× প্রচ্ছদ বাংলাদেশ বিশ্ব রাজনীতি খেলা বিনোদন বাণিজ্য লাইফ স্টাইল ভিডিও সকল বিভাগ
ছবি ভিডিও লাইভ লেখক আর্কাইভ

উপমহাদেশের প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিদ্যার পথিকৃৎ

জাতীয় অধ্যাপক শাহলা খাতুন

০৭ নভেম্বর ২০২৩, ১৪:৩৫ পিএম

সেকালের সামাজিক অবগুণ্ঠন ছিন্ন করে হাতে গোনা যে কয়েকজন মহীয়সী নারী সেবা, সংস্কারে এগিয়ে এসেছিলেন ডা. জোহরা কাজী তাঁদের অগ্রগণ্য। তাঁর জীবনের মূলমন্ত্র ছিল কর্মশীলতা। সেবাদান তাঁর জীবনের দীক্ষা। সৎকর্ম, সৎসাহস তাঁর মহান জীবনের পাথেয়। তিনি চিকিৎসা ব্যবস্থার মানোন্নয়নে শিক্ষার্থীদের সুচিকিৎসক হিসেবে তৈরির ক্ষেত্রে একজন সার্থক অধ্যাপক ছিলেন। নিষ্ঠা, একাগ্রতা ও সেবার মহান মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে সারাটি জীবন আর্তমানবতার সেবায় নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন। বাংলাদেশে স্ত্রীরোগ ও ধাত্রীবিদ্যা আর ডা. জোহরা বেগম কাজী এক অবিচ্ছেদ্য সত্তা।

তিনি ছিলেন অত্যন্ত নির্লোভ মানুষ। এ দেশের গাইনি বিভাগের প্রসারে তিনি রেনেসাঁর প্রতীক। স্ত্রীরোগ ও ধাত্রীবিদ্যা বিভাগ প্রতিষ্ঠার পর নারী সমাজে এক নবজাগরণের সৃষ্টি হয়। তিনি এ দেশে নারী শিক্ষার অন্যতম অগ্রদূত। তাঁর আজীবনের সাধনা ছিল এই সমাজ থেকে কুসংস্কার ধর্মান্ধতা দূর করে প্রগতিশীলতা আনয়ন করা এবং নারী সমাজকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। তিনি সবসময় বলতেন, 'Don't run after money, money will run after you' তাঁর আদর্শ অনুসরণ করে দেশের অসংখ্য নারী চিকিৎসাবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে অবদান রাখছেন। প্রচারবিমুখ মানবতাবাদী চিকিৎসাবিজ্ঞানী ডা. জোহরা বেগম কাজীর ১৫তম মৃত্যুবার্ষিকী বর্তমান প্রজন্মকে তাঁর মতো মানবসেবায় ব্রতী হতে অনুপ্রাণিত করবে, এই প্রত্যাশা।

অধ্যাপক ডা. জোহরা বেগম কাজী আমার পরম শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষয়িত্রী। তিনি আজ আমাদের মাঝে নেই, সকলকে ছেড়ে পরলোকের পথে চলে গেছেন। কিন্তু তিনি ছিলেন সকলের খুবই প্রিয় শিক্ষক। বাংলাদেশের চিকিৎসা অঙ্গনে ডা. জোহরা কাজী এক নতুন ভুবন রচনা করে গেছেন। এ দেশের স্ত্রীরোগ ও ধাত্রীবিদ্যা এবং অধ্যাপক ডা. জোহরা বেগম কাজী একসূত্রে গাঁথা। নিঃস্বার্থভাবে মানবকল্যাণে নিজেকে উজাড় করে দিয়ে ব্যক্তি-স্বার্থের ঊর্ধ্বে বিচরণ করে সার্বজনীন হয়েছেন। ১৯৪৭ সালে দেশবিভাগের পর বাংলাদেশে (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) মহিলা চিকিৎসকের শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছিল, তা পূরণের জন্য দেশপ্রেমের গভীর কৃতজ্ঞতাবোধ থেকেই এক শুভ মাহেন্দ্রক্ষণে তিনি মাতৃভূমিতে ফিরে এসেছিলেন। চিকিৎসাবিজ্ঞানের অনন্য নারী হিসেবে যিনি বিখ্যাত তিনিই হলেন অধ্যাপক ডাঃ জোহরা বেগম কাজী। মনে পড়ে পঞ্চাশ দশকের শেষ ভাগের কথা। আমি তখন ঢাকা মেডিকেল কলেজের এমবিবিএস-এর ছাত্রী। তিনি আমার শিক্ষয়িত্রী। সেই যুগে মেডিকেলের ছাত্রী হিসেবে একজন বাঙালি মহিলা শিক্ষকের সান্নিধ্য লাভ করা কত যে আনন্দের ও গৌরবের বিষয় ছিল সে অনুভব-অনুভূতি আজও আমাদের মাঝে যেন বীণার এক তার হয়ে বাজে। তিনি যেমন কর্তব্যপরায়ণ অভিজ্ঞ সুচিকিৎসক, তেমনি এ বিভাগের একজন সুদক্ষ আদর্শবান শিক্ষয়িত্রী। আমার শিক্ষা ও কর্মজীবনের দুটো ধারাই তাঁর সঙ্গে একাত্মভাবে মিশে আছে। তাই বর্তমানেও তাঁর অতীতের শিক্ষা ও সেবাদর্শের কথা স্মরণ করতে হচ্ছে আমার প্রতিটি কর্মক্ষেত্রে। তাঁর আদর্শ জাতির প্রতিটি ক্ষেত্রে বড়ই মূল্যবান সম্পদ বলে মনে করি। তাই অতীত ও বর্তমানের আলোকে নতুন প্রজন্মের জন্য এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্তস্বরূপ অধ্যাপক ডাঃ জোহরা বেগমের কিছু স্মৃতির বর্ণনা দিতে চাই, যার সাক্ষী ছাত্রী ও সহকারী হিসেবে আমি নিজেই।

তখনকার দিনে ‘লেডি ডাক্তার’ বলতে একজনকেই সবাই চিনতো। তিনি ডা. জোহরা বেগম কাজী। স্ত্রীরোগ ও ধাত্রীবিদ্যা বিভাগের প্রধান। এমবিবিএস তৃতীয় ও পঞ্চম বর্ষে পদার্পণ করেই প্রত্যক্ষভাবে তাঁকে শিক্ষয়িত্রী হিসেবে পেয়েছি। আমাদের ক্লাশ শুরু হতো সকাল ৭টায়। মনে আছে ৭টার পর দরজা বন্ধ করে তিনি ক্লাস করাতেন। হাজিরা নিজে লিখতেন। দেরি করে গেলে ক্লাসে কাউকেই প্রবেশের অনুমতি দিতেন না। পড়তে এসে তাঁর কাছে নিয়মানুবর্তিতা, সময়ের মূল্যবোধের গুরুত্ব ভালোভাবে অনুভব করতে পেরেছিলাম। ক্লাসে তিনি ছিলেন কঠোর। যে- কোনো বিষয়ের ওপর ব্যাপক আলোকপাত করে আমাদের বোঝাবার চেষ্টা করতেন এবং সফলও হয়েছেন। আদর্শবান শিক্ষয়িত্রী হিসেবে তাঁকে খুব ভয় পেতাম। ক্লাসে তিনি প্রমাণ করেছেন, শিক্ষা বিস্তারে শিক্ষকতার ক্ষেত্রে নারী-পুরুষ সমঅধিকারের বিষয়টি। ক্লাসের ছাত্র-ছাত্রীদের সমান দৃষ্টি দিয়ে পড়াতেন। প্রশাসনিক সফলতার পাশাপাশি তিনি মেধাশক্তি দিয়েও ছাত্র-ছাত্রীদের আকৃষ্ট করেছেন। তিনি নিজেও যেমন ডুবে থাকতেন বইয়ের মাঝে তেমনি আমাদেরকেও জ্ঞান অর্জনের জন্য বই পড়ার অনুপ্রেরণা দিতেন। ক্লাশের পড়াশোনা ও ডাক্তার হিসেবে কর্তব্যপালন ছাড়া তিনি কোনো অবসর সময় কাটাতেন না। ব্যস্ত ছিলেন দায়িত্ব নিয়ে। তাঁর কর্তব্য ও দায়িত্ববোধের বাস্তবতার সাথে আমিও সম্পৃক্ত হয়ে পড়েছিলাম কর্মময় জীবনে পদার্পণ করে।

আমি তাঁর সহকারী ডাক্তার হিসেবে কাজ করেছি। চিকিৎসাবিজ্ঞানে, বিশেষ করে স্ত্রীরোগ ও ধাত্রীবিদ্যা বিভাগের অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য তাঁর সার্বিক সহযোগিতা পেয়েছি। ঐ সময় আমি ‘আর এস’ (রেসিডেন্ট সার্জন) হিসেবে ছিলাম। ম্যাডাম এ বিভাগের প্রধানের দায়িত্বে থাকলেও যে কোনো রোগীর ভর্তির ব্যাপারে আমি তাঁর নির্দেশিত দায়িত্ববান ডাক্তার হিসেবে নিযুক্ত ছিলাম। হাতে-কলমে কাজ শিখেছি। অপারেশন থিয়েটারে ম্যাডামের সাথে সহযোগিতা করেছি। বাস্তবে তাঁর কাছ থেকে জটিল যে কোনো আপারেশন শিখেছি। তিনি নিজেও আগ্রহ নিয়ে শিখাতেন। ভুল হলে রাগ করতেন ঠিকই, কিন্তু পথদ্রষ্টা হিসেবে বিষয়টি বুঝিয়ে দিতেন। ব্লাড ব্যাংক সম্পর্কে তিনি ছিলেন সচেতন। যে কোনো রোগী ভর্তির সময় রোগীর আত্মীয়-স্বজনদের কাছে থেকে রক্ত দেওয়ার অঙ্গীকারপত্র নিয়ে ভর্তির ব্যবস্থা করতেন। হাসপাতালে যতক্ষণ কর্তব্যরত থাকতেন, ততক্ষণ তিনি কোনো বিশ্রাম নিতেন না। কর্তব্যরত ডাক্তার কেউ কোনো ভুল করলে কিংবা কাজে অবহেলা করলে অভিভাবকের ন্যায় গালমন্দ করতেন। কোনো রোগীর ব্যান্ডেজ খারাপ হলে তা আবার খুলে পুনরায় করাতে বলতেন। রাত-দিন যেকোনো সময়ই তিনি রোগীদের ওয়ার্ডে যেতেন। হাসপাতালে কর্তব্য পালন ও ক্লাসে তিনি সাধারণ স্বাভাবিক মূল্যের শাড়ি পরতেন। বিলাসিতা বলতে কিছুই তাঁর ছিল না। শাড়ির আঁচল জড়িয়ে ইংরেজি ভাষায় কথা বলতেন বেশি। হিন্দিও ভালো জানতেন। বাংলাও বলতেন ৷ বাঙালি নারী সমাজের মাতৃস্নেহের যে বৈশিষ্ট্য তা তাঁর মধ্যে ছিল। তিনি গরিব রোগীদের প্রতি যথেষ্ট যত্ন নিতেন। চিকিৎসাসেবা যে সর্বজনীন তাঁর আদর্শ তিনি কর্মময় জীবনে প্রতিষ্ঠা করেছেন।

অধ্যাপক ডা. জোহরা বেগম একমাত্র অনারারি এমআরসিওজি পেয়েছেন এবং পরবর্তীতে তিনি সেই সুবাদে লন্ডন থেকে এফআরসিওজি ডিগ্রি পরীক্ষা দেওয়ার আগেই পেয়েছেন। চিকিৎসাবিজ্ঞানে তাঁর অর্জিত অভিজ্ঞতা ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে বিলিয়ে দিয়ে আনন্দ পেতেন। কর্মের মাঝে নিজেকে নিয়োজিত রাখতে উৎসাহ বোধ করতেন। কর্মের মাঝে ডুবে থাকতে আমাদেরকেও উৎসাহিত করতেন। কেউ কাজে ফাঁকি দিতে চাইলেও তিনি শাসন করতেন। তবে স্নেহাদরও করতেন পারিবারিকভাবে। ক্লাশে শাসন করতেন ঠিকই কিন্তু সোহাগ করতেন বাসায়। আদর করতেন জননীরূপে। হাসপাতালে অধিক রাতে এলে তিনি মন্দ বলতেন। তিনি বলতেন ‘রাতে হাসপাতালে এলে গাড়িতে আসবে।' আমাদের কোনো বিপদে পড়তে না হয়, সে জন্য তিনি চিন্তা করতেন। তিনি অক্লান্ত পরিশ্রম করতেন কিন্তু আমরা ক্লান্তিবোধ করলে তিনি তা অনুভব করতেন। ভালোবাসতেন মেয়ের মতো।

আমার বিবাহে তিনি গিয়েছেন। একটি শাড়িও দিয়েছেন। তখন আমি তাঁর শাসনের ঊর্ধ্বে একজন কন্যা হিসেবে। একজন আদর্শ শিক্ষক যদি জন্মদাতা পিতামাতার মতো হতে পারে, তবে সেই শিক্ষক বা শিক্ষয়িত্রী জাতির মেরুদণ্ডকে শক্ত করে ধরে রাখতে পারেন। অধ্যাপক জোহরা বেগম কাজী ‘শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড’ এ আদর্শ বাস্তবায়নে প্রকৃত দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী মহীয়সী নারী। সমাজ সচেতন ব্যক্তি হিসেবে তিনি ছিলেন বরণীয়। স্ত্রীরোগ ও ধাত্রীবিদ্যা বিভাগে মহিলারা চিকিৎসার জন্য এলে তিনি তাঁদের অধিক বাচ্চার মা হওয়া থেকে বিরত থাকতে বলতেন। এ ব্যাপারে তাঁদের পরামর্শ দিতেন। এ জন্য মহিলাদের সন্তান প্রসবের পরেই লাইগেশন করার উপদেশ দিতেন। জনসংখ্যা বিস্ফোরণ এ দেশের তথা বিশ্বের জন্য হুমকিস্বরূপ, তা তিনি সেই যুগেই অনুভব করেছেন। সমাজ সচেতন ছিলেন তাঁর স্বামী রাজিউদ্দিন আহমদ ভূঁঞা। তাঁর একজন ছাত্রী হিসেবে যতদূর জানি তাতে তিনি একজন চিকিৎসকই নন, তিনি মানব সেবাদর্শের এক পথদ্রষ্টা। এ দেশে প্রথম মুসলিম মহিলা চিকিৎসক ও আদর্শবান শিক্ষয়িত্রী হিসেবে তিনি যে অবদান রেখেছেন তা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এবং দেশের জন্য বড়ই মঙ্গলজনক। অধ্যাপক ডা. জোহরা বেগম কাজীর মতো সেবাপরায়ণ মানুষ পৃথিবীতে বারবার আসে না। তাঁর সব ক্রিয়াকর্ম শুধু মানুষের কল্যাণে ব্যাপৃত ছিল। তিনি কখনো আড়ম্বর জীবনযাপন পছন্দ করতেন না। তিনি খুবই সাধারণ ছিলেন। তাঁর পোশাক-পরিচ্ছদ, চলাফেরা ছিল একদম সাদাসিধে। ইচ্ছে করলেই তিনি অত্যন্ত বিলাসী জীবনযাপন করতে পারতেন। কিন্তু কখনই তিনি তা করেন নি। রোগীদের কাছ থেকে তিনি ইচ্ছে করলে প্রচুর টাকা নিতে পারতেন এবং তাঁর সে সুযোগ ছিল। কিন্তু কখনই তিনি তা করতেন না।

শতাব্দীর এ আলোকবর্তিকা নিভে গেছে। ২০০৭ সালের ৭ নভেম্বর তিনি পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নিয়েছেন। তবে তাঁর কীর্তি তাঁকে মহীয়ান করে রাখবে মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে এই প্রার্থনা করি। মানবকল্যাণে নিজেকে উৎসর্গ করা এই মহীয়সী নারীর আত্মা যেন শান্তিতে স্থিত হয়।


লেখক: স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ

Sangbad Sarabela

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী আবু জাফর

যোগাযোগ: । 01894-944220 । [email protected], বিজ্ঞাপন: 01894-944204

ঠিকানা: বার্তা ও বাণিজ্যিক যোগাযোগ : বাড়ি নম্বর-২৩৪, খাইরুন্নেসা ম্যানশন, কাঁটাবন, নিউ এলিফ্যান্ট রোড, ঢাকা-১২০৫।

আমাদের সঙ্গে থাকুন

© 2024 Sangbad Sarabela All Rights Reserved.