× প্রচ্ছদ বাংলাদেশ বিশ্ব রাজনীতি খেলা বিনোদন বাণিজ্য লাইফ স্টাইল ভিডিও সকল বিভাগ
ছবি ভিডিও লাইভ লেখক আর্কাইভ

বিলুপ্তির পথে সিরাজগঞ্জের মৃৎ শিল্প !

শফিক মোহাম্মদ রুমন (সিরাজগঞ্জ)

০৯ জানুয়ারি ২০২২, ০৪:০৫ এএম

আজ প্রায় বিলুপ্তির পথে বাঙ্গালীর শত বছরের পুরনো ঐতিহ্য সিরাজগঞ্জের মৃৎ শিল্প !  ‘মৃৎশিল্প’ শব্দটি ‘মৃৎ’ এবং ‘শিল্প’এই দুই শব্দের মিলত রূপ। ‘মৃৎ’ শব্দের অর্থ মৃত্তিকা বা মাটি আর ‘শিল্প’ বলতে সুন্দর ও সৃষ্টিশীল বস্তুকে বোঝানো হয়েছে। এজন্য মাটি দিয়ে তৈরি সব শিল্প কর্মকেই মৃৎ শিল্প বলা হয়।

প্রাচীনকাল থেকে বংশনুক্রমে গড়ে ওঠা গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী মৃৎ শিল্প আজ প্রায় বিলুপ্তির পথে। যারা মাটি নিয়ে কাজ করে পেশায় তারা কুমার আবার অনেকে বলে পাল। দিন দিন যেভাবে এ শিল্প বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে তাতে তারা এ পেশা নিয়ে বেশ চিন্তিত। তারপরও সিরাজগঞ্জে এমন এলাকা বা এমন গ্রাম আছে যেখানে এখনো বাংলার ঐতিহ্য তারা ধরে রেখেছে। এমনি কয়েকটি গ্রাম হচ্ছে সিরাজগঞ্জ সদরের বাগবাটি, সলঙ্গার বড়গোঁজা,ঘুড়কা বেলতলা,রায়গঞ্জের ধানগড়া,উল্লাপাড়ার ঝিঁকিড়া ও কামারখন্দের ভদ্রঘাট কুমার পাড়া। এসকল ছোট-ছোট পুরানো পাড়ায় বসবাসকারী মানুষের মধ্যে শিক্ষিত মানুষের সংখ্যা কম হলেও কর্মঠ মানুষের সংখ্যা বেশি। ওই সকল পাড়ার সবাই হিন্দু ধর্মালম্বী। এক সময় এসকল কুমার পল্লীর মানুষের বাড়ির প্রায় সব ঘর ছিল মাটির তৈরী। সময়ের পরিবর্তনে এখন তাদের বাড়ী ঘরের অনেক পরিবর্তন ঘটেছে। আবার এদের মধ্যে অনেকে মাটির ঘরের মায়া ত্যাগ করতে না পেরে সেই মাটির ঘরেই বাস করছে। তাদের বাড়ির সামনে ছোট্ট উঠান। উঠানজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে কাদামাটির তৈরি হাঁড়ি,পাতিল, কড়াই কলস,কলস,কাসা সড়া,ফুলের টপ,কুপের পাট,চারি ও দইয়ের খুঁটিসহ ছোট-বড় নানা রকমের পাত্র। এমনকি হিন্দু ধর্মালম্বীদের বিভিন্ন পুঁজা উৎসবকে সামনে রেখে তারা নিপুণ হাতে প্রতিতাও তৈরি করে করেন। এশিল্পের সাথে জড়িতদের শিক্ষা ও জীবনযাত্রার মান অনুন্নত হলেও তাদের মধ্যে রয়েছে অসাধারণ নিপুণ শৈল্পীক গুণাবলী।

আধুনিকতার প্রবল স্রোতে বাংলার প্রাচীন এই শিল্পের সাথে সাথে হারিয়ে যেতে বসেছে এই শিল্পের সাথে বহু বছর ধরে জড়িত মানুষগুলোও। বর্তমান সভ্যতার সাথে পেরে উঠছেনা এই মাটির কারিগররা। আগে মাটির বাসন কসনসহ বিভিন্ন মাটির তৈরী দ্রব্যাদি ব্যবহার হলেও মেলামাইন, এ্যালুমুনিয়াম ও প্লাস্টিকের ব্যাপক ব্যবহারের ফলে এসব আজকালের গর্ভে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। তারা এই পেশা ছেড়ে এখন অন্য পেশায় নিয়োজিত হয়েছে ব্যাপক হারে।আধুনিকতার নির্মম স্পর্শে এই শিল্পের কদর দিন দিন কমে যাচ্ছে। বলতে গেলে আজ প্রায় বিলুপ্তির পথে এই শিল্প এবং এই শিল্পের সাথে জড়িত ব্যক্তিরা। তারা এখন অসহায় ও নিঃস্ব হয়ে পড়ছে। এমনকি তারা আজ হারাতে বসেছে তাদের নিপুণ শৈল্পীক গুণাবলী। এতকিছুর পরও অনেকে শত কষ্টের মাঝেও বাপ-দাদার ঐতিহ্য ধরে রাখার নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
সলঙ্গার ঘুড়কা বেলতলার পাল পাড়ার একজন নিতাই পালের সাথে কথা হলে তিনি তাদের বর্তমান দুরাবস্থার কথা জানান। এসময় তার সাথে কথা বলে জানা যায়,বংশনুক্রমে তাদের এখানে বসবাস। যখন থেকে হিন্দু পাল বংশের আবির্ভাব। পালরা এক সময় প্রতিমা,মুর্তি, হাড়ি,পাতিল বানানোর কাজ করতো তাও শুধু রাজা-জমিদারদের জন্য। কিন্তু রাজা-জমিদারদের প্রথা উঠে যাওয়ার পর কুমার পল্লী গ্রামের কুমাররা বেকার হয়ে যায়। পরে তারা নিজেরা মাটির বাসন তৈরি করে নিজেরা উদ্যোগ নিয়ে বিভিন্ন বাজার ও গ্রামে গ্রামে ঘুরে বিক্রি করতে শুরু করেন। এ নিয়ম চলে আসছে অনেক বছর ধরে।

নিখুঁত হাতের ছোয়ায় মাটির বাসন কোসন বানানো সম্পর্কে তিনি বলেন, ছোট বেলা থেকে চেষ্টা সাধনা করলেই এমন কাজ সহজে পারা যায়। তা ছাড়া এ বংশে যারা জম্ম গ্রহণ করে ঈশ্বর প্রদত্ত ক্ষমতা তাদের মধ্যে থেকে যায় এসব তৈরিতে। বর্তমানে ঘুড়কা কুমার পাড়ায় প্রায় কয়েক শত কুমার রয়েছে। বিগত ১০/১২ বছর আগেও সবাই এই পেশায় থাকলেও এখন এই পেশা থেকে সরে গিয়ে বিদেশ যাত্রাসহ বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে জড়িয়ে পড়ছে। তিনি নিজেও আগে এই পেশায় জড়িত থাকলেও বর্তমানে তিনি এই কাজ করেন না। কুমার বাড়িগুলোতে ঢুকলে চোখে পড়বে হাড়ি আর মাটির তৈরির বাসন। কোনগুলো কাচা,অর্থাৎ পোড়ানো হয়নি আবার কিছু শুকিয়ে রাখা হয়েছে,কিছু পুড়িয়ে রং করেও বিক্রির জন্য তৈরী করা হচ্ছে।

এশিল্পের সাথে জড়িত কামারখন্দের ভদ্রঘাটের কুমার পল্লীর কুমার নিখিল পালের সঙ্গে কথা হলে তিনি জানান,মাটি দিয়ে জিনিসপত্র তৈরির জন্য যে মাটি ব্যবহার করা হয় সেই মাটি পুকুর,ডোবা ও জমিন থেকে নিয়ে আসা হয়। এসব মাটি দিয়ে তৈরি হয় নানা ধরনের মাটির তৈজসপত্র। প্রাথমিক অবস্থায় কাঁচা মাটির সামগ্রী গুলো প্রথমে রোদে শুকানো হয় তারপর আগুনে পোড়ানো হয়। যে স্থানে এগুলো পোড়ানো হয় তাকে বলা হয় “মইলা”। মাটির নিচে সুড়ঙ্গ কাটার পর তার উপর খড়ের ভেতর মাটির তৈরি শুকনো কাঁচা সামগ্রী গুলো ভাঁজ করে রেখে নিচে আগুন দেয়া হয়। খড়ের উপরের অংশটি পুরোটি মাটির প্রলেপ দিয়ে ঢেঁকে দেয়া হয় এবং ঐ প্রলেপের উপর বাঁশের কঞ্চি দিয়ে অনেক গুলো ফুঁটো করে দেয়া হয় যেন ধোঁয়া বের হয়ে যেতে পারে। সামগ্রী গুলো পোড়ানো হলে পরবর্তীতে এগুলো রং করা হয় এবং বিক্রি করার জন্য প্রস্তুত করা হয়। তবে মজার কথা হচ্ছে,মাটির সামগ্রী পোড়ানর আগে অথ্যাৎ কাঁচা অবস্থায় হাজার টাকা দিলেও কোনভাবেই বিক্রি করেন না। এতে তাদের ক্ষতি হতে পারে।

সলঙ্গার বড়গোঁজার শেফালী রানী পাল বলেন,”মাটির এসব কাজ আমাদের পারিবারিক ঐতিহ্য। আমাদের কয়েক পুরুষ ধরে এ কাজ করে আসছে। আমরাও করছি। মাঠ থেকে মাটি এনে পণ্য তৈরি করে বিক্রি পর্যন্ত প্রায় সব কাজই করি। স্বামীও আমার সঙ্গে কাজ করেন। আর এ কাজ করেই আমাদের সংসার চলে। এ কাজ করতে ভালোই লাগে। আর সারা বছরের তুলনায় পূজা, ঈদ বা বৈশাখের সময় কাজের চাহিদা বেশি থাকে।”যুগ এখন অনেক পাল্টে গেছে। দিন দিন এই শিল্প এখন অবহেলার পাত্র হয়ে গেছে। আধুনিকতার ছোঁয়ায় এই শিল্প এখন হারিয়ে যাচ্ছে।



Sangbad Sarabela

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী আবু জাফর

যোগাযোগ: । 01894-944220 । [email protected], বিজ্ঞাপন: 01894-944204

ঠিকানা: বার্তা ও বাণিজ্যিক যোগাযোগ : বাড়ি নম্বর-২৩৪, খাইরুন্নেসা ম্যানশন, কাঁটাবন, নিউ এলিফ্যান্ট রোড, ঢাকা-১২০৫।

আমাদের সঙ্গে থাকুন

© 2024 Sangbad Sarabela All Rights Reserved.