× প্রচ্ছদ বাংলাদেশ বিশ্ব রাজনীতি খেলা বিনোদন বাণিজ্য লাইফ স্টাইল ভিডিও সকল বিভাগ
ছবি ভিডিও লাইভ লেখক আর্কাইভ

ধূমপান নিয়ন্ত্রণে আইনের পাশাপাশি সচেতনতা বৃদ্ধিও জরুরি

রেজাউর রহমান রিজভী

১৪ নভেম্বর ২০২৩, ১৭:০১ পিএম

বিশ্বের দূষিত নগরের তালিকায় ঢাকা বেশ কয়েক বছর ধরেই রয়েছে। ফলে ঢাকার বাতাসে এখন নিঃশ্বাস নেয়াটাই এখন যেন দায়। তার উপরে রাস্তায় বের হলেই গাড়ির দূষিত ধোঁয়া ও ধূলাবালির পাশাপাশি ধূমপানের বিষাক্ত ধোঁয়া যেন এখন নৈমিত্তিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ আইন করে বলা আছে, জনসমাগম হয় এমন পাবলিক প্লেসে প্রকাশ্যে ধূমপান করা যাবে না। কিন্তু কে শোনে কার কথা! নির্বিঘ্নে ধূমপায়ীরা পাবলিক প্লেসে ধূমপান করছেন, যার ফলে পরোক্ষ ধূমপানের ক্ষতির শিকার হচ্ছেন নারী-শিশু সহ অধূমপায়ীরা।

গ্লোবাল অ্যাডাল্ট টোব্যাকো সার্ভে (গ্যাটস) ২০১৭ অনুযায়ী, বাংলাদেশে আচ্ছাদিত কর্মস্থলে কাজ করেন এমন প্রাপ্তবয়স্ক জনগোষ্ঠির ৪২.৭ শতাংশ এবং গণপরিবহনে যাতায়াতের সময় প্রায় ২ কোটি ৫০ লক্ষ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হন। প্রায় ৬১ হাজার শিশু পরোক্ষ ধূমপানজনিত বিভিন্ন অসুখে ভোগে। তামাক ব্যবহারজনিত রোগে দেশে প্রতিদিন গড়ে ৪৪২ জন মানুষ প্রাণ হারান।

অথচ এই পরিসংখ্যান যে ধূমপায়ীরাও সকলে জানেন না, এমনটি নয়। বরং আইন করেও অধূমপায়ীদেরকে পুরোপুরি সুরক্ষা দেয়া যাচ্ছে না। এর কারণ হলো, প্রচলিত তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের কিছু কিছু দুর্বলতা রয়েছে। আর এই দুর্বলতার ফাঁক গলেই ধূমপায়ীরা বের হয়ে যাচ্ছেন ও অধূমপায়ীদেরকে স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে ফেলে দিচ্ছেন। 

তবে প্রচলিত আইনের সুফল যে একেবারেই পাওয়া যাচ্ছে না এমনটিও নয়। যেমন- হোটেল-রেস্টুরেন্ট কিংবা গণপরিবহনে ধূমপান নিষিদ্ধ হওয়ায় এবং তা জনসাধারণের মধ্যে ব্যাপক ভাবে প্রচার হওয়ায় এসব অধিকাংশ স্থানেই ধূমপান কমেছে। যদিও অনেক সময় পুরোপুরি তা বন্ধ করা যায় না জনগণের পরিপূর্ণ সচেতনতার অভাবে। এক্ষেত্রে আইনের বাস্তব প্রয়োগের পাশাপাশি সামাজিক সচেতনতাও অধিক জরুরী।

গ্লোবাল এডাল্ট ট্যোবাকো সার্ভে (গ্যাটস) এর ২০১৭ এর রিপোর্টে দেখা যায়, তামাক ব্যবহারকারীর প্রায় অর্ধেক মারা যান তামাকের কারণে। আর বিশ্বজুড়ে প্রতিরোধযোগ্য মৃত্যুর প্রধান আটটি কারণের ৬টির সাথেই তামাক জড়িত। তামাক ব্যবহারকারীদের তামাকজনিত রোগ যেমন হৃদরোগ, স্ট্রোক, সিওপিডি বা ফুসফুসের ক্যান্সার হবার ঝুঁকি ৫৭% বেশি এবং তামাকজনিত অন্যান্য ক্যান্সার হবার ঝুঁকি ১০৯% বেশি। একারণে বাংলাদেশে প্রতি বছর ১ লক্ষ ৬১ হাজারেরও বেশি মানুষ তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার জনিত রোগে মৃত্যুবরণ করেন।

আবার গ্যাটসের রিপোর্ট মোতাবেক, যারা ধূমপান করেন না, কিন্তু পরোক্ষভাবে ধূমপানের ক্ষতির শিকার হন, এমন মানুষের সংখ্যা সামগ্রিক ভাবে মোট ধূমপায়ীর সংখ্যার চেয়েও বেশি। সংখ্যার হিসেবে তা প্রায় ৪ কোটি মানুষ, যা প্রত্যক্ষ ধূমপায়ীর চেয়ে বেশি।

নাটক-সিনেমাতে আগে কোনরূপ সতর্কবার্তা ছাড়াই অবাধে ধূমপান ও মদ্যপানের দৃশ্য দেখানো হতো। তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের ফলে এখন ধূমপান ও মদ্যপানের দৃশ্যের সময় সতর্কবার্তা দেখানোর বাধ্যবাধ্যকতা রয়েছে। কিন্তু অনেক সময়ই দেখা যায় যে, এই সতর্কবার্তা এতোই ছোট করে স্ক্রিণের নিচে দেয়া হয় যে, তা দর্শকদের দৃষ্টি এড়িয়ে যায় বা পড়াই যায় না। কিন্তু পরিচালক বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যদি এ ব্যাপারে আন্তরিকভাবে সচেতন হন, তবে ধূমপান ও মদ্যপানের দৃশ্য কম দেখাবেন ও সতর্কবার্তা সঠিক ভাবে উপস্থাপন করবেন।

এমনিতেই তামাক নিয়ন্ত্রণের বৈশ্বিক মানদন্ডে বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে রয়েছে। তারপরও অবাধে আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে যেভাবে ধূমপায়ীরা অন্যদেরকে পরোক্ষ ধূমপানের ক্ষতির মুখে ফেলছেন তাতে আগামীতে এই অবস্থা আরো নাজুক হবে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ‘গ্লোবাল টোব্যাকো এপিডেমিক প্রতিবেদন-২০২৩’ এ ধূমপানমুক্ত পরিবেশের উপর বিশেষভাবে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। বাংলাদেশে হোটেল, রেস্টুরেন্টসহ বিভিন্ন পাবলিক প্লেস ও পাবলিক পরিবহনে ডেজিগনেটেড স্মোকিং জোন বা ধূমপানের জন্য নির্ধারিত এলাকা থাকায় অধূমপায়ীদের পাশাপাশি সেবাকর্মীরাও পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হন বলে এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। এজন্য থাইল্যান্ড, নেপাল, আফগানিস্তানসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বেশ কিছু দেশ ধূমপানমুক্ত পরিবেশ সূচকে ভালো করলেও বাংলাদেশ এক্ষেত্রে অনেকটাই পিছিয়ে রয়েছে। প্রতিবেদনে ডেজিগনেটেড স্মোকিং জোন বাতিলের কথা বলা হয়েছে। এজন্য সংশোধিত তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনটি অনুমোদিত হলে আমাদের দেশেও ডেজিগনেটেড স্মোকিং জোন বাতিল হবে বলে আশা করা হচ্ছে।

আমাদের দেশের যত্রতত্র ধূমপানের অন্যতম আরেকটি কারণ হলো এখানে অবাধে তামাকপণ্যের বিজ্ঞাপন ও প্রচার করা হয়। স্কুল-কলেজগুলোর সামনে অনুমোদন ছাড়া দোকানগুলোতে ও ভ্রাম্যমান হকাররা বিড়ি সিগারেট বিক্রি করে থাকেন। প্রায়শঃই অপ্রাপ্তবয়স্কদের কাছেও এরা সিগারেট বিক্রি করে থাকে। এতে একদিকে যেমন ধূমপায়ীর সংখ্যা বাড়ছে, তেমনি আইনের স্পষ্ট লঙ্ঘন করে পাবলিক প্লেসে ধূমপান করা হচ্ছে।

অথচ ডব্লিউএইচও (হু)’র এক প্রতিবেদনে জানা যায়, নেপাল, ভুটান, থাইল্যান্ডসহ বিশ্বের ৫০টি দেশে বিক্রয়কেন্দ্রে তামাকজাত দ্রব্য প্রদর্শন নিষিদ্ধ হয়েছে। অনুরূপভাবে বিশ্বের ৮৬টি দেশে সিগারেটের খুচরা শলাকা বিক্রি নিষিদ্ধ। অথচ আমাদের দেশের আইনে বিড়ি-সিগারেটের খুচরা শলাকা বিক্রির বিষয়ে কিছু উল্লেখ নেই। এছাড়া ৬২টি দেশ তামাক কোম্পানির সিএসআর কার্যক্রম সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করেছে। কিন্তু আমাদের দেশে তামাক কোম্পানীগুলো বিভিন্ন অনুষ্ঠানের অন্তরালে তাদের সিএসআর কার্যক্রম পরিচালনা করে, যা নিয়ে বিভিন্ন সময় তামাকবিরোধী উন্নয়নকর্মীরা সোচ্চার হলেও খুব একটা ফলপ্রসূ হয় না।

ইদানিং অনেক নারীরা ধূমপানের কুফল সম্পর্কে অবগত হচ্ছেন বলে তাদের ঘরের অভ্যন্তরে পুরুষদেরকে ধূমপানে নিরুৎসাহিত বা বারণ করেন। এতে পুরুষদের মধ্যে যারা ধূমপানে আসক্ত তারা ঘরের বাইরে গিয়ে ধূমপান করছেন। এতে ঘরের মানুষজন, বিশেষত শিশুরা নিরাপদ হলেও বাইরে ধূমপানের কারণে অন্যান্য অধূমপায়ীরা স্বাস্থ্যক্ষতিতে পড়ছেন। অথচ এসব ধূমপায়ীরা যদি ধূমপানের কারণে সৃষ্ট রোগগুলো সম্পর্কে নিজেরা সচেতন হতেন তাহলে কিন্তু নিজে থেকেই তারা তখন আর ঘরের ভেতর বা বাইরে সব জায়গাতেই ধূমপান করা থেকে বিরত থাকতেন। অন্তত এই ক্ষেত্রে আইনের চেয়েও সচেতনতা অনেক বেশি কাজে দেবে আমি মনে করি। 

একসময় দেশের বিভিন্ন বাসের গায়ে বা রাস্তায় বিলবোর্ডে ধূমপানের কুফল সম্পর্কে সচেতনতামূলক প্রচার প্রচারণা দেখা যেত। ইদানিংকালে এটি তেমন আর চোখে পড়ে না। এজন্য টিনেজ বা নতুন জেনারেশনের কাছে পৌঁছানোর জন্য আবারো মনে হয় সচেতনতামূলক এসব কার্যক্রম আবারো জোড়ালো ভাবে শুরু করা প্রয়োজন।  এ ব্যাপারে সরকারের পাশাপাশি তামাকবিরোধী প্লাটফর্ম ও এনজিওরা এগিয়ে আসতে পারেন।

সর্বোপরি,  এটা মনে রাখতে হবে যে, তামাক এমন একটি পণ্য যার কোন ভালো গুণ তো নেই-ই। উল্টো এটিকে মৃত্যু-পণ্য বললেও অতুক্তি হবে না। ক্ষতিকর তামাক সেবন করে তারা পক্ষান্তরে নিজেদের মৃত্যুকেই ত্বরান্বিত করছে। আর এই বিষয়টিই তামাকসেবীদের মন-মননে গেঁথে দেবার জন্য সকলেকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। আর এটি বাস্তবায়নে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধন এবং তামাকের ক্ষতির বিষয়ে সচেতনতামূলক কার্যক্রম জোড়দার করতে হবে। তবেই তামাকমুক্ত বাংলাদেশ পাওয়া সম্ভব হবে।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও গণমাধ্যম বিশ্লেষক

Sangbad Sarabela

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী আবু জাফর

যোগাযোগ: । 01894-944220 । [email protected], বিজ্ঞাপন: 01894-944204

ঠিকানা: বার্তা ও বাণিজ্যিক যোগাযোগ : বাড়ি নম্বর-২৩৪, খাইরুন্নেসা ম্যানশন, কাঁটাবন, নিউ এলিফ্যান্ট রোড, ঢাকা-১২০৫।

আমাদের সঙ্গে থাকুন

© 2024 Sangbad Sarabela All Rights Reserved.