× প্রচ্ছদ বাংলাদেশ বিশ্ব রাজনীতি খেলা বিনোদন বাণিজ্য লাইফ স্টাইল ভিডিও সকল বিভাগ
ছবি ভিডিও লাইভ লেখক আর্কাইভ

যখন ‘চিলি’ মানে মরিচ না

মাহফুজুর রহমান

১২ নভেম্বর ২০২২, ০২:২১ এএম । আপডেটঃ ১৫ নভেম্বর ২০২২, ১২:২৫ পিএম

চিলির রাজধানী ও বৃহত্তম শহর সান্তিয়াগো

শৈশবে ইংরেজি শেখানোর জন্য শিক্ষকরা যখন ইংরেজি শব্দ মুখস্থ শুরু করালেন, তখন জেনেছিলাম ইংরেজি শব্দ ‘চিলি’ মানে মরিচ। আর ক বছর পর ভূগোল পড়তে এসে আবিষ্কার করলাম, চিলি নামে একটা দেশও আছে, আর তা দেখতে আবার মরিচেরই মতো। সরু আর লম্বা।

দেশ হতে গেলে নির্দিষ্ট কোনো আকার নিতে হবে এমন কোনো কথা নেই। ফলে একেক দেশের আকার একেক রকম। কিন্তু চিলি ছাড়া আর কোনো দেশ এমন সরু আর লম্বা না। নামকরণের একটা সার্থকতা আছে!

দক্ষিণ আমেরিকার নিচটা এমনিতে সরু হয়ে গেছে। যেন জিরাফের ঘাড়। সেই মহাদেশের পশ্চিম পাড়জুড়ে, প্রশান্ত মহাসাগরের তীর ধরে, আন্দিজ পর্বতমালার পাদদেশে উত্তর-দক্ষিণে ৪,৩৮০ কিলোমিটার দীর্ঘ দেশ চিলি। অথচ পূর্ব-পশ্চিমে দেশটি দু’-তিন শ’ কিলোমিটারের মতো। সর্বোচ্চ প্রস্থ ৩৫০ কিলোমিটার। যদিও কোথাও কোথাও তা ১০০ কিলোমিটারের কম।

আকারের কারণে দেশটির নাম সেই শৈশব থেকে মুখস্থ হয়ে গেছে। কিন্তু নাম মুখস্থ হলে কী হবে, দক্ষিণ আমেরিকা তো বহু দূরে। ব্রাজিল বা উরুগুয়ে তখন ফুটবলের কল্যাণে কিঞ্চিৎ পরিচিত। চিলি তেমন একটা না। কিন্তু হঠাৎ করে চিলি চলে এলো খবরের শিরোনামে, ১৯৭৩ সালে। রেডিওর বিশ্ব সংবাদ টিউন করায় শুনলাম চিলির প্রেসিডেন্ট আইয়েন্দে এক সামরিক অভ্যুত্থানে নিহত। এই সংবাদটাও দাগ কাটত না। কিন্তু পরে শুনলাম, আইয়েন্দের হত্যার প্রতিবাদে ঢাকায় ছাত্রদের মিছিল হচ্ছে।

প্রায় একই সময়ে জেনে গেলাম চিলির কবি পাবলো নেরুদার নাম। ১৯৭১ সালে তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। বিপ্লব-বিদ্রোহ নিয়ে যেমন লেখেন, তেমন লেখেন প্রেম-ভালোবাসা নিয়ে। সেজন্য স্কুল-কলেজে পাবলো নেরুদার কবিতা পড়া তখন দারুণ একটা আধুনিক ব্যাপার ছিল।

পাবলো নেরুদা কবিতা লেখেন স্প্যানিশ ভাষায়। ঢাকা ও কলকাতা থেকে পাবলো নেরুদার কবিতার বাংলা অনুবাদ বই আকারে বের হয়েছে। সংগ্রাম, আন্দোলন, ভালোবাসা, প্রেমের জৈবিক সমীকরণ পাবলো নেরুদা ছাত্রজীবনের এসব স্বপ্ন অনুষঙ্গের অবশ্য সঙ্গী।

এত দূরের দেশ সম্পর্কে মানুষের আগ্রহ থাকে কম। আমারও খুব বেশি ছিল না। কিন্তু খেলাচ্ছলে সেই ছোটকালে স্কুল বা কলেজে কৌতূহল উদ্রেক করার জন্য জিজ্ঞেস করতাম কাউকে, সবজি বা মসলার নামে একটা দেশ আছে, কেউ কি তার নাম বলতে পারে! অনেকেই বলতে পারত। আমার মতো অনেককেই দেশটি চমৎকৃত করত। রোমাঞ্চিত করত।

মনে এমন ভাবনাও আসত যে চিলির সমুদ্রসৈকত ধরে দক্ষিণে যেতে যেতে এক সময় অ্যান্টার্টিকায় পৌঁছে যাব। শ্বেতশুভ্র তুষারের ভেতর পেঙ্গুইন খুঁজে পাব। হয়তো মানুষের অবয়ব দেখে পেঙ্গুইনরাও বিস্মিত হবে। ভাবিনি, অমন তুষারঘেরা শীতের রাজ্যে বেঁচে থাকতে পারব কি না!

পঞ্চাশ বছর বয়সে এক অদ্ভুত সুযোগ এলো। চিলি যাওয়ার সুযোগ। ঢাকায় চিলির কোনো দূতাবাস নেই। কুরিয়ারে করে পাসপোর্ট পাঠালাম নয়াদিল্লি। চিলিয়ান দূতাবাস। সঙ্গে ইন্টারনেট থেকে ডাউনলোড করে পূরণ করা চিলিয়ান ভিসা ফরম, তিন কপি ছবি। ঢাকাস্থ চিলিয়ান অনারারি কনসাল খুশিমনে এগিয়ে এলেন।

আমার সফর সরকারি হওয়ায় ভিসা পেতে ঝামেলা হলো না। ভিসা ফিও লাগল না। দশ ডলার বেঁচে গেল। টিকিট কাটলাম এমিরেটসে। বহু দূরের পথ। দুবাইয়ে এক রাত কাটিয়ে সাও পাওলো পৌঁছালাম। ঢাকা-দুবাই সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা আর দুবাই-সাও পাওলো চৌদ্দ ঘণ্টা। প্লেনে বসে থেকে থেকে শরীর প্রায় কুঁকড়ে গেছে।

আমরা যদিও চিলি যাচ্ছি তবে সরাসরি যাচ্ছি না। দুবাই থেকে সাওপাওলো। সেখানে পাঁচ দিনের প্রোগ্রাম। মাঝে একদিন রাজধানী ব্রাসিলিয়ায় যাব। এরপরের গন্তব্য কলম্বিয়া। আমার সহযাত্রীদের মধ্যে অনেকের কলম্বিয়ান ভিসা হয়নি তখনো। সে জন্য তাঁদের কলম্বিয়া যাওয়াটা কিঞ্চিৎ ঝুলে আছে। কলম্বিয়া থেকে সফরের শেষ অংশটায় চিলি।

এই সফরে আমি একা না। সরকারি ও বেসরকারি প্রতিনিধি সমন্বয়ে গড়া বারোজনের এক বাণিজ্য প্রতিনিধিদলের সদস্য আমি। আমাদের দলনেতা সরকারের বাণিজ্যসচিব, মাহবুব আহমেদ। ছোটোখাটো গড়ন। হাসিখুশি। সোনালি ফ্রেমের চশমা পরেন। তাঁর সঙ্গে আছে তরুণ ব্যক্তিগত সচিব, আনিসুর রহমান। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর সহসভাপতি শুভাশীষ বসু, মহাপরিচালক সালাহউদ্দিন মাহমুদ এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পরিচালক শহিদুল ইসলাম।

বেসরকারি সদস্যদের সংখ্যা পাঁচ। পোশাকশিল্প নেতা মোহাম্মদ হাতেম, ওষুধশিল্প থেকে তিনজন প্রসেনজিত, বুলবুল ও লকিয়তুল্লাহ। নিও জিপারের মাহবুবুল আমিন এবং অনারারি কনসাল আসিফ চৌধুরী নিজে।

আমার নিজের ব্যস্ততার কারণে ঢাকা বা দুবাইয়ে, কিংবা ফ্লাইটে অন্য সদস্যদের সঙ্গে খুব একটা কথা বলার সুযোগ হয়নি। ফ্লাইটে অনারারি কনসাল আসিফ আহমেদ চৌধুরী আমার পাশে বসেছিলেন। তিনি চিলির ওপর টুকটাক ব্রিফিং দিচ্ছিলেন। তারচেয়ে বেশি ব্রিফিং দিচ্ছিলেন লম্বা ফ্লাইটে সময় কীভাবে কাটানো যায়।

হাত-পা নাড়াতে হবে। মাঝেমধ্যে হাঁটতে হবে। হাত-পা স্ট্রেচ করতে হবে। আর কিছুক্ষণ পরপর পানি বা তরল কিছু গলায় ঢালতে হবে। বিমানের ভেতর আর্দ্রতা কম থাকে। সে জন্য ডিহাইড্রেশনের ভয় আছে। বিমানের ওঠানামায় তখন কানে ব্যথা হতে পারে। হাই তুলে শরীরে পর্যাপ্ত অক্সিজেন ঢুকিয়ে সেই ব্যথা কমাতে হয়। বিমানে উঠলে ইন-ফ্লাইট যে ম্যাগাজিন থাকে, তাতে এই ধরনের অনেক টোটকা থাকে। কাজেও লাগে। আসিফ চৌধুরী সেই সব টোটকা দিচ্ছিলেন।

আমাদের দুজনের সিটের সারি ২৫। ইকোনমি ক্লাসের প্রথম সিট। ফলে পা রাখার যথেষ্ট জায়গা। আসিফ চৌধুরীর পা লম্বা। পা যুগলকে নিয়ন্ত্রণ করতে তাঁর জায়গা লাগবে। আমার পা অত লম্বা না। আমার জন্য বাড়তি লেগ স্পেইস মানে লাক্সারি।

তাবাস্কোর সঙ্গে পরিচয়

আসিফ চৌধুরী এয়ার হোস্টেসকে টমেটো জুসের সঙ্গে তাবাস্কো সস মিশিয়ে আনতে বললেন। আমি বললাম, সেই সঙ্গে লেবুর স্লাইস। হোস্টেস যত্নসহকারে সব সরঞ্জাম নিয়ে এলো। জুস আর সস মেশানোর পর তা নাড়া দিতে প্লাস্টিকের একটা কাঠি দিয়ে গেল। ঠিক এই কাজের জন্য কাঠিটা বানানো। বাসায় বা রেস্টুরেন্টে আমরা সাধারণত চামচ দিয়ে নাড়ানোর কাজটা চালাই। তাবাস্কো সস ঢালার পর যখন আমি আরও সস যোগ করতে বললাম, তখন এমিরেটসের রোমানিয়ান এয়ার হোস্টেসের চোখ ছানাবড়া। সে বলল, ‘আর ইউ শিউর! এইটা তাবাস্কো সস। দুনিয়ার মধ্যে সবচে বেশি ঝাল।’

আমি তারপরও তাকে সস যোগ করতে বলছি দেখে সে ঠোঁট উল্টিয়ে পুরো সসের বোতলটা রেখে গেল। ‘যত ইচ্ছা নাও। আমার আর ঢালতে সাহস করছে না।’

বিশ মিনিট পর সেই এয়ার হোস্টেস আবারও এসে হাজির। এসে দেখে আমার গ্লাস খালি। তাবাস্কো সসের বোতল প্রায় শেষ। সে বোধ হয় একটু বিস্মিত হলো। বিশ মিনিটে তাবাস্কোসহ টমেটো জুস আমার গলা দিয়ে নেমে যাবে, এতটা হয়তো সে ধারণা করেনি। ‘আর ইউ ওকেই—

তুমি কি ঠিক আছ।’

আমি বললাম, ‘বিলক্ষণ। আধা ঘণ্টা পর আরও একটা টমেটো জুস দিয়ে যেয়ো। আর সঙ্গে তাবাস্কো সস।’

‘কী বলছ! তাবাস্কো সস তো শেষ করে ফেলেছ প্রায়! আমি আমার লাইফে কাউকে এমন করে এই সস খেতে দেখিনি।’

আমি বললাম, ‘আমি একা না। বন্ধু আসিফ চৌধুরীও নিয়েছে। আর এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। এই প্লেনের প্রায় সব যাত্রীই এমনভাবে খেতে পারবে। আমরা রোমানিয়ান না। বাংলাদেশি।’

‘তাই তো দেখতে পাচ্ছি। যত পারো, খাও। তোমাদেরকে সার্ভ করতে পারলে আমি খুশি হব।’

এয়ার হোস্টেস চলে যাওয়ার পর আসিফ চৌধুরী আমাকে বললেন, ‘দেখলেন! আপনাকে এমন এক ড্রিঙ্কস খাওয়ালাম, এই এয়ার হোস্টেস তো সব জায়গায় এখন এই গল্প বলতে থাকবে। এরা নিজেরা ঝাল খেতে পারে না। অন্য কেউ খেতে পারবে সে বিশ্বাসও করে না।’

আমি একটা বর্ণবাদী মন্তব্য শুনেছি। তাবাস্কো সসের মধ্যে একটা পুরুষালি ভাব আছে। ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের লুইজিয়ানায় তাবাস্কো কোম্পানি প্রতিষ্ঠিত হয়। এই কোম্পানি কেবল তাবাস্কো সস বানাত আর বিক্রি করত। তাবাস্কো একধরনের মরিচ। বাংলাদেশে যে পিচ্চি মরিচ পাওয়া যায়, আকার আকৃতিতে তাবাস্কো পেপার বা তাবাস্কো মরিচ সে রকম দেখতে। আমরা বলি, পিচ্চি মরিচের ঝাল বেশি। তাবাস্কো মরিচ কাঁচা অবস্থায় প্রায় শাদা রঙের হয়। পরে সবুজ ও লাল হয়। কখনো কালো রঙেরও হয়। স্পেনে দেখেছি, লোকজন টবের মধ্যে তাবাস্কোর চারা লাগিয়ে রাখে। লাল সবুজ শাদা কালো মরিচ ধরে থাকে। অনেকটা ডেকোরেশনের কাজ করে।

আসিফ চৌধুরীকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘চিলিতে কি তাবাস্কো মরিচ হয়?’

‘আমি শিউর না। হয় হয়তো।’

‘হয় যে তা নিশ্চিত। সমগ্র ল্যাটিন আমেরিকাতে হয়। তবে বাণিজ্যিকভাবে চাষ হয় কি না, জানি না। শুরুতে তা কেবল লুইজিয়ানার আভেরি দ্বীপে চাষ হতো। বাণিজ্যিক কারণে পরে তা ল্যাটিন আমেরিকা ও আফ্রিকায় ছড়িয়ে পড়ে। আমাদের পিচ্চি মরিচ হয়তো একই প্রজাতির।’

‘বাংলাদেশের নাগা মরিচ তো পৃথিবী বিখ্যাত।’

‘জি। একসময় নাগা মরিচকে সবচে বেশি ঝাল বলে মনে করা হতো।’

তাবাস্কো জনপ্রিয় হয় যুক্তরাষ্ট্রে। বিশেষ করে ল্যাটিন ও হিস্পানিক আমেরিকানদের কাছে। এখন তাবাস্কো সস দুনিয়ার সব দেশেই পাওয়া যায়। ৩৫টি ভাষায় তাবাস্কো সসের লেবেল হয়। বাংলাতেও হয়। গুলশান দুই ডিসিসি মার্কেটের ঢালী সুপার মার্কেট থেকে আমি মাঝেমধ্যে কিনি। আমার বড়ো ছেলে পান্থ তাবাস্কো সসের ভক্ত।

তাবাস্কো মরিচ ছাড়াও এখন হালাপেনো, হাবানেরো, শুকনা হালাপেনো এবং ত্রিনিদাদের মরুগা স্করপিয়ন মরিচ দিয়েও তাবাস্কো সস বানানো হয়। স্করপিয়ন সস সবচে বেশি ঝাল। এমিরেটসে স্করপিয়ন সস থাকে না। ও রকম এক্সট্রিম ক্লায়েন্ট তাদের ফ্লাইটে উঠে পড়বে, হয়তো তারা সে রকম অনুমান করে না। সে জন্য নিজেদের শেলফে কেবল আদর্শ তাবাস্কো মরিচের সস রাখে।

এবার আমি সাহস করে সেই বর্ণবাদী মন্তব্যটা বললাম, ‘মেয়েরা মনে হয় ঝাল সহ্য করতে পারে না। এ জন্য তাবাস্কো সস পৌরুষত্বের সঙ্গে সম্পর্কিত হয়ে গেছে।’

‘মেয়েরা নিজেরাই তো ঝালের ডিব্বা। অন্য ঝাল সেখানে গিয়ে কী করবে! ঝালে ঝাল ক্ষয়!’

আমরা হাসলাম। ছেলেরা ছেলেরা গল্প করলে এমন অনেক মেয়ে-অপ্রিয় কথা উঠে আসে। আসিফ চৌধুরী একটু দম নিয়ে এবারে আমার উদ্দেশে টিপ্পনী নিয়ে এলেন, ‘পৌরুষত্ব বলেছেন না! ভালোই তো। রোমানিয়ান এয়ার হোস্টেস এজন্যই বারবার এসে আপনাকে দেখে যাচ্ছিল।’

‘আমাকে না। আপনাকে। তাবাস্কো সসের অর্ডার আপনিই প্রথম দিয়েছিলেন। আর আপনাকে দেখতে জেমস বন্ড মুভির রজার মুরের মতো লাগে। দি স্পাই হু লাভড মি। অন্তত দুইটা জেমস বন্ড মুভিতে তাবাস্কো সসের উল্লেখ আছে। এ ছাড়া মার্ডার অন দি অরিয়েন্ট এক্সপ্রেস মুভিতে আছে। ব্যাক টু দি ফিউচার মুভিতে আছে।’

আসিফ ভাই সহাস্যে বললেন, ‘ভালো বলছেন। তবে ওই মেয়ে রজার মুরের নাম শুনছে কি না সন্দেহ!’

‘রজার মুর না জানলেও জেমস বন্ডকে জানবে। আচ্ছা, আপনার কি মনে হয় বাংলাদেশে তাবাস্কো মরিচ চাষ করা হলে বাণিজ্যিকভাবে লাভ হবে? রপ্তানি করা যাবে?’

‘হতে পারে। কিন্তু রপ্তানি করবেন কী করে! আমরাই তো খেয়ে শেষ করে ফেলব।’

‘হু। সে সম্ভাবনা আছে। এখন তো আমরা মাঝেমধ্যে মরিচ আমদানি করি। একসময় চা রপ্তানি করতাম। এখন তা-ও আমদানি করি।’

তাবাস্কো সসের স্বাদ মুখে লেগে থাকতে থাকতে দুবাই চলে এসেছি। ওভারনাইট ট্রানজিট আছে। পরদিন সাও পাওলো। লম্বা ফ্লাইট। না জানি কতবার তাবাস্কো সস খেতে হবে! তবে একবার ব্রাজিল পৌঁছে গেলে এমিরেটসকে আপাতত বিদায়। এরপর সাও পাওলো থেকে বোগোটা আর বোগোটা থেকে সান্তিয়াগো যাচ্ছি লান এয়ারলাইনসে। লান এয়ারলাইনস দক্ষিণ আমেরিকার অন্যতম বড়ো এয়ারলাইনস। একসময় তা চিলির সরকারি এয়ারলাইনস ছিল। ১৯৯৪ তে তা বেসরকারি পর্যায়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। শুনেছি, লান কর্তৃপক্ষ ব্রাজিলের ট্র্যাম এয়ারলাইনস কিনে নিচ্ছে। সে ক্ষেত্রে তা দক্ষিণ আমেরিকায় সবচে বড়ো এয়ারলাইনস হয়ে যাবে। এয়ারলাইনস যত বড়োই হোক, এমিরেটসের মতো খাওয়ার বিলাসিতা লান এয়ারলাইনসে নেই।

এক সপ্তা পরের কথা। বোগোটা থেকে আমাদের ফ্লাইট পেরুর রাজধানী লিমা স্পর্শ করে যাবে। লিমায় যাত্রাবিরতি দুই ঘণ্টার মতো। এতে সান্তিয়াগো পৌঁছতে আট ঘণ্টার ধাক্কা। শরীর আর ধকল নিতে পারছে না। লিমা থেকে এয়ারক্রাফটে ওঠার পর এয়ার হোস্টেস যখন খাবার সার্ভ করছে, তখন তাঁকে বললাম ‘চিলি সস’ দিতে। তাবাস্কো থাকবে না, তা ধরেই নিয়েছিলাম। দেখি, এয়ার হোস্টেস হাসছে। প্রথমে বুঝিনি। একটু পর বুঝলাম যখন এয়ার হোস্টেস বলছে, ‘তোমরা চিলি যাচ্ছ। তাই চিলি সস খাচ্ছ!’

আমিও হাসলাম। হুম। আমরা চিলি যাচ্ছি। তবে এই চিলি সেই ‘চিলি সস’ এর চিলি না।

কবিতার দেশ চিলি 

চিলি একটা কবিতার দেশ। এ দেশের মানুষ কেমন করে যেন সব কাব্যিক গুণে বিশিষ্ট। আমরা কেবল পাবলো নেরুদার কথা জানি। তিনি ১৯৭১ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান। এর ২৫ বছর আগে কবি গাব্রিয়েল মিস্ত্রালও সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান। কিন্তু কেবল নেরুদা বা মিস্ত্রাল না, চিলির কাব্যাঙ্গন কবি ও কবিতায় যথেষ্ট সমৃদ্ধ। চিত্রকলায় যদি ফ্রান্স, ভাস্কর্যে ইতালি, ফুটবলে ব্রাজিল আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য সুইজারল্যান্ডের কথা বলি, তবে কবিতার জন্য চিলির কথা বলতে হবে।

চিলি সফরে গিয়ে পাবলো নেরুদার বাড়ি বা জাদুঘর দেখা হয়ে গেছে। কিন্তু সে তো কাব্যাঙ্গনের ক্ষুদ্র এক খণ্ড। কবিদের সঙ্গে ওঠাবসা ছাড়া চিলির কাব্যাঙ্গনের রস অসম্পূর্ণ থেকে যায়। মুশকিল হলো, চিলির কবিরা লেখেন স্প্যানিশে। টুকটাক একটা-দুটো শব্দ বা সৌজন্যমূলক বাক্য বলতে পারলেও সাহিত্য বোঝার মতো স্প্যানিশ বিদ্যা তো আর আমার নেই।

এক সন্ধ্যায় ডিনার টেবলে পরিচয় হয় এক চিলিয়ান সাংবাদিক ও খণ্ডকালীন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সেজারের সঙ্গে। সেজারকেই ধরেছিলাম। চিলির কবিতা সম্পর্কে বিশদ না হোক, যৎকিঞ্চিৎ জ্ঞান অন্তত নিতে চেয়েছি। ইংরেজিতে যেটুকু অনুবাদ পাওয়া যায়, তার এক পরমাণু পরিমাণ উল্টেপাল্টে দেখেছি। আমার ভাষা বাংলা। বাংলা অনুবাদ যদি পেতাম তাতে না হয় দুধের সাধ ঘোলে মিটত। এখন ইংরেজি অনুবাদ হাতে নিয়ে আমার অবস্থা না ঘরকা না ঘাটকা।

সেজার বলল, ‘চিলির কবিতা সম্পর্কে তুমি কি জানো? অর্থাৎ, যদি কিছু মনে না করো, আমাকে একটা ধারণা দাও, তাহলে আমি বুঝতে পারব, কোথা থেকে শুরু করব।’

‘প্রথমে স্বীকার করি, আমি যা জানি তা বলতে লজ্জাই হচ্ছে। পাবলো নেরুদা সম্পর্কে অন্তত জানি। সে বাংলাদেশেও জনপ্রিয়। তাঁর কবিতার বই বাংলায় অনুবাদ হয়েছে। আমার সৌভাগ্য হয়েছে সেগুলো সংগ্রহের। তুমি বললে তাঁর কবিতার দু-একটা লাইন শোনাতে পারব। এর বাইরে মিস্ত্রাল সম্পর্কে কিছু জানি। তবে তা মাত্র চার বছর আগে জেনেছি। তাঁর কবিতার আবৃত্তি শুনেছি খোদ স্প্যানিশে। আমি মাদ্রিদে ছিলাম সে সময়ে। সেই সূত্রে চিলির আরও এক সাম্প্রতিক কবি সম্পর্কে পড়েছি। আলোচনা শুনেছি। ভাসা ভাসা। কবিতাও পড়েছি তাঁর। নিকান্নো পায়রা বা পারা এমন নাম। একটু এন্টি-এস্টাব্লিশমেন্ট টাইপ। আমি জানি না তাঁকে চিনবে কি না। আমি মাদ্রিদে তাঁর নাম শুনেছি। বোদ্ধামহলে উচ্ছ্বাসও দেখেছি।’

সেজার মনে হয় অভিভূত হলো। তাঁর মুখের পুরো অংশেই হাসি ছড়িয়ে পড়েছে। তবে এবারে সে সশব্দে হাসছে না। এ জন্য মনে হলো হাসির গভীরতা বেশি। সে চোখ নাচিয়ে আমার পিঠ চাপড়ে বলল, ‘আমি ইমপ্রেসড। তোমার ভালোই ধারণা আছে।’

আমি তবু লজ্জিত হলাম। বললাম, ‘ছি ছি। কী সব বলো—আমি জানি যে আমি কিছু জানি না।’ সক্রেটিসের প্যারাডক্স, দুজনই হাসলাম। তারপর সেজার শুরু করল তাঁর বয়ান।

চিলির প্রধান কবি সম্ভবত মিস্ত্রাল। গেব্রিয়েলা মিস্ত্রাল। তাঁর কারণে চিলির কবিতা এবং কবিরা পাদপ্রদীপে আসেন। ১৯৪৫ সালে তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান। নেরুদারা তখন তরুণ। মিস্ত্রালের ছায়া তাঁদেরকে বিকশিত হতে সাহায্য করে। এঁদের তালিকা বড়ো। পাবলো নেরুদা ছাড়া আমি কেবল আরও দুজনকে বেছে নিব। ভিসেন্ত উইদোব্রো এবং পাবলো দে রোখা। এই চারজন কবিই বিংশ শতাব্দীতে চিলির কাব্যাঙ্গন আলোকিত করেছেন।

মিস্ত্রাল স্কুলশিক্ষক ছিলেন। নোবেল পুরস্কার পাওয়ার আগে থেকে তিনি চিলিতে প্রতিষ্ঠিত এক কবি। একবার নেফতালি রেয়েস নামের এক অপ্রাপ্তবয়স্ক বালক মিস্ত্রালের কাছে এক কবিতা লিখে নিয়ে আসে। মিস্ত্রাল সেই কবিতা পড়ে মুগ্ধ হয়ে বালকটিকে আশীর্বাদ দেন। ঘটনাক্রমে মিস্ত্রাল যেমন পরবর্তী জীবনে নোবেল পুরস্কার পান, সেদিনের সেই বালক, যিনি পরবর্তী জীবনে পাবলো নেরুদা ছদ্মনামে কবিতা লিখেন, তিনি কেবল নোবেল পুরস্কার না, সমগ্র বিশ্বজুড়ে কাব্যপ্রেমিকদের মন জয় করেন।

মিস্ত্রালকে নিয়ে এই তিনজন কবির মধ্যে কোনো বিরোধ নেই। সবাই তাঁকে সম্রাজ্ঞীর আসনে বসাতে চাইবেন। মিস্ত্রাল, দে রোখা এবং উইদোব্রোর জন্ম ঊনবিংশ শতাব্দীতে আর নেরুদার জন্ম বিংশ শতাব্দীর গোড়ায়। তাঁরা প্রায় সামসময়িক। মিস্ত্রালের পরে নেরুদা নোবেল পুরস্কার পেয়ে যাওয়ায় অন্য দুজনের সঙ্গে তাঁর কাব্য-ঈর্ষাগত রেষারেষি শুরু হয়। তিনজনই কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ছিলেন। অর্থাৎ তিনজনের ধ্যানধারণাই বাম ঘরানার। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময়ে চিলিতে বুদ্ধিজীবী মহলে বামধারা প্রবল ছিল। নেরুদা সরকারি চাকরি করায় অন্য দুজন বরং তাঁকে বুর্জোয়া আখ্যা দেয়। উইদোব্রো নেরুদাকে অভিযুক্ত করেন রবীন্দ্রনাথের কবিতা নকল করার।

আমি হাসলাম। বললাম, ‘রবীন্দ্রনাথের কবিতা নকল করার বিষয়টা আমি অবগত। বাংলাদেশেও কবি এবং বোদ্ধাদের মধ্যে এই নিয়ে বিতর্ক বা আলোচনা হয়। আমি দুজনের কবিতা দুটি পড়েছি। নেরুদার সেই কবিতার বাংলা অনুবাদও আমি পড়েছি।’

‘ও হ্যাঁ। রবীন্দ্রনাথ তো তোমাদের কবি। নাকি ইন্ডিয়ার?’

‘রবীন্দ্রনাথ আমাদের কবি। বাংলা ভাষায় লিখেছেন। যখন জন্মেছেন বা মারা গেছেন তখন আমাদের দাবি করাটা সহজ ছিল। তাঁর পৈতৃক ভিটা কলকাতায়, যা এখন ইন্ডিয়ার সীমানাভুক্ত। কিন্তু তাঁদের জমিদারি ছিল আমাদের অংশে, যেখানে কর্মসূত্রে রবীন্দ্রনাথকে অনেক বছর থাকতে হয়েছে। এখন সে দুই বাংলায়, বা দুই দেশেই সমাদৃত। আমরা কিন্তু তাঁকে জাতীয় কবি বলি না; বলি, বিশ্বকবি।’

‘তুমি কি মনে করো নেরুদা রবীন্দ্রনাথকে নকল করেছে?’

‘বড়োদের ব্যাপার। আমি আর নাক না গলাই। তবে শুনেছি নেরুদা নিজেই একপ্রকার প্রচ্ছন্ন স্বীকারোক্তি দিয়েছেন। বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথের কবিতার স্প্যানিশ ভার্সন যিনি করেছেন সেই হুয়ান রামোন যখন নেরুদার সমালোচনা করেছেন, তখন নেরুদা হাস্যচ্ছলে বলেছিলেন, ‘বাহ্। এমন কথা বললে আমার বইয়ের কাটতিই কেবল বাড়বে।’

আমি শুনেছি, যদিও নিজে দেখিনি, ১৯৩৫ এর এক সংস্করণে নাকি পাবলো নেরুদা আলোচ্য কবিতাটির নিচে পাদটীকায় বলেছেন যে তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা দিয়ে প্রভাবিত হয়ে ওই কবিতাটি লিখেছেন। উইদোব্রোও একসময় বেশি বাড়াবাড়ির জন্য নিজের ত্রুটি স্বীকার করেছেন।

রাতে হোটেলে ফিরে আমি ইন্টারনেট [১] ঘেঁটে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং পাবলো নেরুদা—দুই সময়ের, দুই মহাদেশের, দুই ভাষার এই দুই মহান কবির কবিতার মিল নিয়ে একটা স্পষ্ট ধারণা নেওয়ার চেষ্টা করি।

চলনবিলে ঝড়ের মুখে, ১৮০৮ সালে নৌযাত্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একটি গান রচনা করেন। রচনার পর বিভিন্ন সময়ে গানের দু-একটা শব্দ বদলে যায়। কিছু কিছু রবীন্দ্রনাথ নিজে বদলান। কিছু অন্যান্য কারণেও বদলায়। যেমন হেমন্ত মুখার্জি যখন এই গানটি তোলেন তখনো কয়েকটা শব্দ বদলে যায়। গানটি স্বরবিতানের ১০ নম্বর গান। গানটির প্রথম কয়েকটি লাইন—

“তুমি সন্ধ্যার মেঘমালা, তুমি আমার সাধের সাধনা, মম শূন্যগগনবিহারী।

আমি আপন মনের মাধুরী মিশায়ে তোমারে করেছি রচনা-

তুমি আমারি, তুমি আমারি, মম অসীমগগনবিহারী।।”

রবীন্দ্রনাথ নিজে এর ইংরেজি অনুবাদ বা ভাবানুবাদ করেন। প্রকাশ করেন ‘গার্ডেনার’ গ্রন্থের ৩০ নম্বর কবিতা হিসেবে। গার্ডেনার হলো মালঞ্চ কাব্যগ্রন্থের ইংরেজি অনুবাদ। অনুবাদ গ্রন্থটি ১৯১৫ সালে প্রকাশিত এবং কবি ডব্লিউ বি ইয়েটসকে উৎসর্গ করা।

‘ইউ আর দি ইভনিং ক্লাউড ফ্লোটিং ইন দি স্কাই অব মাই ড্রিমস।

আই পেইন্ট ইউ এন্ড ফ্যাশন ইউ এভার উইথ মাই লাভ লঙ্গিংস।

ইউ আর মাই ঔন, মাই ঔন, ডুয়েলার ইন মাই এন্ডলেস ড্রিমস!’

হুয়ান রামোন হিমেনেছ এবং তাঁর স্ত্রী সেনোবিয়া এই কাব্যগ্রন্থের স্প্যানিশ অনুবাদ প্রকাশ করেছেন ১৯১৭ সালে। পাবলো নেরুদা কবিতাটি পড়ে থাকলে হয়তো এই অনুবাদ পড়ে থাকতে পারেন যা ওই সময়ের মধ্যে দুটি ভাষা ঘুরে অনূদিত হয়েছে। অর্থাৎ আদি রচনা থেকে এমনিতেই অনেকখানি পরিবর্তিত হয়ে গেছে। অথবা খুব বেশি হলে নেরুদা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ইংরেজি অনুবাদটি পড়েছিলেন।

হুয়ান রামোন ও সেনোবিয়া স্প্যানিশ অনুবাদটি ইংরেজি ভার্সন থেকে করেছিলেন। না হুয়ান জানতেন বাংলা, না নেরুদা। স্প্যানিশ ভার্সনটি দেখলে আমার তা ইংরেজি শব্দ ও শব্দগঠনের হুবহু অনুবাদ মনে হয়। ‘তুমি আমার, তুমি আমার’ জায়গাটিকে হুয়ান রামোন লিখেছেন ‘এরেস মিইয়া, এরেস মিইয়া।’ পাবলো নেরুদাও ‘এরেস মিইয়া, এরেস মিইয়া’ লিখেছেন, কিন্তু সঙ্গে কিছু বিশেষণ যেমন ‘মুখের দে লাবিওস ডুলচে—মিষ্টি ঠোঁটের বালিকা’ যোগ করে কবিতাটিকে আরও বেশি প্রেম বা প্রেমিকাঘনিষ্ঠ করেছেন।

যদি রবীন্দ্রনাথের ইংরেজি ভার্সনের সহজ বাংলা অনুবাদ করি, তাহলে প্রথম স্তবকটি এমন হবে—

‘আমার স্বপ্নের আকাশে তুমি সন্ধ্যার ভেসে যাওয়া মেঘ।/ আমার প্রেম ক্ষুধা দিয়ে তোমাকে আঁকি আর সাজাই।/ তুমি আমার, তুমি আমার, আমার অনন্ত স্বপ্নের বাসিন্দা।’

নেরুদার কবিতাটির প্রথম স্তবকটির স্প্যানিশ এবং ইংরেজি ভার্সন দুটো মিলিয়ে বাংলা অনুবাদ করি, তবে তা এমন শোনাবে-

‘আমার গোধূলি আকাশে তুমি একটা মেঘের মতো/ তোমার আকার (দেহ) আর রঙ এমন যা আমি ভালোবাসি।/ তুমি আমার, তুমি আমার, মিষ্টি ঠোঁটের বালিকা,/ তোমার জীবনের মধ্যে আমার অসীম স্বপ্ন বাস করে।’

ওস্তাদেরা এমনই। মেধাবীরা এমনই। তাঁরা একটা বাক্যই বহুভাবে বলতে পারেন। বহু রঙে রাঙাতে পারেন। বহু বাঁক আর মোড় নিয়ে আসতে পারেন। রবীন্দ্রনাথ নিজেও করেছেন। কাজী নজরুল ইসলামের গান নিজের মতো করে রূপান্তর করেছেন। অবশ্য শিষ্যের অনুমতি নিয়েই। আমাদের এতে ক্ষতি নেই। আমরা এতে নতুন নতুন রস পাই।

পাবলো নেরুদা ১৯২৪ সালে প্রকাশ করেছেন তাঁর দ্বিতীয় কবিতার বই—‘বিশটি প্রেমের কবিতা এবং একটি বিষাদের কবিতা’। তখন তাঁর বয়স মাত্র ১৯। আলোচ্য কবিতাটি সেই বইয়ের ষোলো নম্বর কবিতা। এই বইটিই তাঁকে প্রথমবারের মতো কবি হিসেবে চিলিতে প্রতিষ্ঠা দেয়। তরুণ এক কবি যদি রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টির সাক্ষাৎ পান, তবে তাতে মজে যাবেন, তাঁর দ্বারা প্রভাবিত হবেন, এই-ই স্বাভাবিক।

বিষয়টি শেষ করার আগে দুই মহীয়ষীর কবিতা দুটির শেষ দুই লাইনে চলে আসি। রবীন্দ্রনাথ সমগ্র গানটির রস বিঘ্ন না করে শেষ করেছেন-

“মম সঙ্গীত তব অঙ্গে অঙ্গে দিয়েছি জড়ায়ে জড়ায়ে-

তুমি আমারি, তুমি আমারি, মম জীবনমরণবিহারী।।”

পাবলো নেরুদা সেখানে রসের পরিবর্তন এনেছেন। প্রেমঘনিষ্ঠ একটা কবিতার শেষে জন্ম-মৃত্যুর চিরায়ত দর্শন এনে বিষয়টাকে ভারী করেছেন। স্প্যানিশ ও ইংরেজি ভার্সন অনুসরণ করে পাবলো নেরুদার কবিতাটির আমার অনুবাদ এ রকম-

‘আমার আত্মা জন্মেছে তোমার শোকার্ত চোখের সৈকতে।/ তোমার শোকার্ত চোখে শুরু (আমার) স্বপ্নের দেশ।’

এবারে সেজারের সঙ্গে আলাপে ফিরে আসি। পাবলো নেরুদা থেকে সেজার বরং ভিসেন্ত উইদ্রোবোকে নিয়ে বেশি উচ্ছ্বসিত। ‘নেরুদা কবি পরিচিতি পাওয়ার আগে মিস্ত্রাল আর উইদ্রোবো বেশি জনপ্রিয় ছিল। তাঁর কবিতা পড়ে দেখো। দেখবে, নেরুদা থেকে উইদ্রোবো অনেক বেশি তীক্ষ্ণ। অনেক বেশি মেধাবী।’

‘আফসোস তো এখানেই। ইংরেজি কবিতাই অর্ধেক বুঝি। স্প্যানিশ কবিতার স্বাদ নিতে গেলে আমার আরেক জন্ম লাগবে।’

‘উইদ্রোবো অনেক ভাষাতেই অনূদিত হয়েছে। ইংরেজিতে বিস্তর হয়েছে। বাংলা ভাষার ব্যাপারে বলতে পারব না। যদি সুযোগ পাও, তাঁর আলতাজর কবিতাটি পড়ে দেখো। জগদ্বিখ্যাত শিল্পী পাবলো পিকাসো এর অলঙ্করণ করেছেন।’

‘কী বলো? পিকাসো! ওয়াও। তোমার কথাই শিরোধার্য ছিল। এবারে পিকাসোর কথা বলায় আলতাজরকে আর হেলাফেলা করা যাচ্ছে না।’

আমি বহুদিন ইন্টারনেটে উইদ্রোবো আর আলতাজর খুঁজেছি। বাংলাদেশে না হোক, পশ্চিমবঙ্গ বা অন্যত্র যদি কেউ বাংলায় অনুবাদ করে থাকেন। সান্তিয়াগো বইয়ের দোকানে আলতাজর চোখের সামনেই থাকে। আলতাজর একটা কবিতা। একটা কবিতা দিয়েই গোটা একটা বই। বাংলাদেশে সৈয়দ শামসুল হক লিখেছেন ‘বৈশাখে রচিত পঙ্ক্তিমালা’—এক পঙ্ক্তিমালাতে গোটা বই। আলতাজরও তেমন। উল্টেপাল্টে সেখানে পিকাসোর অলঙ্করণ দেখেছি। এরপর একদিন বিডিনিউজ২৪ ডটকমে আলতাজরের একাংশের অনুবাদ পেলাম। আমি তাঁর থেকে এক খণ্ড তুলে দিচ্ছি।

‘তোমার চোখেই আমার গৌরব

অন্তর্গত উজ্জ্বলতায় দীপ্যমান তোমার রাজকীয়তায় আমি সজ্জিত

আমি বসে থাকি তোমার চাহনির সবচেয়ে সংবেদনশীল কোণে

তোমার পতনহীন অক্ষিপক্ষের স্থির নির্জনতায়

তোমার চোখের গভীর থেকে উঠে আসছে অশুভ সংকেত

এবং সমুদ্রবাতাস ছোট্ট ঢেউ তুলছে তোমার চোখের আইরিসে

তোমার ফেলে আসা বীজপত্রের আখ্যান তুলনাহীন

সেই কণ্ঠস্বরে, উজ্জীবিত করার লক্ষ্য, খুঁজে ফিরছি মৃত নক্ষত্র

তোমার কণ্ঠস্বর মহাকাশে গড়ে তুলছে সাম্রাজ্য

এবং সেই উত্তোলিত হাত যেন ধরে রেখেছে বাতাসে ঝুলন্ত সূর্য

এবং সেই চাহনি অসীমে লিখে রাখছে এই বিশ্ব

এবং সম্মুখে আনত তোমার মাথা শুনছে মহাকালের গুঞ্জন

এবং উঁচুনিচু রাস্তায় তোমার পদক্ষেপ যেন এক উৎসব

বিদ্যুতের চমক তোমার চোখের পাতায় ভর করে নেমে আসে মাটিতে

এবং এই চুম্বন তোমার রঙধনুময় ঠোঁটে এঁকে দিচ্ছে স্ফীতি

এবং সেই হাসি তোমার জীবনের সম্মুখে হয়ে উঠছে ব্যানার

এবং সেই রহস্য যা তোমার হৃদয়ের স্পন্দনকে বয়ে নিয়ে যায়

তা তোমার স্তনের ছায়ায় ঘুমিয়ে থাকে

যদি তুমি মারা যেতে

তাহলে, তাদের প্রজ্জ্বলিত প্রদীপ সত্ত্বেও

এইসব নক্ষত্র হারিয়ে ফেলবে তাদের পথ

কী হয়ে উঠবে তখন এই মহাবিশ্ব?’[২]

সেজারকে আন্তরিক ধন্যবাদ। এক বসাতে এত কিছু জেনে নিতে পারব, আশা করিনি। কিন্তু সেজার ধন্যবাদ পেয়েও আমাকে ছাড়েনি। সে বলল, ‘আরে, কবিতার তো কিছুই বলা হয়নি। একজন দুজন কবির কথা শুনে তুমি তো আর চিলিকে কবিতার দেশ বলবে না।’

আমি বললাম, ‘একজন চিলিয়ান হয়ে কবিতার প্রতি তোমার যে অনুরাগ দেখছি, তাই তো বলে দেয় তুমি কবিতার দেশেরই মানুষ।’

সেজার খুশি হলো। বলল, ‘ওই যে মাদ্রিদে এক চিলিয়ান কবি সম্পর্কে তোমার অভিজ্ঞতা বলছিলে। আমি তখন তোমাকে থামাইনি। সেই কবির নাম নিকানোর পাররা।’

‘সরি। আমি নামটা পুরোপুরি মনে রাখতে পারিনি। নিকানোর পাররা! এখন মনে থাকবে।’

‘নিকানোর পাররা এন্টি-এস্টাব্লিশমেন্ট কবি। তাঁর লিখাকে তিনি এন্টি-পোয়েম বলে থাকেন। সোজাসাপ্টা, খোলামেলা, প্রতিবাদী। মূলত তিনি বিজ্ঞানী বা বিজ্ঞানের শিক্ষক। তাঁর পারিবারিক বলয় শিল্প-সংস্কৃতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত হওয়ায় তিনি একসময় কবিতার সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলেন। নোবেল পুরস্কারের জন্য বেশ কয়েকবার নমিনেশন পেয়েছেন। কিন্তু শিকে ছেঁড়া হয়নি। তবে তিনি এ মুহূর্তে চিলি বা সমগ্র ল্যাটিন আমেরিকার সবচেয়ে প্রভাবশালী ও সম্মানীয় কবি।’

সেজার আর কথা বাড়াতে পারে না। আমাদের ডিনার শেষ। সবাই উঠে দাঁড়িয়ে গেছে। সেজারও ‘আদিয়োস’ বলে বিদায়ের জন্য তৈরি হলো।

নিকানোর পাররা লিখে ইন্টারনেটে ব্রাউজ করে বেশ কিছু কবিতা পেলাম। বাংলায় প্রায় নেই বললেই চলে। স্প্যানিশে আছে। ইংরেজি অনুবাদও আছে। তাঁর কবিতা বাংলায় অনুবাদ করলে এমন হতো—

‘আমাদের পূর্বসূরিদের জন্য কবিতা ছিল বিলাস বস্তু।/ আমাদের জন্য কবিতা এক মৌলিক রসদ।/ কবিতা ছাড়া আমরা বাঁচি না।’

নিকানোর পাররা পড়তে গেলে বারবার হোঁচট খেতে হয়। তাঁর সমস্ত রাগ কবিতায়। তাঁর কবিতা মানে বড়ো ধরনের ঝাঁকি।

‘আমি নৈরাজ্যবাদীর চেয়ে বেশি দাদাবাদী।

আমি সামাজিক গণতন্ত্রীর চাইতে বরং নৈরাজ্যবাদী।

আমি স্ট্যালিনবাদীর চাইতে বরং বেশি সামাজিক গণতন্ত্রী।

আমি না ডান, না বাম।

আমি বরং সব ভাঙ্গার দলে।’

[আর্টিফ্যাক্টস, চিলি ১৯৭২]

শুধু চিলি না, সমগ্র ল্যাটিন আমেরিকায় নিকানোর পাররা একজন প্রভাবশালী কবি। স্পেনেও তাঁর প্রভাব বা জনপ্রিয়তা আমি দেখেছি। তিনি নাকি কোথাও বক্তৃতা দিলে বা কবিতা পড়ার পর বলতেন, ‘আমি যা বলেছি, তা আমি বলিনি। আমি যা বলেছি, তার সব ফিরিয়ে নিচ্ছি—মে রেত্রাক্তো দে তদো লো ডিচ্চো।’[৩]

কবি আর কবিতা নিয়ে পড়লে দিনরাত সব একাকার হয়ে যাবে। সব সুন্দরেরই একটা সীমারেখা থাকে। সেজারের সঙ্গে কাব্যময় একটা সন্ধ্যারও তাই ইতি টানা জরুরি হয়ে পড়ে। আমরা পরস্পরের সুস্বাস্থ্য কামনা করলাম। আরও একটা ইচ্ছা দুজনই ব্যক্ত করলাম। দুজনই হয়তো জানি, দ্বিতীয় ইচ্ছাটি পূরণ হওয়া অত সহজ না। তবু স্প্যানিশ কায়দায় ‘আদিয়োস’ বলে বিদায় নেওয়ার পরও আবার ফরাসি কায়দায় বললাম, ‘আ রিভোয়া’—অর্থাৎ আবার দেখা হবে।

রেস্টুরেন্ট থেকে এরপর সোজা হোটেল। প্লাজা সানফ্রান্সিস্কো। হোটেলের উত্তর দিকটায় আমার রুম। বার্নার্ডো ও’হিগিন্স অ্যাভিনিউর সঙ্গে সমান্তরাল। রাত অনেক হয়েছে। অ্যাভিনিউ খুব আলোকিত। কিন্তু একেবারে ফাঁকা। শেষ একটা গাড়ি কখন দেখেছি বলতে পারব না। রাস্তার আলোর রং সোনালি। সেই সোনালি আলোয় সান্তিয়াগোকে বেশ মায়াবী লাগছে। লম্বা এক চিলতে দেশ চিলি। প্রশান্ত মহাসাগর থেকে বড়ো কোনো জলোচ্ছ্বাস এলে আন্দিজ পর্বত পর্যন্ত সমগ্র চিলি ধুয়ে যাবে। এই দেশে মরুভূমি আছে। সবুজ শ্যামল শস্যখেত আছে। রঙিন ফুল আর মৌমাছি ভরা আদিগন্ত বন আছে, তুষারে সারা বছর আবৃত থাকে এমন অঞ্চল আছে। পেঙ্গুইনরা খেলা করে তুষারাবৃত দ্বীপে। পাহাড়ের উপত্যকায় সারি সারি জলপাই বা আঙুরগাছের বাগান। মৌসুমে সেই আঙুর থেকে মদিরা তৈরি হয়। সাগরের পানি এসে নিত্য দীর্ঘ সৈকত চুম্বন করে যায়। এই দেশই যে কবিতার দেশ হবে, তা বলা বাহুল্য।

আমার রাত আরও গভীর হচ্ছে। চারপাশের নির্জনতা স্থবির করে দিচ্ছে প্রকৃতিকে। স্প্যানিশ ভাষা ভালোমতো জানলে এখন মিস্ত্রাল বা নেরুদা, উইদ্রোবো বা নিকানোরের কবিতা পড়তে পারতাম। বাংলা ভাষায় রাত, অন্ধকার, চাঁদ আর জ্যোৎস্না নিয়ে অসাধারণ কবিতা আছে। ভাবলাম, আমি হয়তো পারব না, কিন্তু কোনো দিন কেউ কি জীবনানন্দ দাশকে স্প্যানিশে অনূদিত করবেন! সে রকম হলে দেখতাম চিলি বা স্প্যানিশ ভাষাভাষী দেশগুলোর অধিবাসীরা কখনো বাংলাদেশকে কবিতার দেশ বলে কি না! 

লেখক: সাবেক রাষ্ট্রদূত ও কূটনীতিক

Sangbad Sarabela

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী আবু জাফর

যোগাযোগ: । 01894-944220 । [email protected], বিজ্ঞাপন: 01894-944204

ঠিকানা: বার্তা ও বাণিজ্যিক যোগাযোগ : বাড়ি নম্বর-২৩৪, খাইরুন্নেসা ম্যানশন, কাঁটাবন, নিউ এলিফ্যান্ট রোড, ঢাকা-১২০৫।

আমাদের সঙ্গে থাকুন

© 2024 Sangbad Sarabela All Rights Reserved.