কীর্তিমান লোকের মৃত্যু নেই, তেমনি শেষও নেই; কারণ এই পৃথিবীতে সে নিজস্ব কীর্তির মহিমায় লাভ করে অমরত্ব। কীর্তিমানের মৃত্যু হলে তাঁর দেহের ধ্বংস হয় বটে কিন্তু তাঁর সৎ কাজ এবং অম্লান-কীর্তি পৃথিবীর মানুষের কাছে তাঁকে বাঁচিয়ে রাখে। তাঁর মৃত্যুর শত শত বছর পরও মানুষ তাকে স্মরণ করে। তেমনই এক কীর্তিমান মানুষ- বরেণ্য পরমাণু বিজ্ঞানী ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়া। নিভৃত পল্লীতে তাঁর জন্ম হলেও তিনি তাঁর মেধা, মনন ও কর্মে নিজেকে কীর্তিমান হিসেবে গড়ে তুলেছেন। নিজেকে মেলে ধরেছিলেন দেশের গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে।
তিনি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জামাতা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বামী, ডিজিটাল বাংলাদেশের রূপকার তথ্যপ্রযুক্তিবিদ সজিব ওয়াজেদ জয় ও বিশ্ব অটিজমের কিংবদন্তি সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের বাবা। আজ ৯ মে বাংলাদেশের এই খ্যাতনামা পরমাণু বিজ্ঞানী চিরঞ্জীব ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়ার ১৪তম মৃত্যুবার্ষিকী। আজকের এই দিনে কীর্তিমান এই মানুষটিকে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা। হে প্রিয়, আবার আসো ফিরেÑ আমাদের মাঝে। আমাদের বাংলায়। তুমি নেই, এ যেমন ধ্রুব সত্য আবার তোমার সৃষ্টি, তোমার কর্ম দেখলেই মনে হয়; তুমি আছো; তুমি রবে আমাদেরই মাঝে; আমাদের হৃদয়ে।
ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়া সম্পর্কে মূল্যায়ন করতে গিয়ে বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী এমপি বলেছিলেন, ড. ওয়াজেদ মিয়া শিক্ষা ও কর্মজীবনের সর্বত্রই মেধার স্বাক্ষর রেখেছেন। তিনি প্রত্যন্ত পীরগঞ্জ থেকে উঠে এসে দেশের সীমানা ছাড়িয়ে নিজস্ব সততা, নিষ্ঠা ও কর্ম দক্ষতার দ্বারা পরমাণু বিজ্ঞানে অবদান রাখায় আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে সুনাম অর্জন করেছেন। ওয়াজেদ মিয়া তাঁর আদর্শ, মূল্যবোধ এবং কর্মের মাধ্যমে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
ওয়াজেদ মিয়া সম্পর্কে মূল্যায়ন করতে গিয়ে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. এ এফ এম মিজানুর রহমান বলেন, ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়া বাংলাদেশের অন্যতম খ্যাতিমান পরমাণু বিজ্ঞানী হিসেবে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনে চেয়ারম্যানের পদ অলঙ্কৃত করেছিলেন। তিনি একজন নিরলস বিজ্ঞান গবেষক হিসেবে আবিষ্কার এবং বিজ্ঞানমনস্ক চিন্তাচেতনার মধ্যদিয়ে বাংলাদেশ তথা বিশ^মানবতার কল্যাণ সাধন করেছেন। এছাড়াও বিজ্ঞানজীবী সংগঠন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এ দেশের বিজ্ঞান গবেষণা ও সমগ্র বিজ্ঞানীর জীবনমান উন্নয়ন সাধন করেছেন।
পরমাণু বিজ্ঞানকে এ দেশের মানুষের সার্বিক কল্যাণে পরমাণু শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহার নিশ্চিতকল্পে তিনি নিরলসভাবে কাজ করে গেছেন। সাভারের গণকবাড়িতে পরমাণু গবেষণা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা ও দেশের বিভিন্ন হাসপাতালের সঙ্গে পরমাণু চিকিৎসা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা তাঁর প্রচেষ্টার একটি অন্যতম প্রতিফলন। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ ছিল তাঁর চিরস্বপ্ন।
ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়াকে নিয়ে সম্প্রতি গবেষণা করেছেন, পিএইচডি গবেষক আসাদুজ্জামান। তিনি তাঁর প্রকাশিত ‘বিশিষ্ট পরমাণু বিজ্ঞানী ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়ার কর্মময় জীবন’ গ্রন্থে লিখেছেন, দেশে পড়াশোনার পাঠ শেষ করে সুদূর লন্ডনের ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। আনবিক গবেষণায় তিনি সারা জীবন নিজেকে নিবিষ্টভাবে যুক্ত রেখেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর আদর্শে আকৃষ্ট হয়ে তিনি ১৯৬১ সালে ছাত্রলীগে যোগদান করেন এবং ফজলুল হক মুসলিম হল ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন। তিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধুর আদর্শে উজ্জীবিত ও অনুপ্রাণিত একজন ছাত্রনেতা। তিনি ১৯৬৭ সালে শেখ হাসিনার সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধসহ বিভিন্ন সংকটে বঙ্গবন্ধু পরিবার এবং ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের ভয়াবহ ও পৈশাচিক হত্যাকাণ্ডের পর বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যাকে আগলে রাখেন। তিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধুর পরিবারের একমাত্র নিরাপদ আশ্রয়স্থল। আপন মেধা, বিচক্ষণতা আর ধৈর্যের সঙ্গে তিনি সব সমস্যার মোকাবিলা করেছিলেন আর আবর্তিত হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু পরিবারে ছায়ার মতো। তিনি ছিলেন নিঃস্বার্থ ও নির্মোহ চরিত্র মাধুর্যের অধিকারী বহুমাত্রিক গুণে গুণান্বিত একজন ব্যক্তিত্ব।
তিনি কেন কীর্তিমান
একজন প্রতিথযশা বিজ্ঞানী হিসেবে তিনি অনেক আঞ্চলিক, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিজ্ঞানবিষয়ক সম্মেলনে যোগদান করেছেন। তাঁর অনেক গবেষণামূলক ও বিজ্ঞানবিষয়ক প্রবন্ধ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা এবং সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর জীবনবৃত্তান্ত আন্তর্জাতিক মাধ্যম
1. `World Men of Achievment (1990)' by International Biographical Centre, Cambridge, U.K./ 2. Who's Who in the World (1994, 1995 and 1997)./ 3. Reference Asia: Asia's Who's Who of Man and Women of Achievement (Vol. IX, 1995)./ 4. Dictionary of International Biography (25th and 26th Edition) by IBC, Cambridge, U. K./ 5. `Asia/Pacific- Who's Who (1997, New Delhi, India./ 6. Specil Publication og Bangla Academy in 1997./ 7. Who's Who's Who in Science and Engineering (4th Edition) (1998-99)./ 8. `Man of The Year' 1998 by the American Biographical Institute, Inc., U.S.A./ 9. `The 2000 Millennium Medal of Honor' by the American Biographical Institute, Inc., U.S.A. প্রকাশিত হয়।
জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি এগ্রিকালচার এডুকেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন। কৃষিনির্ভর এই দেশের কৃষকের উন্নয়নে প্রতিষ্ঠিত এই সংস্থাটির তিনি ট্রেডমার্ক, কপিরাইট ও নিবন্ধন সবই করেছেন। অবসর জীবনে এনজিও পরিচালনার ইচ্ছে পোষণ করেন এবং এনজিও প্রতিষ্ঠার নির্দেশ দেন। BADSA অর্থাৎ ‘বাংলাদেশ উন্নয়ন ও সেবা সংঘ’ নামে একটি এনজিও গঠন করেন। নানা ব্যস্ততার কারণে এর কার্যক্রম চালানো তারপক্ষে সম্ভব হয়নি। ১৯৯৯ সালে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের পর তিনি বাংলাদেশের মালিকানায় পরিচালিত একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে জীবিকা নির্বাহ করেন। যদিও তাঁর স্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা সে সময় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন।
কর্মক্ষেত্রে ওয়াজেদ মিয়ার অবদান
বাংলাদেশের নানা প্রেক্ষাপট ও উত্থান-পতনের মাঝেও অটল ছিল তাঁর জ্ঞান ও বিজ্ঞানের আলো এবং আদর্শ। তিনি তাঁর জীবনে বিজ্ঞান সাধনায় যে চিন্তা ও চেতনার জন্ম দিয়েছিলেন, তা জাতির কল্যাণে প্রয়োগের একান্ত প্রয়াস দেখিয়েছেন। পরমাণবিক জ্ঞান বিকাশের মাধ্যমে জাতীয় জীবনের সমস্যা নিরসন করতে সবসময় ব্রত ছিলেন।
গবেষণাক্ষেত্রে ওয়াজেদ মিয়ার অবদান
ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়া একজন প্রতিভাবান বিজ্ঞানী ও গবেষক। তিনি তাঁর মেধাকে চার দেয়ালের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে তা ছড়িয়ে দিয়েছেন। তিনি কণাবিজ্ঞানে এমএমসি করেছেন পদার্থবিজ্ঞানের তৎকালীন শিক্ষক প্রফেসর ড. হারুন-অর রশীদের তত্ত্বাবধানে। ‘নিউক্লিয়ার অ্যান্ড হাই এনার্জি পার্টিকল’ বিষয়ে তাঁর পিএইচডি ডিগ্রি। এছাড়াও রিঅ্যাক্টর ফিজিক্স, অতি পরিবাহী, তড়িৎ চৌম্বকত্ব ইত্যাদি বিষয়েও তিনি একজন পথিকৃৎ ছিলেন।
পদার্থবিজ্ঞানে তাঁর অবদান চিরকালই অমর হয়ে থাকবে। ৭৫-এর ১৫ আগস্টের পর নির্বাসিত জীবনযাপনকালে তিনি পদার্থবিজ্ঞানের ওপর যে বইগুলো রচনা করেছেন তা দেশে ও বিদেশে পাঠকদের কাছে দারুণভাবে সমাদৃত। পদার্থবিজ্ঞানের ওপর রচিত গ্রন্থগুলো হলো: Fundamentals of Electromagnetics, Fundamentals of Thermodynamics, Elementary Nuclear and Reactor Physics, Some Thoughts on Science and Technology, Basics of Superconductivity, properties of Semi-conductors. Ges Properties of Dielectric and Magnetic Materials.
জীবন চরিত
বাংলাদেশে স্বল্পসংখ্যক বিজ্ঞানীর জন্ম হয়েছে। তাদের মধ্যে মৌলিক চিন্তার অধিকারী ছিলেন খুবই কম। কিন্তু ড. ওয়াজেদ মিয়া ছিলেন তাদের অন্যতম। তিনি মৌলিক চিন্তাকে বিষয়কেন্দ্রিকভাবে সুবিন্যস্ত করেছিলেন। তাই তাঁর লেখনিতে অনুসন্ধিৎসু আলো ফেলতেন। যে আলো আজো ছড়িয়ে পড়ছে। ড. ওয়াজেদ মিয়ার শৈশব, কৈশোর ও যৌবন অতিক্রান্ত হয় রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার ভিতর দিয়ে। দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধ চলাকালীন তাঁর জন্ম। তিনি যখন শিশু তখন হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ব্যাপক বীভৎস রূপ লাভ করেছিল। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতা ডালপালা ছড়াতে শুরু করে, ঠিক তখনই তিনি শৈশব অতিক্রম করেন। এমন সময় তাঁর বিকাশ ঘটে।
শৈশব থেকেই ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়া ছিলেন একজন নীতিবান, সৎ, সহজ-সরল, দৃঢ়চেতা, যুক্তিবাদী, আদর্শবান, মানবতাবাদী, চরিত্রবান, ভদ্্র, বিনয়ী ও একজন খাঁটি দেশপ্রেমিক মানুষ। ছোটবেলায় তাঁর বিজ্ঞানমনস্ক চিন্তা-ভাবনার প্রকাশ ঘটেছিল, যা আলোড়িত করেছিল তাঁর পারিপার্শ্বিকতাকে। পরবর্তী সময়ে পেশায় একজন নিষ্ঠাবান পরমাণু বিজ্ঞানী পরিচয়ে যেমন ভাস্বর ছিলেন, তেমনি ব্যক্তিগত সততা, চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ও মাধুর্যে ছিলেন অনন্য।
রাজনৈতিক দর্শন
১৯৫৮ সালের অক্টোবর মাসে জেনারেল আইয়ুব খান ক্ষমতা গ্রহণ করে সারা পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি করে এবং সমস্ত রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করে দেয়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ অনেক ছাত্র নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়। এরই ফলশ্রুতিতে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড প্রায় স্তিমিত হয়।
১৯৬০ সালের শেষের দিকে জেনারেল আইয়ুব খান ‘Basic Democracy’ নামে রাজনৈতিক পদ্ধতি চালু করার প্রস্তুতি গ্রহণ করে এবং এ পদ্ধতির আওতায় শুধু ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য ও চেয়ারম্যানদের রাষ্ট্রের কার্যনির্বাহী রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করবে। আইয়ুব খানের ওই অগণতান্ত্রিক স্বৈরাচার শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তনের অনৈতিক প্রস্তুতি এম এ ওয়াজেদ মিয়ার বিবেককে প্রতিবাদী করে তোলে; যার ফলে তিনি ছাত্র রাজনীতি ও ছাত্র আন্দোলনে নিজেকে নিবেদিত করেন। একসময় শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক আদর্শের প্রতি গভীরভাবে আকৃষ্ট হন এবং ছাত্রলীগে যোগ দেন।
১৯৫৯ সালে রাজনৈতিক পরিবেশ ফিরে আসে। তখন বিশ^বিদ্যালয়ের সব হলকে একসঙ্গে ছাত্র সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের অনুমতি প্রদান করা হয়। সে সময় একমাত্র ফজলুল হক হলটি ছাত্রলীগের দুর্ভেদ্য ঘাঁটি বলে খ্যাত ছিল। এছাড়া ঢাকা হল, জগন্নাথ হল, রোকেয়া হল, ইকবাল হল ছিল ছাত্র ইউনিয়নের ঘাঁটি। তখন অন্য হলে ছাত্রলীগের বেশ সমর্থক থাকলেও তাদের একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল না। ১৯৬০ সালের অক্টোবর মাসে ফজলুল হক হলে ছাত্রলীগ ও ছাত্র ফেডারেশনের নেতাদের মধ্যে ছাত্র ইউনিয়নের বিরুদ্ধে যৌথভাবে নির্বাচন করার আলোচনা চলছিল। অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি হঠাৎ একদিন ফজলুল হক হলের ছাত্রলীগ ও ছাত্র ফেডারেশনের একটি যৌথসভা আয়োজন করা হয়েছিল।
যৌথসভায় ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে এম এ আজিজ ও এম এ ওয়াজেদ মিয়া এবং ছাত্র ফেডারেশনের পক্ষ থেকে এরশাদুল হক মোল্লা ও আনোয়ার আনসারী খান উপস্থিত ছিলেন। ছাত্র ফেডারেশনের সব নেতাই হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও শেখ মুজিবের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, দর্শন ও আদর্শের প্রতি সমর্থন জানায়। ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে বক্তব্য দেন ওয়াজেদ মিয়ার সমসাময়িক ও ঘনিষ্ঠ বন্ধু ইসহাক তালুকদার, সিরাজুল আলম খান প্রমুখ। এ সভায় সিদ্ধান্ত হয় ফজলুল হক হলের ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ছাত্রলীগ ও ছাত্র ফেডারেশন যৌথভাবে ছাত্র ইউনিয়নের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে। এ জন্য এরশাদুল হক মোল্লাকে সভাপতি ও ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়াকে কোষাধ্যক্ষ করে সাত সদস্যবিশিষ্ট একটি নির্বাচনী সাংগঠনিক ও প্রচারণা কমিটি গঠন করা হয়।
নির্বাচন প্রচারাভিযানে আইয়ুব খানের অগণতান্ত্রিক বেসিক ডেমোক্রেসির বিরুদ্ধে বক্তব্য দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়া বন্ধু ও সহপাঠীদের সঙ্গে আইয়ুব খানের বেসিক ডেমোক্রেটিক পদ্ধতির দোষত্রুটি, অগণতান্ত্রিক পদ্ধতি এবং স্বৈরাচারী দিকগুলো নিয়ে আলাপ ও সমালোচনা করতেন। ১৯৬১-৬২ সময়কালে এম এ ওয়াজেদ মিয়া ফজলুল হক হল ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন। রাজনৈতিক ব্যস্ততা থাকলেও তিনি কখনই তাঁর পড়াশোনার ক্ষতি করতেন না। যথাসম্ভব তিনি তাঁর পড়াশোনা ঠিক রাখতেন। কর্মদক্ষতা ও বিচক্ষণতার জন্য এম এ ওয়াজেদ মিয়াকে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নির্বাচিত করা হয়।
এম এ ওয়াজেদ মিয়া ফজলুল হক হলের বার্ষিক ডিনারে তৎকালীন পাকিস্তানের প্রধান বিচারপতি জাস্টিস কর্নেলায়াসকে প্রধান অতিথি হিসেবে আমন্ত্রণ করেন। সে সময় হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে গ্রেপ্তার করে করাচি জেলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ওয়াজেদ মিয়া ডিনারের বক্তৃতায় সামরিক শাসনের দোষ-ক্রুটি এবং তা অবিলম্বে প্রত্যাহারের প্রয়োজনীয়তা ও সর্বজনীন গণতান্ত্রিক পদ্ধতি প্রচলনের কথা উল্লেখ করে বক্তব্য দেন এবং তিনি জননেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মুক্তি দাবি জানান। পর দিন থেকে সামরিক শাসন অবসানের লক্ষ্যে ছাত্র আন্দোলন শুরু করার জন্য ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব অনুরোধ জানিয়েছেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের অনুরোধে সাড়া দিয়ে সভার সভাপতি হিসেবে ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়া ছাত্র ফেডারেশন ও ছাত্র ইউনিয়নের নেতাদের সম্মতিক্রমে পরদিন সকাল থেকে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে ধর্মঘট শুরু করেন। পুলিশের টিয়ারগ্যাস ও ছাত্রদের ইট-পাটকেল ছোড়াছুড়ির মাধ্যমে প্রথম দিনের আন্দোলন সম্পন্ন হয়। পরদিন থেকে আন্দোলন আরো জোরদার হতে থাকে। একদিন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন- ওয়াজেদ মিয়াকে ডেকে বলেন, ওয়াজেদ তুমি তো জান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোর মধ্যে তুমিই একমাত্র ছাত্রলীগের নির্বাচিত সহ-সভাপতি এবং ফজলুল হক হল হচ্ছে ছাত্রলীগের একমাত্র ঘাঁটি। মুজিব ভাই তোমার সঙ্গে দেখা করতে চান। তুমি আমার সঙ্গে আজই চলো।
এরপর তাঁরা দুজনই রিকশায় ধানমন্ডির দিকে রওনা হন। ধানমন্ডির ৩২ নম্বর রোডের বাড়িতে সাক্ষাৎ হলো ইতিহাসের মহানায়ক ও রাজনীতির মহাকবি শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে। ছোট্ট একটা বসার ঘরে আলাপকালে শেখ মুজিব ওয়াজেদ মিয়াকে বললেন, ওয়াজেদ; তুমি ফজলুল হক হলের সহ-সভাপতি নির্বাচিত হওয়ায় তোমাকে মোবারকবাদ জানাই। ছাত্র আন্দোলন এখন চরম পর্যায়ের দিকে যাচ্ছে। শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন ও শেখ মনি যে কোনো মুহূর্তে গ্রেপ্তার হতে পারে। সুতরাং এখন থেকে তুমি আমার সঙ্গে গোপনে যোগাযোগ রাখবে। এটি ছিল শেখ মুজিবের সঙ্গে ওয়াজেদ মিয়ার প্রথম সাক্ষাৎ ও আলাপচারিতা।
একদিন সরকারি নির্দেশে এক আইবিএ কর্মকর্তা হল সংসদের অফিসকক্ষে তাঁর অফিস টেবিলের সমস্ত ড্রয়ার ও অফিস আলমারিতে রাখা কাগজপত্র তন্ন তন্ন করে নিরীক্ষা করে কিছু না পেয়ে ওয়াজেদ মিয়ার শয়নকক্ষে অনুরূপ তল্লাশি করেন। সান্ধ্য আইন চলাকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্ত হল বন্ধ ঘোষণা করা হয়। ঢাকা হল, ফজলুল হক হল ও কার্জন হলসহ বিশ^বিদ্যালয় জাদুঘর অবরোধ করে রাখা হয়েছিল। বিপুলসংখ্যক পুলিশ, পাঞ্জাব রেজিমেন্ট জোয়ান ও সামরিক বাহিনীর লোকজন সারাক্ষণ হল ঘিরে রাখে। হল থেকে অনেক ছাত্র চলে যায়। কিন্তু হলের সহ-সভাপতি হিসেবে ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়া হল ত্যাগ করলেন না।
হলগুলোতে ছাত্র না থাকায় আন্দোলন স্তিমিত হয়ে পড়ে। হলের প্রভোস্ট আইবিএ কর্মকর্তাদের তাকে (ওয়াজেদ মিয়া) নজরদারি রাখার কথা জানিয়ে ওয়াজেদ মিয়াকে হল ত্যাগের নির্দেশ দিলে তিনি হল ত্যাগ করেন। পরদিন ওয়াজেদ মিয়াকে ঢাকার ডিসির সঙ্গে দেখা করতে নির্দেশ দিয়ে পত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি তাকে ঢাকা জেলার ডিসির সঙ্গে অতিসত্তর দেখা করতে বলেন। পরদিন ওয়াজেদ মিয়া ডিসির সঙ্গে দেখা করতে গেলে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। সেখান থেকে পুরানা পল্টন অফিসে এবং ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। কারাগারে তিনি চিঠি দিয়ে বন্ধুর মাধ্যমে বই এনে নেন। তিনি জেলখানায় লেখাপড়া করতেন। সেসময় পীরগঞ্জ থেকে ওয়াজেদ মিয়ার বাবা আব্দুল কাদের মিয়া ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে এলে ছেলের গ্রেপ্তারের কথা শোনেন। ছেলের গ্রেপ্তারের খবর শুনে ভীষণভাবে মর্মাহত হন।
স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশ ও রাজনীতি করারও দেশের মানুষের কোনো অধিকার নেই। তাদের মুখের ভাষার অধিকারও ভুলুন্ঠিত হচ্ছিল। ঠিক সেই সময় উত্তপ্ত রাজনৈতিক পরিবেশে তেজদীপ্ত তরুণ সুধা মিয়া দেশের মাটি ও মানুষের অধিকার আদায়ের এ সংগ্রামে আত্মনিয়োগ করে কারান্তরীণ হয়েছিলেন।
১৯৬২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে শিক্ষা কমিশনের রিপোর্টের প্রতিবাদে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্ররা আইয়ুব খান সরকারের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী হরতাল আহ্বান করে। এ দিন ১৪৪ ধারা জারি থাকা সত্ত্বেও রাস্তায় ছাত্র-জনতা মিছিল করলে অনেক ছাত্র আহত, কয়েকজন নিহত ও বহু ছাত্র গ্রেপ্তার হন। এ আন্দোলনকে সক্রিয় ও অর্থবহ করে তুলতে ওয়াজেদ মিয়ার ভূমিকা ছিল অনন্যসাধারণ।
নিপুণ রাজনৈতিক বিশ্লেষণ ও অসাধারণ সাংগঠনিক দক্ষতা দিয়ে তিনি সে সময়কার জনপ্রিয় নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। বঙ্গবন্ধুর অকৃতিম স্নেহ ও ভালোবাসার পাত্র হিসেবে এম এ ওয়াজেদ মিয়া তাঁর হ্রদয়ের গহিনে আশ্রয় করে নিয়েছিলেন। সময়ের প্রয়োজনেই তিনি রাজনীতিতে সম্পৃক্ত ছিলেন; সময়ের প্রয়োজনেই পরবর্তীতে তিনি রাজনীতি থেকে দূরে ছিলেন। ক্ষমতার চরম শিখরে থেকেও তারমধ্যে কখনো কোনো প্রভাব, মোহ ও ক্ষমতার দম্ভ পরিলক্ষিত হয়নি। ক্ষমতার কেন্দ্রমুখী বল কখনো তাকে আবিষ্ট করতে পারেনি বরং প্রতিরোধী বলের নিরপেক্ষ বলয়ে সব সময় নিজেকে আগলে রাখতেন।
পরবর্তীতে রাজনীতিতে যুক্ত হওয়ার প্রস্তাবকে তিনি সজ্ঞানে প্রত্যাখান করেছেন। রাজনীতি প্রত্যাখানের সুধা মিয়ার একটি উদ্দৃতি তুলে ধরা হলো Ñ “১৯৭৪ সালের ফেব্রুয়ারির ৫-৭ তারিখে ঢাকায় আয়োজন করা হয় আওয়ামী লীগের জাতীয় কাউন্সিল। এর কিছুদিন আগে শেখ ফজলুল হক মনি আমার কাছে প্রস্তাব দেয় যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক হওয়ার জন্য। আমি তাঁর এই প্রস্তাবে অসম্মতি জানালে আমাকে রাজি করানোর জন্য আমার শাশুড়ির কাছে শেখ ফজলুল হক মনি ধরনা দেয়।
শাশুড়ি তো শেখ মনির প্রস্তাবে কোনো সায় দেননি বরং তিনি আমাকে এই বিষয়ে হুঁশিয়ার করে দেন। শেখ মনি, দ্বিতীয়বার তার প্রস্তাবে সম্মত হওয়ার জন্য পীড়াপীড়ি করলে আমি তাকে বললাম, মনি, তুমি নিশ্চয় জান, কোনো সরকারি বা আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত কিংবা সরকারি অনুদানপুষ্ট স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী চাকরিরত অবস্থায় কোনো রাজনৈতিক দল কিংবা এর অঙ্গদলের সদস্য হতে পারবে না।”
ওয়াজেদ মিয়াকে নিয়ে গবেষণা প্রতিষ্ঠান
অবসরগ্রহণ করেও তিনি আর রাজনীতিতে নিজেকে জড়াননি। ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়া আমৃত্যু নিজেকে জড়িয়ে রাখেন লেখালেখি এবং বিজ্ঞানচর্চায়। তাই তো তাঁর নামে প্রতিষ্ঠা করা হয় বেশ কয়েকটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান।
ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়া বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্র-এ প্রতিষ্ঠানটি ২০০৯ সালের ৩০ মে জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এ গবেষণা কেন্দ্রটি দেশে বিজ্ঞান গবেষণা ও চর্চাকে বেগবান করবে। দেশি-বিদেশি গবেষকরা বিজ্ঞানচর্চা করে নতুন বিষয় আবিষ্কার করবে। সে আবিষ্কার নতুন প্রজন্মকে নতুন পথের সন্ধান দেবে।
রংপুরে অবস্থিত বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে আধুনিক বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণার স্বপ্নদ্রষ্টা ও প্রাণপুরুষ এবং আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বিশিষ্ট পরমাণু বিজ্ঞানী হিসেবে তাঁর স্মৃতিকে স্মরণীয় করে রাখতে প্রতিষ্ঠা করা হয় ড. ওয়াজেদ রিসার্চ ইনস্টিটিউট। এখানে উচ্চতর ডিগ্রি এমফিল ও পিএইচডি পর্যায়ে গবেষণা করা হয়।
ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়া ইনস্টিটিউট অব অ্যাডভান্স স্টাডিজ যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠা করা হয়। উচ্চতর পড়াশোনা ও গবেষণার জন্য এ ইনস্টিটিউট।
ঢাকায় শের-এ বাংলা কৃষি বিশ^বিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠা করা হয় ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়া গবেষণা কেন্দ্র। এটি বাংলাদেশে কৃষিবিজ্ঞান বিষয়ে পাঠদান ও গবেষণায় দেশে-বিদেশে অত্যন্ত সুনাম অর্জন করেছে। রাজধানীর অদূরে গাজীপুরে অবস্থিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ^বিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠা করা হয় ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়া কেন্দ্রীয় গবেষণাগার। এছাড়া তাঁর নামে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে- ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়া স্মৃতি পাঠাগার, ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়া সেতু, ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়া টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়া একাডেমিক ভবন ও ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়া কৃষি বিশ^বিদ্যালয়।
জীবন ও কর্ম
ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়া ১৯৪২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি রংপুর জেলার পীরগঞ্জ উপজেলার ফতেপুর গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা মরহুম আব্দুল কাদের মিয়া ও মাতা মরহুমা ময়জুনেসার চার পুত্র ও তিন কন্যার মধ্যে তিনি ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ। গ্রামের প্রাইমারি বিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণি ও পীরগঞ্জ উপজেলার হাইস্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত অধ্যয়ন শেষে তিনি ১৯৫২ সালে রংপুর শহরের সরকারি জেলা স্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি হন। ১৯৫৬ সালে এই স্কুল থেকে ডিস্টিংশনসহ ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন। ১৯৫৮ সালে তিনি রাজশাহী সরকারি কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় বিজ্ঞান বিভাগে দ্বিতীয় স্থান লাভ করেন। ১৯৬১ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের স্নাতক (সম্মান) পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে দ্বিতীয় স্থান লাভ করেন এবং ১৯৬২ সালে স্নাতকোত্তর পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে তিনি ফজলুল হক হলের আবাসিক ছাত্র ছিলেন এবং ছাত্রলীগ মনোনীত প্রার্থী হিসেবে ১৯৬১-’৬২ শিক্ষা বছরের জন্য হল ছাত্র সংসদের সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৬২ সালে শিক্ষা কমিশন বিরোধী আন্দোলনে গ্রেপ্তার হন। ১৯৬৩ সালের ১ এপ্রিল তিনি তৎকালীন পাকিস্তান আণবিক শক্তি কমিশনের চাকরিতে যোগদান করেন। ১৯৬৩-’৬৪ শিক্ষা বছরে তিনি লন্ডনের ইম্পেরিয়াল কলেজের ‘ডিপ্লোমা অব ইম্পেরিয়াল কলেজ কোর্স’ কৃতিত্বের সঙ্গে সম্পন্ন করেন। ১৯৬৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে যুক্তরাজ্যের ‘ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয়’ থেকে পদার্থ বিজ্ঞানে ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করলে তাকে ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা হিসেবে ঢাকার আণবিক শক্তি গবেষণা কেন্দ্রে পদস্থ করা হয়।
তিনি ১৯৬৭ সালের ১৭ নভেম্বর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জ্যেষ্ঠ কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তাদের পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় ও কন্যা সায়মা ওয়াজেদ পুতুল। ১৯৬৯ সালে ইতালির ট্রিয়েস্টের আন্তর্জাতিক তাত্ত্বিক পদার্থ বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্র তাকে এসোসিয়েটশিপ প্রদান করে। এই সুবাদে তিনি ১৯৬৯-’৭৩ ও ১৯৮৩ সালগুলোয় ওই গবেষণা কেন্দ্রে প্রতিবার ৬ মাস ধরে গবেষণায় নিয়োজিত ছিলেন। ১৯৬৯ সালের নভেম্বর থেকে ১৯৭০ সালের অক্টোবর পর্যন্ত তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন শহরের ড্যারেসবেরি নিউক্লিয়ার ল্যাবরেটরিতে পোস্ট ডক্টোরাল গবেষণায় নিয়োজিত ছিলেন।
১৯৭৫ সালের ১২ মার্চ থেকে ২৪ আগস্ট পর্যন্ত তিনি তৎকালীন পশ্চিম জার্মানির কার্লসরুয়ে শহরের ‘আণবিক গবেষণা কেন্দ্রে’ আনবিক রিঅ্যাক্টর বিজ্ঞানে উচ্চতর প্রশিক্ষণ লাভ করেন।
১৯৭৫ সালের ১ অক্টোবর থেকে ১৯৮২ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তিনি ভারতের আনবিক শক্তি কমিশনের দিল্লির ল্যাবরেটরিতে গবেষণায় নিয়োজিত ছিলেন। তিনি অনেক জাতীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান বিষয়ক সম্মেলনে যোগদান করেন। তার অনেক গবেষণামূলক ও বিজ্ঞান বিষয়ক প্রবন্ধ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পত্র-পত্রিকায় এবং সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়েছে। বিশিষ্ট পরমাণু বিজ্ঞানী ড. ওয়াজেদ মিয়া ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর দীর্ঘ সাত বছর নির্বাসিত জীবন কাটান। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক স্তরের পদার্থ বিজ্ঞান, ফলিত পদার্থ বিজ্ঞান ও প্রকৌশলের ছাত্রদের জন্য দুটি গ্রন্থ রচনা করেছেন। তার লেখা ৪৬৪ পৃষ্ঠার ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ঘিরে কিছু ঘটনা ও বাংলাদেশ’ শিরোনামের গ্রন্থটি ১৯৯৩ সালের জানুয়ারিতে এবং ৩২০ পৃষ্ঠার ‘বাংলাদেশের রাজনীতি ও সরকারের চালচিত্র’ শিরোনামের গ্রন্থটি ১৯৯৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড কর্তৃক প্রকাশিত হয়। বহুল রাজনৈতিক ঘটনা সংবলিত এ দুটি গ্রন্থ সুধী পাঠকদের কাছে বিশেষভাবে সমাদৃত হয়।
১৯৭২ ও ১৯৭৩ সালের জন্য তিনি পরপর দুবার বাংলাদেশ আনবিক শক্তি বিজ্ঞানী সংঘের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৮৩, ১৯৮৪ ও ১৯৮৫ সালে তিনি পরপর তিনবার ওই বিজ্ঞানী সংঘের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৮৫ থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত চার বছর তিনি বাংলাদেশ পদার্থ বিজ্ঞান সমিতির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ১৯৯৭ সালে দুবছর মেয়াদের জন্য ওই বিজ্ঞান সমিতির সভাপতি নির্বাচিত হন। তাছাড়াও তিনি ওই বিজ্ঞান সমিতির আজীবন সদস্য। ১৯৮৯ সালে দুবছর মেয়াদের জন্য ওই বিজ্ঞান সমিতির সভাপতি নির্বাচিত হন। তাছাড়া তিনি ওই বিজ্ঞান সমিতির আজীবন সদস্য ছিলেন।
১৯৮৯ থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত পরপর দুটি দুবছরের মেয়াদকালের জন্য বাংলাদেশ বিজ্ঞান উন্নয়ন সমিতির জ্যেষ্ঠ সহ-সভাপতি এবং ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত তিনি পরপর দুটি দুবছর মেয়াদকালের জন্য ওই বিজ্ঞান সমিতির সভাপতি নির্বাচিত হন। এছাড়া তিনি ওই সমিতির একজন আজীবন সদস্য। ১৯৯১-১৯৯২ সালে তিনি বাংলাদেশ আনবিক শক্তি বিজ্ঞানী সংঘেরও সভাপতি নির্বাচিত হন। এছাড়া ১৯৮৯ থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত পরপর তিনটি দুবছরের মেয়াদকালের জন্য তিনি ‘বাংলাদেশ বিজ্ঞানী ও বিজ্ঞানজীবী সমিতি’র সভাপতি নির্বাচিত হন এবং ওই সমিতির একজন আজীবন সদস্য।
তিনি ঢাকার রংপুর জেলা সমিতির আজীবন সদস্য এবং ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত দুবছর মেয়াদকালের জন্য এই সমিতির সভাপতি নির্বাচিত হন। তিনি বাংলাদেশ জার্নালিস্ট এসোসিয়েশনের উপদেষ্টা এবং ঢাকার বৃহত্তম রংপুর কল্যাণ সমিতি; উত্তরবঙ্গ জনকল্যাণ সমিতি; রাজশাহী বিভাগীয় উন্নয়ন ফোরাম; বেগম রোকেয়া স্মৃতি সংসদ এবং রংপুর জেলার মিঠাপুকুর উপজেলার মির্জাপুর বছিরউদ্দিন মহাবিদ্যালয়ের প্রধান উপদেষ্টা ছিলেন।
১৯৪২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি তিনি জন্ম নিয়ে ছিলেন রংপুরের পীরগঞ্জের ফতেপুর গ্রামে। ড. ওয়াজেদ মিয়া ২০০৯ সালের এই দিনে বিকেল ৪টা ২৫ মিনিটে দীর্ঘদিন কিডনির সমস্যাসহ হৃদরোগ ও শ্বাসকষ্টে ভুগে ঢাকার স্কয়ার হাসপাতালে ৬৭ বছর বয়সে মারা যান।
লেখক: সিনিয়র সাব-এডিটর, দৈনিক সংবাদ সারাবেলা ও সাবেক সাধারণ সম্পাদক, ঢাকা সাব-এডিটরস কাউন্সিল (ডিএসইসি)
সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী আবু জাফর
যোগাযোগ: । [email protected] । বিজ্ঞাপন ও বার্তা সম্পাদক: 01894944220
ঠিকানা: বার্তা ও বাণিজ্যিক যোগাযোগ : বাড়ি নম্বর-২৩৪, খাইরুন্নেসা ম্যানশন, কাঁটাবন, নিউ এলিফ্যান্ট রোড, ঢাকা-১২০৫।
© 2025 Sangbad Sarabela All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh