদায় সমাহিত করা হয়।
এ এফ জিয়াউর রহমান
এ এফ জিয়াউর রহমান ১৯২৬ সালের ২ ফেব্রুয়ারি নারায়ণগঞ্জ জেলার আড়াইহাজার উপজেলার নওগাঁ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মোসলেহউদ্দিন ভূঁইয়া ব্রিটিশ আমলে ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন। শৈশবেই পিতৃহারা হন তিনি। তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু হয় গ্রামের স্কুলে। স্থানীয় স্কুল ও কলেজ থেকে তিনি ম্যাট্রিকুলেশন ও ইন্টারমিডিয়েট উভয় পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস ডিগ্রি অর্জনের পর ১৯৪৯ সালে তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মেডিকেল কোরে যোগদান করেন। কর্মদক্ষতার কারণে ১৯৬৩ সালে তিনি লেফটেন্যান্ট কর্নেল পদে পদোন্নতি পান। তিনি ১৯৬৮ সালে সিলেট মেডিকেল কলেজে অধ্যক্ষ ও সুপারিনটেনডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
১৯৭১ সালের ১৫ মার্চ মুক্তিযুদ্ধের সময় সিলেটে অবস্থানরত পাকিস্তানি সেনারা তাঁকে গৃহবন্দি করে রাখে। তিনি খাদ্যাভাব এবং জীবনহুমকির মধ্যেও অটল থাকেন এবং পাকিস্তানিদের অনুরোধে ইসলামাবাদে কাজ করতে রাজি হননি।১৪ এপ্রিল সকালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একজন লেফটেন্যান্ট তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদের নামে নিয়ে যায়। তিনি স্ত্রী ও সন্তানদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে যান। এরপর তাঁর আর কোনো সন্ধান মেলেনি। পরে জানা যায়, পাকিস্তানি সেনারা তাঁকে হত্যা করে এবং তাঁর মরদেহ লুকিয়ে ফেলে।
জিয়াউর রহমানের স্ত্রী ফেরদৌসী চৌধুরী এবং তাঁদের দুই ছেলে শাদ বিন জিয়া ও খালেদ বিন জিয়া এবং এক মেয়ে শাহরীন রহমান। গ্রামের প্রতি তাঁর অগাধ ভালোবাসা ছিল। কর্মজীবনের ব্যস্ততার মাঝেও তিনি নিজ গ্রামে সময় কাটাতে পছন্দ করতেন।
ডা. হাসিময় হাজরা
ডা. হাসিময় হাজরা ১৯৪৬ সালের ২৩ জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা ডা. অনন্ত মাধব হাজরা ছিলেন ঢাকেশ্বরী কটন মিলের চিকিৎসক। পরিবারে বিপ্লবের ঐতিহ্য ছিল; তাঁর চাচা অমৃত লাল হাজরা ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার অপরাধে দ্বীপান্তরের শাস্তি ভোগ করেন। হাসিময় হাজরা ১৯৬২ সালে ঢাকেশ্বরী মিল স্কুল থেকে এসএসসি, ১৯৬৪ সালে নারায়ণগঞ্জের তোলারাম কলেজ থেকে আইএসসি সম্পন্ন করেন। তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে ১৯৭০ সালে এমবিবিএস ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি শুধু মেধাবী ছাত্রই ছিলেন না।বরং ফুটবল ও হকিতে দক্ষতা অর্জন করেছিলেন।
হাসিময়ের পরিবার ঢাকায় বাস করলেও ১৯৬৪ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পর তাঁর মা ও ভাইবোনেরা ভারতে চলে যান। তবে হাসিময় ও তাঁর বাবা ঢাকায় থেকে যান।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে অনেকে তাঁকে পার্শবর্তী দেশ ভারত চলে যাবার জন্য পরামর্শ দেন। কিন্তু তিনি ঢাকায় থেকে গিয়ে গোপনে মুক্তিযুদ্ধে জড়িত হন।তিনি সদা আহতদের চিকিৎসাসেবা দিতে তৎপর ছিলেন।
১৯৭১ সালের ২ মে দুপুরে তিনি ইন্টারন্যাশনাল হোস্টেলের উদ্দেশে রওনা দেন। এরপর থেকে তিনি নিখোঁজ হন। অনেক অনুসন্ধানের পর জানা যায়, পাকিস্তানি সেনারা রহমত বক্সার নামে এক অবাঙালির নেতৃত্বে তাঁকে পিজি হাসপাতালের সামনে থেকে ধরে নিয়ে যায় এবং হত্যা করে। তাঁর মরদেহ টুকরো টুকরো করে অজ্ঞাত স্থানে ফেলে দেয়।
ডা. লেফটেন্যান্ট মোহাম্মদ আমিনুল হক ও মতিলাল ঘোঘ
ডা. লেফটেন্যান্ট মোহাম্মদ আমিনুল হক সেনাবাহিনীতে চিকিৎসক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। এ শহীদ বুদ্ধিজীবী নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা থানার ধর্মগঞ্জ এলাকার বাসিন্দা ছিলেন। তার পিতা মো. আলী মাষ্টার ও মায়ের নাম আছিয়া খাতুন।
শহীদ বুদ্ধিজীবী মতিলাল ঘোষ
একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। তার বাড়ি নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার থানার ঝাউগড়া গ্রামে। তার পিতা জয় চন্দ্র ঘোষ এবং মাতা মনোনোহিনী ঘোষ।
শহীদ বুদ্ধিজীবী ডা. লেফটেন্যান্ট মোহাম্মদ আমিনুল হক ও মতিলাল ঘোষ সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যায়নি।
সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী আবু জাফর
যোগাযোগ: । [email protected] । বিজ্ঞাপন ও বার্তা সম্পাদক: 01894944220
ঠিকানা: বার্তা ও বাণিজ্যিক যোগাযোগ : বাড়ি নম্বর-২৩৪, খাইরুন্নেসা ম্যানশন, কাঁটাবন, নিউ এলিফ্যান্ট রোড, ঢাকা-১২০৫।
© 2025 Sangbad Sarabela All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh
