× প্রচ্ছদ বাংলাদেশ বিশ্ব রাজনীতি খেলা বিনোদন বাণিজ্য লাইফ স্টাইল ভিডিও সকল বিভাগ
ছবি ভিডিও লাইভ লেখক আর্কাইভ

শহিদ হাদী আমাদেরকে কি বুঝিয়ে গেল?

ডঃ তারনিমা ওয়ারদা আন্দালিব, এবং দাউদ ইব্রাহিম হাসান

১৯ ডিসেম্বর ২০২৫, ২১:৪৮ পিএম

ছবি: সংবাদ সারাবেলা।

"ইনকিলাব জিন্দাবাদ, বাংলাদেশ জিন্দাবাদ!"-এই বজ্রনিনাদে যে অমর কাব্যের সূচনা হয়েছিল, আজ ১৮ই ডিসেম্বরের বিষাদময় দুপুরে সিঙ্গাপুরের তপ্ত আকাশে তা এক মহাকাব্যিক হাহাকারে পরিণত হয়েছে। সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালের সেই নিবিড় পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের দীর্ঘ নীরবতা যখন ঘোষণা করল ওসমান হাদীর চিরপ্রস্থানের খবর, তখন কেবল একটি হৃদস্পন্দন থামেনি, বরং থমকে গেছে চব্বিশের বিপ্লব পরবর্তী এক অবিনাশী নক্ষত্রের পথচলা। শরীফ ওসমান হাদী—যিনি কেবল একটি নাম ছিলেন না, ছিলেন আমাদের জাতীয় বিবেকের এক জাগ্রত প্রহরী। ওসমানের সেই নিস্পন্দ চোখের পাতা আজ আমাদের দিকে তাকিয়ে যেন এক বিষাদময় প্রশ্ন ছুঁড়ে দিচ্ছে—আমরা কি তবে যোগ্য ছিলাম না তার এই অসীম ত্যাগের?

ওসমানের লড়াইটা ছিল শেকড় থেকে শিখরে পৌঁছানোর। তিনি তার ঐতিহাসিক বক্তব্যে অত্যন্ত তীক্ষ্ণভাবে আক্রমণ করেছিলেন সেইসব ছদ্মবেশী আওয়ামী সমর্থকদের, যারা সুবিধাজনক অবস্থানে থেকে এতদিন ভণ্ডামির রাজনীতি করেছে। তিনি বলেছিলেন, "আওয়ামী লীগগুলো ততক্ষণ ভালো, যতক্ষণ পর্যন্ত সুবিধাজনক অবস্থানে থাকে!" তিনি আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিলেন সেইসব ‘গিলে করা পাঞ্জাবি’ পরা তথাকথিত বুদ্ধিজীবীদের, যারা রবীন্দ্রনাথ আর শান্তিনিকেতনি ভাষার আড়ালে গণহত্যাকে আড়াল করত। ওসমানের কণ্ঠে ঝরে পড়েছিল ঘৃণা: "অশুদ্ধ-অশ্লীল বলা যাবে না—এই ভাব নিয়ে আসাদুজ্জামান নূররা শুধু গণহত্যাই করেনি, যারা প্রতিবাদ করেছে তাদের গুম-খুন করেছে!" তার এই পর্যবেক্ষণ আমাদের নির্দেশ করে যে, ছায়ানট বা উদীচীর মতো প্রতিষ্ঠানগুলো কীভাবে ফ্যাসিবাদের প্রোডাক্ট হিসেবে কাজ করেছে। আমাদের করণীয় হলো, এই সাংস্কৃতিক দাসত্ব ভেঙে নিজস্ব পরিচয় গড়ে তোলা।

ওসমানের বক্তব্যে উঠে এসেছে এক চরম সত্যের কথা-"আওয়ামী লীগ যে কী পরিমাণ স্টুপিড হতে পারে, তা ৫৪ বছর বয়সের অভিনেতা যখন উপদেষ্টার ছবি পিছনে রেখে অকথ্য ভাষায় কথা বলে তখনই বোঝা যায়!" তিনি বলেছিলেন, এই তাত্ত্বিকরা আমাদের অর্ধেক বোঝাত আর অর্ধেক বোঝাত না; সেই ‘আলো-আঁধারি’ ভাষায় তারা আসলে আমাদের টুঙ্গিপাড়ার কলোনি বানিয়ে রেখেছিল। তাই ওসমানের অমর স্লোগান ছিল: "কলকাতা এবং টুঙ্গিপাড়ার কলোনিয়ালিজম ভেঙে ঢাকার বাংলাদেশ গড়ে তুলতে হবে!" এবং "বাংলা মানেই এখন আর কলকাতা না, বাংলা মানেই বাংলাদেশ!" এই উক্তিটি আমাদের দীর্ঘ মনস্তাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিক লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুতি নিতে ইঙ্গিত দেয়।

তিনি প্রতিটি ক্যাম্পাসে গণপ্রতিরোধের ডাক দিয়েছিলেন। তার কণ্ঠস্বর ছিল অকুতোভয়: "প্রত্যেকটা অপরাধীর ছবি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে প্রতিটি ক্যাম্পাসে টাঙিয়ে দাও!" তিনি সতর্ক করেছিলেন যেন কোনো নির্দোষের ছবি সেখানে না আসে। তিনি যখন ন্যারেটিভ বিল্ডিংয়ের কথা বলতেন, তখন পিনাকী ভট্টাচার্য ও তার নিজের কথা উদাহরণ হিসেবে টেনে বলতেন, "উগ্রপন্থী কারা? যারা পিনাকী এবং হাদীর কথা শুনতে বলে?" এটি ছিল এক চরম বিদ্রূপ। তিনি আমাদের শিখিয়ে গেছেন ভালোবাসার সংজ্ঞা— "আমার মার চেয়ে শাশুড়ি বেশি যত্ন করলে আমি সন্দেহের চোখে দেখি!" তার এই রসবোধপূর্ণ উক্তিটি আসলে আমাদের শেখায় যে, যারা হুট করে বিপ্লবের বন্ধু সাজছে, তাদের বিশ্বাস করার আগে যেন আমরা সাবধান হই। তিনি আমাদের স্পষ্ট নির্দেশ দিয়েছিলেন: "দোয়া করার লোক অনেক আছে, আমাদের লড়াই চালাতে স্বচ্ছতার সাথে পয়সা-পাতি দিন!"

জুলাই বিপ্লবের শহীদদের প্রতি তার ছিল এক গভীর দায়বদ্ধতা। তিনি আক্ষেপ করে বলেছিলেন, "জাতিসংঘ বলছে ১৪০০ শহীদ, আর প্রধান উপদেষ্টা বলছেন ১০০০—এই কন্ট্রাডিকশন হতে দেওয়া যাবে না!" তার দাবি ছিল অত্যন্ত জোরালো: "রায়েরবাজারের গণকবরে এখনো এক থেকে দেড় শতাধিক লাশ পড়ে আছে, ডিএনএ টেস্ট করে জাতিকে জানাও তারা কারা!" ওসমানের স্লোগান ছিল: "মুক্তিযোদ্ধার শহীদ সংখ্যা নিয়ে বছরের পর বছর ধরে চলা রাজনীতি আল্লাহর ওয়াস্তে বন্ধ করুন!" তিনি চেয়েছিলেন আন্তর্জাতিক তদন্ত এবং প্রতিটি শহীদের জন্য একটি ডিজিটাল আর্কাইভ। তার এই নির্দেশনা আমাদের বাধ্য করে একটি নিরাপদ ও স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশ গড়ার শপথ নিতে।

১২ই ডিসেম্বর ২০২৫, বিজয়নগরের রাজপথে যখন ঘাতকের বুলেট তার মস্তিষ্ক বিদীর্ণ করে দিল, তখন তিনি যেন তার নিজেরই জীবন দিয়ে প্রমাণ করে গেলেন— "শহীদের রক্তের ঋণ মিটানোর দায় আমাদেরই নিতে হবে, এটা সরকার করে দিবে না!" তিনি আক্ষেপ করতেন যে, এই সরকারের উপদেষ্টারা কেউ জীবন দেয়নি, শহীদ আপনার ভাই আর আমার ভাই। তাই আমাদেরই দায়িত্ব নিতে হবে। তিনি বুটেক্সের ছাত্রদের বলেছিলেন, "এই প্রোফাইলিং শুধু হার্ড কপিতে না রেখে অনলাইনে বিশ্ব দরবারে ছড়িয়ে দাও!" এবং প্রশ্ন তুলতে বলেছিলেন, "যখন স্টুডেন্টদের দুই পা তোলা যাচ্ছিল না, রক্তে ভেসে যাচ্ছিল, তখন এই বিনম্র শ্রদ্ধাকারীরা কোথায় ছিল?"

সিঙ্গাপুরের হাসপাতালে তাকে দেওয়া ১১৫ ব্যাগ রক্ত প্রমাণ করে বাংলার মানুষ তাকে কতটা ধারণ করেছিল। গুগল ট্রেন্ডস বলছে, গত ২৪ ঘণ্টায় ওসমানের শাহাদাত নিয়ে অনুসন্ধান ২৫০% বেড়েছে। ১৮ই ডিসেম্বর এখন থেকে আর ক্যালেন্ডারের সাধারণ কোনো তারিখ নয়, এটি ওসমানের সাহসিকতা আর ঘাতকের পরাজয়ের এক মহান স্মারক। ওসমানের সেই হাসিমুখ আর অন্যায়ের বিরুদ্ধে সেই তীক্ষ্ণ কণ্ঠস্বর আমাদের ধমনীতে সবসময় সাহস জোগাবে। তিনি আমাদের শিখিয়ে গেছেন: "জুলাইকে শুধু বাঁচিয়ে রাখলে হবে না, জুলাইকে মাথা উঁচু করে বাঁচিয়ে রাখতে হবে!"

হে মৃত্যুঞ্জয়ী ওসমান, তুমি ঘুমাও শান্তিতে। তোমার রক্তমাখা শার্ট আজ আমাদের নতুন মুক্তির পতাকা। তুমি বলেছিলে, বিপ্লব কোনো একক ব্যক্তির নয়, এটি একটি জাতির আজাদি। আমরা তোমার সেই বিশ্বাসের মর্যাদা রাখবই। তোমার রেখে যাওয়া প্রতিটি স্লোগান আজ আমাদের বাঁচার মন্ত্র। ওসমানের রক্ত কি তবে পাল্টে দেবে বাংলাদেশ? হ্যাঁ, ওসমানের সেই রক্তভেজা রাজপথ আর তার প্রতিটি উক্তিই হবে আগামীর ইনসাফ কায়েম করা বাংলাদেশের প্রধান ইশতেহার। আজকের এই বিষাদময় দিনে আমাদের শেষ অঙ্গীকার— "জুলাইকে বাঁচিয়ে রাখলে বাংলাদেশ বাঁচবে, জুলাইকে মাথা উঁচু করে বাঁচিয়ে রাখতেই হবে!"

সংক্ষিপ্ত জীবনী :

ডঃ তারনিমা ওয়ারদা আন্দালিব: বর্তমানে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে সহকারী অধ্যাপক এবং যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড ইমপ্যাক্ট গ্রুপে গ্লোবাল কনসালট্যান্ট ডিরেক্টর হিসেবে কর্মরত আছেন।

দাউদ ইব্রাহিম হাসান : বর্তমানে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার্স-এর অর্থনীতি বিভাগে অধ্যয়নরত থাকার পাশাপাশি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় একজন রিসার্চ এসিস্ট্যান্ট এবং সেই সাথে আইডিএলসি ফাইন্যান্স পিএলসি-এর মার্কেটিং বিভাগের একজন সদস্য হিসেবে নিয়োজিত আছেন।

Sangbad Sarabela

সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী আবু জাফর

যোগাযোগ: । [email protected] । বিজ্ঞাপন ও বার্তা সম্পাদক: 01894944220

ঠিকানা: বার্তা ও বাণিজ্যিক যোগাযোগ : বাড়ি নম্বর-২৩৪, খাইরুন্নেসা ম্যানশন, কাঁটাবন, নিউ এলিফ্যান্ট রোড, ঢাকা-১২০৫।

আমাদের সঙ্গে থাকুন

© 2025 Sangbad Sarabela All Rights Reserved.