ছবিঃ সংগৃহীত
বিশ্বের বেশির ভাগ উন্নত দেশেই চলচ্চিত্রে সেন্সর-প্রথা নেই; সার্টিফিকেশন বোর্ড রয়েছে। তবে এখনো ঢাকার সিনেমায় সেন্সর-প্রথা রয়ে গেছে। প্রচলিত সেন্সর-প্রথা বাতিল করে সার্টিফিকেশন বোর্ড করার দাবি তুলেছেন নির্মাতারা।
চলুন দেখে আসা যাক এ ব্যাপারে জনপ্রিয় নির্মাতারা কে কি বলেছেন।
আশফাক নিপুন, নির্মাতা
সেন্সর বোর্ডের কথা বলছি, এটা প্রাগৈতিহাসিক প্রথা। যেটা দিয়ে সিনেমা কিংবা শিল্পচর্চাকে আটকে দেওয়া হয়। ‘শনিবার বিকেল’, ‘নমুনা’, ‘মাই বাইসাইকেল’, ‘কাঠগোলাপ’, ‘অমীমাংসিত’ কোনো কারণ ছাড়াই আটকে দেওয়া হয়েছে। আবার অনেক সিনেমা কাটছাঁট করা হয়। এই পুরো প্রথাই শিল্পের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। শিল্পীর কাজ হচ্ছে, উন্মুক্তভাবে শিল্পচর্চা করা।
সেন্সর-প্রথা বাতিল করতে হবে। সেন্সর বোর্ডের ন্যারেটিভের মধ্যে শিল্পীর চিন্তাকে বন্দী রাখার চেষ্টা করা হয়। কেউ কেউ বলেন, সেন্সর বোর্ড না থাকলে অশ্লীলতা চরম আকার ধারণ করবে। কাটপিসের যুগেও কিন্তু সেন্সর বোর্ড ছিল। কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
আবার ওটিটির শুরুর দিকে কেউ কেউ বলছিলেন, ওটিটিতে অশ্লীলতা প্রচার করা হচ্ছে; ওটিটি বন্ধ করা হোক কিংবা নীতিমালা করা হোক। পরে কিন্তু কোনো নীতিমালা ছাড়া, সেন্সরশিপ ছাড়াই ‘মহানগর’, ‘কারাগার’, ‘কাইজার’, ‘নেটওয়ার্কের বাইরে’র মতো কাজ এসেছে। এগুলো দর্শকেরা গ্রহণ করেছে। দর্শকেরা ‘মহানগর ৩’ও চাইছে। এগুলো কোনো নীতিমালা কিংবা সেন্সর বোর্ড দিয়ে দিয়ে আটকানো হয়নি। যেটা গ্রহণ করার, সেটা দর্শক গ্রহণ করবেই।
পৃথিবীর কোথাও সেন্সর বোর্ড নেই। সেন্সর বোর্ড ঠিক করে দিতে পারে না, দর্শকেরা কী দেখবে আর কী দেখবে না। বিভিন্ন দেশে সার্টিফিকেশন বোর্ড আছে। সার্টিফেকশন বোর্ড থেকে সিনেমার গ্রেডিং দিয়ে দেওয়া হয়, আমাদের এখানেও সেই চর্চাই হওয়া উচিত। সার্টিফিকেশন বোর্ড ঠিক করবে, কোন সিনেমা কোন বয়সের উপযুক্ত। সংবিধানের ধারার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে করা গেলে খুব ভালো হয়।
রেদওয়ান রনি, নির্মাতা ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, চরকি
দুনিয়ার কোনো সভ্য দেশে সেন্সর-প্রথা আর নেই। বহু আগেই এটাকে সংস্কার করে সার্টিফিকেশন বোর্ড করা হয়েছে। সিনেমা সেন্সর করতে হবে, এ বিষয়টাই তো ভুল। সেন্সর-প্রথার মাধ্যমে সিনেমাকে আটকে রেখে সিনেমাকে পিছিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এটি যুগের সঙ্গে তাল মেলাতে তো পারছেই না, উল্টো পিছিয়ে দিচ্ছে।
বিদ্যমান সেন্সর-প্রথায় ভালো অনেক সিনেমা আটকে আছে। এখনো আলোর মুখ দেখেনি। এখন যেহেতু মতপ্রকাশের স্বাধীনতার কথা বলছি, এর সঙ্গে সেন্সরের ব্যাপারটাই সাংঘর্ষিক। কাজেই সেন্সর-প্রথা বাতিল করা উচিত।
বৈশ্বিক আদর্শ মেনে সার্টিফিকেশন হতে পারে। এটি নির্ধারণ করবে, কোন কনটেন্ট কোন বয়সের মানুষ দেখবে। এটা পুরো দুনিয়ায় অনুসরণ করা হয়। মাঝের সময়ে দেশেও সার্টিফিকেশন বোর্ডের আলাপ শুরু হয়েছিল। এর খসড়া নীতিমালা পড়েছি, সেটাও অনেক ত্রুটিতে ভরা। সার্টিফিকেশন বোর্ডের খসড়া বাতিল করে অংশীজনদের সঙ্গে নিয়ে নতুন করে কথা বলে দ্রুততম সময়ের মধ্যে করতে হবে।
শবনম ফেরদৌসী, নির্মাতা
ছোট–খাটো কারণে চলচ্চিত্র আটকে দেওয়া হয়। আমার জানামতে, বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ চলচ্চিত্র আজও সেন্সর পায়নি। অথচ অনেক নৃশংস ও নারীকে হেয় করা চলচ্চিত্র দিব্যি মুক্তি পায় এবং মহাসমারোহে হলে চলে। ক্রিটিক্যাল কোনো ছবি, যা দর্শককে ভাবায়, সেসব আটকে দেওয়া হয়। আগামী দিনে চাই, কোনো নির্মাতাকে যেন ‘সেলফ সেন্সরশিপ’ করতে না হয় তার ছবি নির্মাণের সময়। সেই সঙ্গে গ্রেডিং হলে ভালো হয়। উদার ও শিল্পবোধসম্পন্ন সেন্সর বোর্ড চাই।
কামার আহমাদ সাইমন, নির্মাতা
১৯১৮ সালে ব্রিটিশ উপনিবেশিত ভারতবর্ষের মানুষকে নিপীড়নের জন্য এই আইনটা করা হয়েছিল। তখন এর নাম ছিল সিনেমাটোগ্রাফ অ্যাক্ট। এরপর আইনটা প্রথমে পাকিস্তান, তারপর স্বাধীন বাংলাদেশে নতুন নতুন নামে হাজির হয়েছেমাত্র। কিন্তু এর মৌলিক প্রস্তাবনা বদলায়নি। সেন্সর বোর্ড হলো এই লিগ্যাসির গার্ডিয়ান, কতগুলো কাজকাম নাই টাইপের শিল্পী আর বাতিল আমলাদের মাস্তানির জায়গা। শিল্প, সাহিত্য আর সিনেমার মাধ্যমে মানুষের যৌথ প্রকাশ তো সমাজের মৌলিক অধিকার—একটি স্বাধীন দেশে তো সেন্সর বোর্ড বলে কিছু থাকার কথাই ছিল না। আগামী দিনে সেন্সর বোর্ড বলেই কিছু দেখতে চাই না। যেটা থাকতে পারে, সেটা হলো ছবির রেটিং বোর্ড। তবে সেটা অবশ্যই যেকোনো প্রকার আমলামুক্ত হতে হবে। পদাধিকারবলে আমলারা কেন ছবির সিদ্ধান্ত নেবেন? বাগান করতে চাইলে আপনি নিশ্চয়ই পশুবিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেবেন না, তাই না! এটা তো ভয়াবহ অন্যায়, ২০২৪–এর দ্বিতীয় স্বাধীনতার পর এটা আর চলতে দেওয়া যায় না। ছবির ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে হলে তাঁদেরই নেওয়া উচিত, যাঁরা শুধু সিনেমার হালহকিকতই নয়, সেই সঙ্গে তাবৎ দুনিয়ার শিল্প-সাহিত্য এবং নিজের চলতি সমাজের পালসটাও বোঝেন।
রায়হান রাফী, নির্মাতা
সেন্সর বোর্ডকে নির্মাতা, প্রযোজকের কাছে আতঙ্কের জায়গা হিসেবে তৈরি করা হয়েছে। তারা চাইলে কোনো ছবি আটকাতে পারে, চাইলে ছেড়ে দিতে পারে। আমার অমীমাংসিত নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আমি শুনেছি, ছবিটি প্রথমে সেন্সর বোর্ডে দেখে ছেড়ে দিয়েছিল। কোনো এক অজ্ঞাত কারণে আটকে দেওয়া হয়।
সারা পৃথিবীতে গ্রেডিং সিস্টেমে সেন্সর হয়। অনেকে বলে, আপনার সিনেমায় মারামারি, খুনোখুনি আছে। বাচ্চাদের দেখানো যাবে কি না? এটা আসলে সেন্সর বোর্ডই বলে দেবে, সারা পৃথিবীতে গ্রেডিং করা হয়। এটা ১৮ বছরের বেশিদের জন্য, এটা ১৬ বছরের বেশি বয়সীদের জন্য। গ্রেডিং সিস্টেম চালু হোক।
যেসব সিনেমা দেশ ও সার্বভৌমত্বকে আঘাত করে, সেগুলোর বিষয় আলাদা। একটু স্পর্শকাতর বিষয়, সত্য গল্প, যেটার সঙ্গে বাস্তবের মিল আছে, সেই সিনেমা আটকে দেওয়া হয়। এর মাধ্যমে পরিচালকদের গলা চেপে ধরে বোঝানো হয়, যা ইচ্ছা ভাবতে পারবেন না। এটা বন্ধ করা উচিত। যাদের সিনেমা সেন্সর বোর্ডে আটকানো আছে, অনতিবিলম্বে মুক্তি দেওয়া হোক। দর্শকদের সেগুলো দেখার সুযোগ করে দেওয়া হোক। পরিচালক হিসেবে একটা গল্প দর্শককে বলার অধিকার আছে।
সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী আবু জাফর
যোগাযোগ: । সম্পাদক: 01703-137775 । [email protected] । বিজ্ঞাপন ও বার্তা সম্পাদক: 01894944220
ঠিকানা: বার্তা ও বাণিজ্যিক যোগাযোগ : বাড়ি নম্বর-২৩৪, খাইরুন্নেসা ম্যানশন, কাঁটাবন, নিউ এলিফ্যান্ট রোড, ঢাকা-১২০৫।
© 2024 Sangbad Sarabela All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh