সংগৃহীত ছবি
সাধারণত
পুরান কাপড়ের পাড় থেকে সুতা তুলে অথবা তাঁতিদের থেকে নীল, লাল, হলুদ প্রভৃতি সুতা কিনে এনে কাপড় সেলাই করা হয়। নকশি কাঁথা ভারত ও বাংলাদেশের লোকশিল্পের
একটা অংশ। ঘরের মেঝেতে পা ফেলে পায়ের
আঙ্গুলের সঙ্গে কাপড়ের পাড় আটকিয়ে সূতা খোলা হয়। এই সুতা পরবর্তীতে
ব্যবহারের জন্য রেখে দেয়া হয়।
৭০দশকের
শেষভাগে বিলুপ্তপ্রায় হস্তশিল্পকে ৮০দশকের শুরুতেই পুনরুদ্ধার করে বাণিজ্যিক ও প্রাতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়ায়
গতিযোগ করে ব্র্যাকের সহযোগী ‘আয়েশা আবেদ ফাউন্ডেশন’ নামক বেসরকারী প্রতিষ্ঠান। ব্র্যাক জামালপুরের বিভিন্ন গ্রামের সূচি শিল্পীদের খুঁজে বের করে নকশী কাঁথা শিল্পের নবউত্থান ঘটায়। জেলার বিভিন্ন প্রান্তে ‘আয়েশা আবেদ ফাউন্ডেশন’ নামে একটি করে প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয় । পরবর্তীতে
১৯৮৭ সালে বেসরকারী সংস্থা উন্নয়ন সংঘ একহাজার গ্রামীণ মহিলাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে নকশী কাঁথার কার্যক্রম শুরু করে।
হস্তশিল্পের ক্ষেত্রে জামালপুর জেলা সারা বিশ্বে সমাদৃত। এ অঞ্চলের কারুশিল্পের ও হস্তশিল্পের চমৎকার নিদর্শনসমূহের মাঝে নকশি কাঁথা, মৃৎ শিল্প, কাঁসাশিল্প, নকশি পাখা, নকশি শিকা, বাঁশের তৈরি চাটাই, ধারাই, খাঁচা, কোলা ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। হারিয়ে যেতে থাকা বাংলার প্রাচীন ঐতিহ্য- হস্তশিল্প বর্তমান জামালপুর জেলার হাজারো মানুষের একমাত্র অবলম্বন।
কৃষিপ্রধান
জামালপুর জেলাতে প্রতি বছর নদী ভাঙ্গন ও বন্যায় অনেক
মানুষের জমি নদীর বুকে বিলীন হয়ে যায় যা সাধারণ মানুষদের
হতাশাগ্রস্থ করে তুলে, বেকারত্বের হার বৃদ্ধি করে কিন্তু আশির দশকে জামালপুর জেলায় হস্তশিল্পের ব্যাপক প্রসারের ফলে সাধারণ মানুষ নিদারুণ দুর্ভোগ থেকে মুক্তি লাভ করে, তাদের আয়-রোজগারের বিকল্প
উৎস সৃষ্টি হয়।
নির্মাণশৈলী
কাছে
থেকে দেখা রাজশাহীর কাঁথা। বাম ও নিচের দিক
জুড়ে কাঁথার পাড় দেখা যাচ্ছে। কাঁথার জমিনে সাধারণ কাঁথা ফোঁড়ে সাদা সুতা দিয়ে তরঙ্গ আকারে সেলাই দেয়া হয়েছে।
গ্রামাঞ্চলের
নারীরা পাতলা কাপড়, প্রধানত পুরানো কাপড় স্তরে স্তরে সজ্জিত করে সেলাই করে কাঁথা তৈরি করে থাকেন। কাঁথা মিতব্যয়ীতার একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ, এখানে একাধিক পুরানো জিনিস একত্রিত করে নতুন একটি প্রয়োজনীয় জিনিস তৈরি করা হয়। কাঁথা তৈরির কাজে পুরানো শাড়ি, লুঙ্গি, ধুতি ইত্যাদি ব্যবহৃত হয়। প্রয়োজন অনুযায়ী কাঁথার পুরুত্ব কম বা বেশি
হয়। পুরুত্ব অনুসারে তিন থেকে সাতটি শাড়ি স্তরে স্তরে সাজিয়ে নিয়ে স্তরগুলোকে সেলাইয়ের মাধ্যমে জুড়ে দিয়ে কাঁথা তৈরি করা হয়। সাধারণ বা কাঁথাফোঁড়ে তরঙ্গ
আকারে সেলাই দিয়ে শাড়ীর স্তরগুলোকে জুড়ে দেয়া হয়। বিভিন্ন রঙের পুরানো কাপড় স্তরীভূত করা থাকে বলে কাঁথাগুলো দেখতে বাহারী রঙের হয়। সাধারণত শাড়ীর রঙ্গীন পাড় থেকে তোলা সুতা দিয়ে কাঁথা সেলাই করা হয় এবং শাড়ির
পাড়ের অনুকরণে কাঁথাতে নকশা করা হয়। তবে কোন কোন অঞ্চলে (প্রধানত রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জ এলাকায়) কাপড় বোনার সুতা দিয়েও কাঁথাতে নকশা করা হয়ে থাকে। সাধারণ কাঁথা কয়েক পাল্লা কাপড় কাঁথাফোঁড়ে সেলাই করা হলেও এই ফোঁড় দেয়ার
নৈপুণ্যের গুণে এতেই বিচিত্র বর্ণের নকশা, বর্ণিল তরঙ্গ ও বয়নভঙ্গির প্রকাশ
ঘটে। নকশার সাথে মানানোর জন্য বা নতুন নকশার
জন্য কাঁথার ফোঁড় ছোট বা বড় করা
হয় অর্থাৎ ফোঁড়ের দৈর্ঘ্য ছোট-বড় করে বৈচিত্র্য
আনা হয়। উনিশ শতকের কিছু কাঁথায় কাঁথাফোঁড়ের উদ্ভাবনী প্রয়োগকে কুশলতার সাথে ব্যবহার করার ফলে উজ্জ্বল চিত্রযুক্ত নকশা দেখা যায়। কাঁথাফোঁড়ের বৈচিত্র্য আছে এবং সেই অনুযায়ী এর দুটি নাম
আছেঃ পাটি বা চাটাই ফোঁড়
এবং কাইত্যা ফোঁড়।
বেশিরভাগ
গ্রামের নারী এই শিল্পে দক্ষ।
সাধারণত গ্রামের মহিলারা তাদের অবসর সময় নকশি কাঁথা সেলাই করে থাকেন। এক একটি কাঁথা
সেলাই করতে অনেক সময়, এমনকি ১ বছর সময়ও
লেগে যায়। নতুন জামাইকে বা নাদ বউকে
উপহার দেয়ার জন্য নানী-দাদিরা নকশি কাঁথা সেলাই করে থাকেন। এক একটি কাঁথা
সেলাইয়ের পিছনে অনেক হাসি-কান্নার কাহিনী থাকে। বিকেল বেলা বা রাতের খাবারের
পর মহিলারা একসাথে বসে গল্প করতে করতে এক একটি কাঁথা
সেলাই করেন। তাই বলা হয় নকশি কাঁথা
এক একজনের মনের কথা বলে। এটি মূলত বর্ষাকালে সেলাই করা হয়। একটা প্রমাণ মাপের কাঁথা তৈরিতে ৫ থেকে ৭
টা শাড়ি দরকার হয়। আজকাল পুরান সামগ্রীর বদলে সুতির কাপড় ব্যবহার করা হয়। ইদানীং কাঁথা তৈরিতে পুরান কাপড়ের ব্যবহার কমে গেছে।
মূলত
নকশা করার পূর্বে কোন কিছু দিয়ে এঁকে নেওয়া হয়। তারপর সুঁই-সুতা দিয়ে ওই আঁকা বরাবর
সেলাই করা হয়। কাঁথায় সাধারণত মধ্যের অংশের নকশা আগে করা হয় এবং ধীরে
ধীরে চারপাশের নকশা করা হয়। আগে কিছু কাঁথার নকশা আঁকানোর জন্য কাঠের ব্লক ব্যবহার করা হতো, এখন ট্রেসিং পেপার ব্যবহার করা হয়।
জামালপুরের
মোট ৭টি উপজেলা হলো:
ইসলামপুর,
জামালপুর সদর, দেওয়ানগঞ্জ, বকশীগঞ্জ, মাদারগঞ্জ, মেলান্দহ, সরিষাবাড়ী,জামালপুরের নকশী কাঁথা ও নকশী চাদর
এখনো সারা দেশে সমাদৃত। এখানে তৈরি নকশিকাঁথা এশিয়া ও ইউরোপের বিভিন্ন
দেশে রফতানি হচ্ছে। দারিদ্র্য বিমোচনেও এ জেলার শিল্পটি
গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে।
প্রকৃত
জীবনমুখী ভাবনা
গৃহস্থের
সকল কাজের পাশাপাশি অবসর সময়কে কাজে বয়োবৃদ্ধ
নারীরাও এ কাজ করে
হতে পারে; আয় বাড়ে সাথে
কর্মসংস্থানও বাড়ে, বেকারত্ব লাগব হয় ও হতাশা
হ্রাস পায়, মানুষ কর্মমুখী হয়, হয়। বর্তমান সময়ের প্রায় ৬০-৭০ভাগ পরিবারের
সন্তানরাই নিজেদের লেখাপড়ার খরচ যোগাতে নিপুণভাবে হস্তশিল্পের কাজ করে থাকে।
জামালপুর জেলায় এ কারুশিল্প বা হস্তশিল্পের প্রসার একদিনেই হয় নি। আধুনিক চাকচিক্যময় অবস্থানে হারিয়ে যেতে বসা হস্তশিল্পের ঐতিহ্যময় ইতিহাস অনেক প্রাচীন। গ্রাম-বাংলার মহিলারা একসাথে বসে নানা আলাপ-আলোচনা, গল্প-কথার মিলনে শেষ করত প্রতিটি কাজ। আর সেই সকল সূচিকর্মের সাথে মিশে থাকত তাদের অনেক ভালোবাসা, আশা, আকাঙ্ক্ষা, বিরহ-বেদনা। পল্লীকবি জসীমদ্দীনের ‘নকশী কাঁথার মাঠ’ নামক অমর আখ্যানের মতো আবহমান বাংলার নারীরা প্রতীক্ষার প্রহর কাটতে নকশী কাঁথায় সুঁইয়ের আঁচড় দিয়ে যায়, কাঁথায় লেখে কত সুখ-দুঃখ গাঁথা। প্রবাসে কিংবা বিদেশ বিভূঁইয়ে আত্মীয় স্বজন কিংবা পরিবার পরিজনের স্মৃতি কাঁথার জমিনে জীবন্ত হয়ে ওঠে আর তাইতো এতো সুন্দর হয় এই নকশী কাঁথা।
জামালপুর জেলার সকল উপজেলাতেই নকশী কাঁথা শিল্পের উৎপাদন হয় এবং প্রায় ৩০০ এর মতো প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। নকশী কাঁথা শিল্পের জিনিস পত্রাদির মধ্যে রয়েছে নকশী কাঁথা, বেড কভার, থ্রিপিস, ওয়ালমেট, কুশন কভার, শাড়ি, পাঞ্জাবি, টি শার্ট, ফতুয়া, স্কার্ট, লেডিজ পাঞ্জাবি, ইয়ক, পার্স, বালিশের কভার, টিভি কভার, শাড়ির পাইর, শাল চাদর ইত্যাদি।
জামালপুরের
নকশী পণ্যের কদর বাড়ছে দেশে-বিদেশে। জামালপুর জেলা শহরেও রয়েছে এ শিল্পের ছোট-বড় অনেক শো-রুম। কিন্তু বিপণন সমস্যা, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা আর পুঁজির অভাবে
শ্রমের ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছে এখানকার নারী কর্মীরা। ইচ্ছে মতো মালিকের দেয়া অল্প মজুরিতেই সন্তুষ্ট থাকতে হয় তাদের। আর
স্থানীয় ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা বলছেন, একটি নকশী কাঁথা তৈরি করতে মজুরিসহ খরচ হয় ১৬০০ থেকে
১৮০০ টাকা। ঢাকার পাইকারী ব্যবসায়ীদের নিকট তা বিক্রি করতে
হয় ২০০০ টাকায়। এই কাথা ঢাকার
বড় বড় বিপণি বিতানগুলোতে
বিক্রি হয় ৪ থেকে
৫ হাজার টাকায় । পুঁজির অভাবে
তারা নিজেরা বাজারজাত করতে পারছেন না এসব পণ্য।
ফলে পণ্যের ন্যায্য মূল্য থেকে নিজেরা যেমন বঞ্চিত হচ্ছেন তেমনী যথাযথ শ্রমমূল্য পাচ্ছেন না নারী শ্রমিকরা।
হস্ত
শিল্প এসোসিয়েশনের উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর সেলিম বলেন, হস্তশিল্প ব্যবসায়ীদের পুঁজি সংকটের কথা মাথায় রেখে পৃষ্ঠপোষকতায় এগিয়ে এসেছে ন্যাশনাল ব্যাংক। হস্ত শিল্প ব্যাবসায়ীদের মাঝে চালু করেছে এস এম ই
ঋণ কার্যক্রম। আরো অন্য অর্থিক প্রতিষ্ঠানের ঋণ সহায়তা পেলে
এখানকার ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা সরাসরি এসব সূঁচি পণ্য ঢাকাসহ বড় শহরে নিজেরাই
বিপণন করতে পারবে।
দেশের বাইরেও পণ্যটির রয়েছে ব্যাপক চাহিদা। রপ্তানি করতে পারবে বিদেশেও। দেশের গার্মেন্ট শিল্পের পরেই জামালপুরের হস্তশিল্প দেশের অর্থনীতির প্রাণ প্রবাহ তৈরিতে বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন হস্ত শিল্প সংশ্লিষ্টরা। হস্তশিল্প পণ্যের নিজস্ব বাজার গড়ে উঠলে হত দরিদ্র নারী
শ্রমিকরা একদিকে যেমন তাদের সঠিক শ্রম মূল্য পাবেন, পাশাপাশি দরিদ্র এই জেলায় গ্রামীণ
অর্থনীতির চিত্রও পুরো পাল্টে যাবে।
প্রায়
১০০ একর জমি নিয়ে র্নিমিত হচ্ছে শেখ হাসিনা নকশীঁ পল্লী-- এই নকশী কাঁথায়
গ্রামের অসহায় সহজ সরল মানুষের হাতের ছোঁয়ায় ফুটে উঠেছে দেশ জাতি শিক্ষা সংস্কৃতির প্রতি”ছবি। জনপ্রিয়তা আর সৌন্দযের্র জন্য
ইতোমধ্যে এর খ্যাতি দেশের
সীমানা ছেড়ে বিদেশের মাটিতে। প্রায় কয়েক হাজার পরিবার এই নকঁশী কাঁথা
সেলাই করে জীবিকা নির্বাহ করে। শহরের বকুল তলা, মাদ্রাসা রোড়,কলেজ রোড় আজম চত্বরসহ অলিতে গলিতে গড়ে উঠেছে নকশী কাঁথার শোরুম। জামালপুর নকশী কাঁথা সমিতির সভাপতি শাহিন ভাই জানান আগের চেয়ে দ্কোান পাট অনেক বেড়েছে। বিক্রী কমে গেছে। মহামারি করোনার প্রভাব পড়েছে এই শিল্পেও। পাশাপাশি
বিভিন্ন মেলা ও বিশেষ নকশী
কাঁথার হাট বসানোর পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানান। এ জেলায় রাস্তা
ঘাট,ব্রিজ কলকারখানার ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। তাই এই নকশী শিল্পের
ভবিষ্যৎ অনেক উজ্জ্বল বলে তিনি মন্তব্য করেন।
কয়েকজন
সেলাই কর্মীর সংগে কথা
বলে জানা যায়, অভাব দারিদ্র্যতা ছেলে মেয়েদের লেখা পড়া সহ সাংসারিক খরচা
এই কর্মেও মাধ্যমে মিটে যাচ্ছে বেশ ভালোভাবেই। নকশী কাঁথা সেলাই করে এতিম দুইবোন রুবা ডেইজি আগের চেয়ে অনেক ভালোভাবে চলতে পারছে। কলেজ রোড়ের মরিয়ম বেগম তিন ছেলে মেয়েকে বিশ^বিদ্যালয়ে লেখা পড়া করাচ্ছেন। আরো অনেক পরিবার এই নকশী কাঁথা
সেলাই করে স্বাবল্মবী হয়েছে। শেখ হাসিনা নকশী পল্লী জামালপুরের আর্থ সামাজিক পরিপট বদলে দিবে বলে এলাকারবাসীর প্রত্যাশা।
© 2023 Sangbad Sarabela All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh