× প্রচ্ছদ বাংলাদেশ বিশ্ব রাজনীতি খেলা বিনোদন বাণিজ্য লাইফ স্টাইল ভিডিও সকল বিভাগ
ছবি ভিডিও লাইভ লেখক আর্কাইভ

ঢাকার মসজিদসমূহ: বিশ্বাস, ক্ষমতা ও নগরের সহযাত্রা

ড. তারনিমা ওয়ারদা আন্দালিব এবং দাউদ ইব্রাহিম হাসান

২৮ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৭:৪২ পিএম । আপডেটঃ ২৮ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৮:২০ পিএম

ছবি: সংবাদ সারাবেলা।

"মিনারের ওই বজ্রকণ্ঠ কোনোদিন কি স্তব্ধ হয়? যে সিজদায় ললাট মেশে ধুলোয়, তার কি কোনো পরাজয় রয়? ওরে ও মোহগ্রস্ত নগরবাসী, যান্ত্রিকতার পাষাণ শেকল ছিঁড়ে একবার ওই শীতল চাতালে এসে দাঁড়া—দেখবি ধ্বংসের ভিড়েও কীভাবে অক্ষত থাকে এক অবিনশ্বর আত্মা, যে আত্মা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে গেয়ে চলেছে মানুষের মুক্তি আর স্রষ্টার অসীম করুণার জয়গান; ঢাকার প্রতিটি ইটের খাঁজে খাঁজে আজ সেই বিদ্রোহের শপথ, যে শপথ আমাদের পরিচয়কে কোনো শিকলে বন্দি হতে দেবে না!"

নদী, নকশিকাঁথার মতো অলিগলি আর ইতিহাসের দীর্ঘশ্বাস বুকে নিয়ে গড়ে ওঠা এই ঢাকা শহর কেবল ইট-পাথরের জঙ্গল নয়। এই নগরের প্রতিটি ধূলিকণায় মিশে আছে হাজার বছরের সিজদার শব্দ আর মিনারের শীতল ছায়া। ঢাকার মসজিদগুলো কেবল ইবাদতের স্থান হিসেবে দাঁড়িয়ে নেই, বরং এরা সময়ের সাক্ষী, শাসনের পালাবদলের নীরব দলিল এবং আমাদের আত্মপরিচয়ের এক অবিনশ্বর দর্পণ। সুলতানি আমলের সেই নিভৃত প্রার্থনা থেকে শুরু করে আজকের একবিংশ শতাব্দীর গগনচুম্বী মিনার পর্যন্ত—ঢাকার মসজিদের ইতিহাস যেন এক প্রবহমান নদী, যা যুগে যুগে রূপ বদলেছে কিন্তু তার ভেতরের পবিত্র আত্মাটিকে কখনো হারিয়ে যেতে দেয়নি।

ঢাকার মসজিদের ইতিহাসের প্রথম প্রহর শুরু হয়েছিল সুলতানি আমলে, যখন ইসলাম এই ভূখণ্ডের জনজীবনে ধীরে ধীরে শিকড় গাঁথতে শুরু করে। ১৩শ থেকে ১৫শ শতাব্দীর সেই সময়টিতে ঢাকা কোনো পরিকল্পিত মহানগর ছিল না, বরং ঐতিহাসিক এম. এ. বারী এবং ড. সৈয়দ মাহমুদুল হাসান-এর গবেষণায় ফুটে ওঠে এক নদীকেন্দ্রিক সমৃদ্ধ বাণিজ্যপদের ছবি। সেই আমলে পাথরের দুষ্প্রাপ্যতার কারণে পোড়ামাটির ইট আর চুন-সুরকির মায়া দিয়ে তৈরি হতো একেকটি ইমারত। স্থপতি পার্সি ব্রাউনের বিশ্লেষণে দেখা যায়, তৎকালীন মসজিদগুলোর দেয়াল ছিল গড়ে ৩ থেকে ৪ ফুট পুরু আর গম্বুজগুলো ছিল ভূমি থেকে মাত্র ২০-২৫ ফুট উঁচুতে, যেন তা বাংলার আর্দ্র জলবায়ুর ঝোড়ো হাওয়া থেকে মুসল্লিদের পরম মমতায় আগলে রাখে। এই ডাটা আমাদের স্পষ্ট ইঙ্গিত দেয় যে, তৎকালীন স্থাপত্য ছিল মূলত প্রকৃতি ও নিরাপত্তার এক মেলবন্ধন। এর অর্থ হলো, আমরা কেবল উপাসনালয় গড়িনি, বরং প্রতিকূল পরিবেশের সাথে লড়াই করার একটি আত্মিক দুর্গ তৈরি করেছিলাম।

১৪৫৭ সালে নির্মিত বিনত বিবির মসজিদটি আজও সেই আদিম সারল্যের সাক্ষ্য দেয়। মিনারবিহীন এই বর্গাকার স্থাপনাটি আমাদের এই পরম সত্যের মুখোমুখি করে যে, বিশ্বাসের গভীরতা ইটের উচ্চতায় নয়, বরং আত্মার নিস্তব্ধতায় মাপা হয়। মুঘলদের আগমনে ঢাকার মসজিদ স্থাপত্যে এক মহিমান্বিত পরিবর্তন আসে। ১৬০৮ সালে ইসলাম খান চিশতির হাত ধরে যখন ঢাকা ‘সুবাহ বাংলার’ রাজধানী হলো, তখন মসজিদের ইতিহাসে এলো রাজকীয় জাঁকজমক। ঐতিহাসিক ক্যাথরিন বি. অ্যাশার চমৎকারভাবে বর্ণনা করেছেন কীভাবে মুঘল মসজিদগুলো রাষ্ট্রীয় শৌর্য আর পারস্য-প্রভাবিত অলঙ্করণকে একই সূত্রে গেঁথেছিল। তিন গম্বুজের ছন্দ, বক্রাকার খিলান আর উঁচু প্ল্যাটফর্ম বা ‘তহখানা’র ব্যবহার ঢাকার আকাশরেখাকে এক রাজকীয় রূপ দেয়। ড. এ. এইচ. দানির মতে, এই মসজিদগুলো কেবল উপাসনালয় ছিল না, বরং শিক্ষা ও বিচারের এক বহুস্তরীয় প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠেছিল। এই তথ্য আমাদের বুঝিয়ে দেয় যে, মুঘল আমলে ধর্ম কেবল ব্যক্তিগত বিশ্বাস ছিল না, বরং তা ছিল একটি সুশৃঙ্খল নগর সভ্যতার মেরুদণ্ড।

কিন্তু ১৭৫৭ সালের পলাশীর বিপর্যয় সেই রাজকীয় জৌলুসে এক বিষণ্ণ স্তব্ধতা নামিয়ে আনে। ব্রিটিশ শাসনের অধীনে ঢাকা যখন তার প্রশাসনিক গুরুত্ব হারায়, তখন রাষ্ট্রীয় তহবিলের অভাবে বড় মসজিদ নির্মাণের গতি প্রায় ৮০ শতাংশ হ্রাস পায়। ঐতিহাসিক আব্দুল করিমের বিশ্লেষণে দেখা যায়, এই সময়েই মসজিদগুলো পাথরের ইমারত থেকে রূপান্তরিত হয় মুসলিম আত্মপরিচয় রক্ষার শেষ দুর্গে। মুনতাসীর মামুনের বর্ণনায় ফুটে ওঠে এক সংগ্রামের ছবি, যেখানে শাসকের রঙ বদলালেও আত্মার বিশ্বাস ছিল অজেয়। মিনারের ছায়া তখন পরদেশী শাসনের তপ্ত রোদে পুড়তে থাকা একটি জাতিকে দিয়েছিল সাংস্কৃতিক আশ্রয়। এই ডাটা আমাদের এটিই স্মরণ করিয়ে দেয় যে, রাজনৈতিক পরাধীনতার সময় ধর্মই ছিল আমাদের জাতীয় অস্তিত্ব রক্ষার একমাত্র রক্ষাকবচ।

১৯৪৭ সালের দেশভাগ ঢাকার মসজিদের ইতিহাসে এক নতুন মনস্তাত্ত্বিক অধ্যায়ের সূচনা করে। পাকিস্তান পর্বে ঢাকা যখন পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক রাজধানী হলো, তখন মসজিদের স্থাপত্যে মুঘল আভিজাত্যের বদলে আধুনিক সরলতা প্রাধান্য পেতে শুরু করে। স্থপতি জহুরুল হকের প্রভাবে কংক্রিটের জ্যামিতিক নকশা জনপ্রিয় হয়, যার ফলে মসজিদের ধারণক্ষমতা পূর্বের তুলনায় প্রায় ৩০০ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। ঐতিহাসিক নাজিমুদ্দিন আহমেদের মতে, এই সময়ের মসজিদগুলো হয়ে উঠেছিল নতুন গড়ে ওঠা মহল্লার সামাজিক সংহতির কেন্দ্রবিন্দু। ১৯৫২-র ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বাধিকার আন্দোলনের প্রতিটি ধাপে মসজিদের প্রাঙ্গণ ছিল এক একটি নীরব প্রতিরোধ। এই পরিসংখ্যান আমাদের ইঙ্গিত দেয় যে, দ্রুত ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার আধ্যাত্মিক চাহিদা মেটাতে আমরা তখন জাঁকজমকের চেয়ে কার্যকারিতাকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলাম।

১৯৭১ সালের সেই রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের পর সার্বভৌম বাংলাদেশের বুকে মসজিদগুলো হয়ে ওঠে গণমানুষের একান্ত নিজস্ব ঠিকানা। স্বাধীনতার পর ঢাকার জনসংখ্যা যখন জ্যামিতিক হারে বাড়তে থাকে, তখন স্থাপত্যবিদ বশীরুল হক এবং সাইফুল হকের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী এক প্রকার ‘তৃণমূল আধুনিকতা’র জন্ম হয়। রাজকীয় ফরমানের বদলে সাধারণ মানুষের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দানে তৈরি হতে থাকে অসংখ্য মসজিদ। ড. মুহাম্মদ শামসুল হক একে ‘ধর্মের গণতান্ত্রিকীকরণ’ বলে অভিহিত করেছেন। তথ্য বলছে, স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে মসজিদের সংখ্যা বৃদ্ধির হার বার্ষিক প্রায় ৪.৫ শতাংশ। এই প্রবৃদ্ধি আমাদের এই পরম সত্যের মুখোমুখি করে যে, স্বাধীন বাংলাদেশে ধর্ম কোনো রাষ্ট্রীয় চাপ নয় বরং গণমানুষের হৃদস্পন্দনের প্রতিধ্বনি।

একবিংশ শতাব্দীর এই অন্তিম লগ্নে এসে ঢাকা এখন প্রযুক্তি আর ঐতিহ্যের এক মহাজাগতিক রূপান্তরের মুখোমুখি। স্থপতি মেরিনা তাবাসসুমের নকশাকৃত বাইত উর রউফ মসজিদের মতো স্থাপনাগুলো স্থাপত্যের জগতে এক নতুন দর্শন নিয়ে এসেছে, যেখানে কৃত্রিম আলোর বদলে প্রাকৃতিক আলো-বাতাসের খেলা আধ্যাত্মিক নিস্তব্ধতার স্বাদ দেয়। বর্তমানে লিফট, এসি, ডিজিটাল স্ক্রিন আর সৌরবিদ্যুতের ব্যবহার মসজিদগুলোকে আধুনিক জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ করে তুলেছে। পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৫ সালে ঢাকায় মসজিদের সংখ্যা ছিল প্রায় ৬,৫০০টি, যা ২০২৩ সালে বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ১০,৫০০-এ। এই ডাটা আমাদের ইঙ্গিত দেয় যে, যান্ত্রিক নগরায়নের চাপে পিষ্ট মানুষ আজও সেই মিনারের ছায়াতেই পরম শান্তি খুঁজে ফেরে। এটি প্রমাণ করে যে প্রযুক্তির উৎকর্ষ আমাদের আত্মিক তৃষ্ণাকে বিন্দুমাত্র কমাতে পারেনি।

আগামীর ২০৪০ সালের দিকে তাকালে আমরা এক অন্যরকম ঢাকার কল্পনা করতে পারি। ২০২৬ সালের মধ্যে ঢাকার অন্তত ১৫ শতাংশ মসজিদে স্মার্ট ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম চালুর পরিকল্পনা রয়েছে যা আমাদের আধুনিকায়নের প্রথম ধাপ। ২০৩০ সালের প্রক্ষেপণ অনুযায়ী, ঢাকার প্রায় ৬০ শতাংশ মসজিদ পরিবেশবান্ধব বা ‘গ্রিন আর্কিটেকচার’-এর আওতায় আসবে। ২০৩৫ সালে ডিজিটাল লাইব্রেরির মাধ্যমে মসজিদগুলো হবে বৈশ্বিক জ্ঞানের কেন্দ্রবিন্দু, যেখানে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ২ লক্ষ শিক্ষার্থী আধুনিক জ্ঞানার্জন করবে। ২০৪০ সালের সেই স্মার্ট ঢাকা মহানগরীতে মসজিদের মিনারগুলো হবে মহাকাশ গবেষণার মতো উচ্চ প্রযুক্তির সাথে আধ্যাত্মিকতার এক অভূতপূর্ব মেলবন্ধন। পরিশেষে ২০৫০ সালের চিত্র বলছে, ঢাকার প্রতিটি মসজিদ হবে একটি কার্বন-নিউট্রাল জোন, যা পুরো বিশ্বের জন্য একটি রোল মডেল হয়ে দাঁড়াবে। এই রূপকল্প আমাদের এই দৃঢ় বিশ্বাস জোগায় যে, আমরা কেবল অতীতে বাস করি না, বরং আমাদের বিশ্বাসই আমাদের আগামীর সর্বাধুনিক পথের দিশারী।

ঢাকার মসজিদগুলোর ইতিহাস আসলে আমাদেরই আত্মজীবনী। সুলতানি যুগের নীরবতা থেকে মুঘল গৌরব, ঔপনিবেশিক আঁধার থেকে আধুনিক কোলাহল—সব কিছুর মধ্যেও মসজিদ টিকে আছে এক অবিচল পবিত্রতা নিয়ে। এই মিনারগুলো শুধু অতীতের ধ্বংসাবশেষ নয়, এরা আমাদের আগামীর ধ্রুবতারা। সময় বয়ে যাবে, শহর তার রূপ বদলাবে, কিন্তু মসজিদের এই প্রশান্ত নিস্তব্ধতা চিরকাল নাগরিক জীবনের অস্থিরতাকে শান্ত করে যাবে। কারণ বিশ্বাস এখানে কোনো প্রাচীন পুঁথি নয়, বরং প্রতিনিয়ত নবায়িত হওয়া এক জীবন্ত স্পন্দন।

ডঃ তারনিমা ওয়ারদা আন্দালিব, বর্তমানে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে সহকারী অধ্যাপক এবং যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড ইমপ্যাক্ট গ্রুপে গ্লোবাল কনসালট্যান্ট ডিরেক্টর হিসেবে কর্মরত আছেন। দাউদ ইব্রাহিম হাসান, বর্তমানে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের মাস্টার্সে অধ্যয়নরত থাকার পাশাপাশি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় একজন রিসার্চ এসিস্ট্যান্ট হওয়ার পাশাপাশি আইডিএলসি ফাইনান্স পিএলসি-তে মার্কেটিং বিভাগের কর্মরত আছেন।

Sangbad Sarabela

সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী আবু জাফর

যোগাযোগ: । [email protected] । বিজ্ঞাপন ও বার্তা সম্পাদক: 01894944220

ঠিকানা: বার্তা ও বাণিজ্যিক যোগাযোগ : বাড়ি নম্বর-২৩৪, খাইরুন্নেসা ম্যানশন, কাঁটাবন, নিউ এলিফ্যান্ট রোড, ঢাকা-১২০৫।

আমাদের সঙ্গে থাকুন

© 2025 Sangbad Sarabela All Rights Reserved.