ছবিঃ সংগৃহীত।
দেশের একমাত্র পূর্ণাঙ্গ আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে পরিচিত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (জাবি)। স্বাধীনতার সমবয়সি বিশ্ববিদ্যালয়টি দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার ইতিহাস ও ঐতিহ্যে অনন্য স্থান দখল করে আছে। প্রতিষ্ঠার পর ৫৪ বছরের অভিযাত্রা সম্পন্ন করে ৫৫ বছরে পদার্পণ করতে যাচ্ছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (জাবি)। ১৯৭০ সালের ১২ জানুয়ারি থেকে যাত্রা শুরু করে পাঁচ দশকের বেশি সময়ে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের রয়েছে বেশ অর্জন। দেশসেরা শিক্ষক ও গবেষকদের নেতৃত্বে বিশ্ববিদ্যালয় পেয়েছে নানা খ্যাতি। তবে এসময়ে অর্জনের পাশাপাশি অপূর্ণতার পরিমাণও কম নয়।
শিক্ষার্থীদের আবাসনের দিক থেকে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের থেকে তুলনামূলক এগিয়ে রয়েছে এ বিশ্ববিদ্যালয়। শুরুতে পূর্ণাঙ্গ আবাসিক হিসেবে যাত্রা করলেও পরবর্তীতে আবাসিক হলের আসন সংখ্যার চেয়ে বেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করানো, হল নিয়ন্ত্রণে ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের আধিপত্য ও অছাত্রদের হলে অবস্থানের কারণে এ চরিত্র অনেকটাই হারিয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়টি। তবে সম্প্রতি নতুন ৬টি হল নির্মাণ জুলাই অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনকে বিতাড়িত করার মাধ্যমে পূর্নাঙ্গ আবাসিক চরিত্র ফিরে পেয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়েটি । এখানে ছেলেদের জন্য ১১টি এবং মেয়েদের জন্য ১০টি আবাসিক হল রয়েছে।
প্রতিষ্ঠার পর থেকে শিক্ষা ও গবেষণায় অবদান রেখে চলেছে বিশ্ববিদ্যালয়টি। এমনকি বিশ্বসেরা ২ পার্সেন্ট গবেষকের তালিকায় একাধিকবার এসেছে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের নাম। শিক্ষা ও গবেষণায় আন্তর্জাতিকর্ যাংকিংয়ে দেশসেরা হওয়ার গৌরব অর্জন করেছে বিশ্ববিদ্যালয়টি। যুক্তরাজ্যভিত্তিক শিক্ষা সাময়িকী ‘টাইমস হায়ার এডুকেশন’ (টিএইচই)-এর ওয়াল্ড র্যাঙ্কিং-২০২৫ এ বিশ্বের ১১৫টি দেশের ২ হাজার ৯২টি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে প্রকাশিত এ র্যাঙ্কিংয়ে যৌথভাবে দেশসেরা হওয়ার গৌরব অর্জন করেছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (জাবি)। এছাড়াও যুক্তরাজ্যভিত্তিক শিক্ষা সাময়িকী 'টাইমস হায়ার এডুকেশন (টিএইচই)' - এর ওয়াল্ড র্যাংকিং ২০২৪ এ বিশ্বের ১০৮টি দেশের ১ হাজার ৯০৪টি বিশ্ববিদ্যালয়েরর্ যাংকিং তালিকা প্রকাশ করেছিল। শিক্ষা ও গবেষণার মান, শিক্ষক-শিক্ষার্থী-কর্মচারী অনুপাত, সাইটেশন, আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীসহ ১৮টি পারফরম্যান্স সূচকের ওপর ভিত্তি করে প্রকাশিত আন্তর্জাতিকর্ যাংকিংয়ের এ তালিকায় দেশের মধ্যে সেরা হয়েছিল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যেও অতুলনীয় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। শীত মৌসুমে এখানকার স্বচ্ছ পানির লেকে আসে হরেক রকমের অতিথি পাখি। লেকগুলোতে ফুটে থাকা লাল শাপলার বুকে এসব পাখির জলকেলি মুগ্ধ করে শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও দর্শনার্থীদের। বিশাল জলাশয়যুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়কে পাখিদের অভয়ারণ্য হিসেবে ঘোষণা করেছে সরকার। প্রতিবছর পাখি সংরক্ষণে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য অনুষ্ঠিত হয় পাখি মেলা। এছাড়া এখানে প্রজাপতির সংরক্ষণ ও প্রজনন বৃদ্ধির জন্য রয়েছে 'প্রজাপতি পার্ক'। প্রকৃতির গুরুত্বপূর্ণ শোভাবর্ধনকারী অনুষঙ্গ এসব প্রজাপতি সংরক্ষণে সচেতনতা বৃদ্ধিতে প্রতি বছর এখানে অনুষ্ঠিত হয় 'প্রজাপতি মেলা'। বিজ্ঞান গবেষণার জন্য এ বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্মিত হয়েছে দেশের সর্ববৃহৎ 'ওয়াজেদ মিয়া বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্র'। তাছাড়া সবুজ গাছপালায় ঘেরা লাল ইটের ক্যাম্পাস যেন এক টুকরো ভূস্বর্গ হিসেবে টিকে আছে বছরের পর বছর।
দীর্ঘপথ পরিক্রমায় বিশ্ববিদ্যালয়টি পেয়েছে অসংখ্য গুণী মানুষের সংস্পর্শ। এসব ব্যক্তিদের সংস্পর্শে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচিত হয়েছে বিশ্বদরবারে। তাদের মধ্যে প্রখ্যাত কবি সৈয়দ আলী আহসান, অধ্যাপক সুনীল কুমার মুখোপাধ্যায়, লেখক হায়াৎ মামুদ, লেখক হুমায়ুন আজাদ, নাট্যকার সেলিম আল দীন, কবি মোহাম্মদ রফিক, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী দিলারা চৌধুরী, আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশ্লেষক অধ্যাপক তারেক শামসুর রেহমান, রসায়নবিদ অধ্যাপক শরীফ এনামুল কবির, ডক্টর সৌমিত্র শেখর, অর্থনীতিবিদ ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব আনু মুহাম্মদ, অভিনেতা হুমায়ুন ফরীদি, শহীদুজ্জামান সেলিম, জাকিয়া বারী মম, সজল নূর, ক্রিকেটার মাশরাফি বিন মুর্তজা, মুশফিকুর রহিম প্রমুখ অন্যতম।
অর্জনের পাশাপাশি অপূর্ণতাও রয়ে গেছে অনেক, অর্ধশত বছর পেরিয়ে গেলেও অটোমেশনে সিস্টেম চালু করতে পারেনি প্রশাসন। প্রযুক্তির এই যুগে দেশ ও জাতিকে পথ দেখানো বিদ্যাপীঠ হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয় এগিয়ে আসবে এটাই সবার প্রত্যাশা। তথ্য-প্রযুক্তি সেলের দুর্বলতা ও অদক্ষ-অপ্রশিক্ষিত জনবল ও নানা কারণে অটোমেশন না হওয়ায় দুভোর্গ পোহাতে হচ্ছে শিক্ষার্থীদের। পরীক্ষার ফর্ম পূরণ, পরীক্ষার ফলাফল ও বিভিন্ন দাপ্তরিক কাজে দীর্ঘ সময় ভোগান্তিতে পড়েন তারা। তবে এরই মধ্যে ডিজিটাল নথি বা ডি-নথির আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু করেছে প্রশাসন।
এছাড়াও সেকেলেই পড়ে রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের দূর্বল ওয়েবসাইট। বর্তমানে আধুনিকতার যুগে তথ্যানুসন্ধানে মানুষ প্রতিষ্ঠানসমূহের ওয়েবসাইট ঘুরে দেখেন। এদিকে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে বিশ্ববিদ্যালয়ের সেকেলে ও দুর্বল ওয়েবসাইট। শিক্ষকদের প্রোফাইল হালনাগাদ না থাকার কারণে অনেক সময় সঠিক তথ্য পাওয়া যায় না। বহুবার তাগাদার পরও অনেক শিক্ষক প্রোফাইল তথ্য হালনাগাদ করেন না বলে অভিযোগ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের। বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইট বৈশ্বিক মান মূল্যায়নে ব্যবহৃত হয় উল্লেখ করে ওয়েবসাইটকে যুগোপযোগী করে তুলতে আন্তরিক হওয়ার তাগিদ অংশীজনদের।
শ্রেণিকক্ষ সংকটে দীর্ঘদিন ধরে ভুগছে বিভিন্ন বিভাগ ও ইন্সটিটিউট। আইন অনুষদ, ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদ, বায়োটেকনোলজি অ্যান্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ এবং বঙ্গবন্ধু তুলনামূলক সাহিত্য ও সংস্কৃতি ইন্সটিটিউটসহ বিভিন্ন বিভাগে রয়েছে শ্রেণিকক্ষ সংকট। সংকট সমাধানের দাবিতে একাধিকবার আন্দোলন করেছে ভুক্তভোগী শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। এদিকে নির্মণাধীন লেকচার থিয়েটার ও নির্মাণের অপেক্ষায় থাকা অনুষদ ভবনগুলোর কাজ শেষ হলে এ সংকট দূর হবে বলে মনে করেন উপাচার্য। নেই কোনো প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান। বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে অভিযাত্রার অর্ধ শতকেও কোনো প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে পারেনি জাবি। এ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানিয়ে আসছেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের অগ্রযাত্রায় প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন তারা।
স্বাধীনতার দীর্ঘদিনে জাবির প্রাপ্তি নেহায়ত কম নয়। তবে সংশ্লিষ্ট অংশীজনের প্রত্যাশা এবং প্রাপ্তির সমীকরণে রয়েছে বিস্তর পার্থক্য। অধিকতর উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়েছে কল্পনাতীত। নির্মিত হচ্ছে লেকচার থিয়েটার ও পরীক্ষার হল, যেখানে একসঙ্গে ৮ হাজার শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশ নিতে পারবেন। এমনকি নির্মাণাধীন রয়েছে স্পোর্টস কমপ্লেক্স ও ছয়তলা বিশিষ্ট নতুন লাইব্রেরি ভবন। তবে এসব উন্নয়নের ফলে নষ্ট হয়েছে প্রাকৃতিক পরিবেশ।
সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী আবু জাফর
যোগাযোগ: । [email protected] । বিজ্ঞাপন ও বার্তা সম্পাদক: 01894944220
ঠিকানা: বার্তা ও বাণিজ্যিক যোগাযোগ : বাড়ি নম্বর-২৩৪, খাইরুন্নেসা ম্যানশন, কাঁটাবন, নিউ এলিফ্যান্ট রোড, ঢাকা-১২০৫।
© 2025 Sangbad Sarabela All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh