× প্রচ্ছদ বাংলাদেশ বিশ্ব রাজনীতি খেলা বিনোদন বাণিজ্য লাইফ স্টাইল ভিডিও সকল বিভাগ
ছবি ভিডিও লাইভ লেখক আর্কাইভ

গণ-আন্দোলনের পরও শ্রীলংকায় কমেনি দুর্ভোগ

আন্তর্জাতিক ডেস্ক

২৯ জুন ২০২২, ০৩:০৬ এএম

প্রতীকী ছবি

নজিরবিহীন অর্থনৈতিক সংকটে শ্রীলংকা। খাদ্যপণ্য থেকে জ্বালানির সংকটে ক্ষুব্ধ মানুষ সরকারবিরোধী আন্দোলন করেছেন দুই মাস আগে। জনরোষের মুখে প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপক্ষে পদত্যাগ করলেও স্থিতাবস্থা আসেনি দক্ষিণ এশিয়ার দ্বীপরাষ্ট্রটিতে।

তবে রাজপথ দুই মাস আগের মতো উত্তপ্ত নেই। বিরোধী দলগুলো রাজাপক্ষেদের দাবার চাল সম্মিলিতভাবে মোকাবেলা করতে পারেনি। সাধারণ জনগণের সঙ্গে শাসকদের সম্পর্কে যে ফাটল দেখা দিয়েছে, তার কোনো ভালো সমাধান এখনো কেউ হাজির করতে পারেনি। আর এতে ভুক্তভোগী জনগণের জীবনে নেই স্বস্তির কোনো আশা। কার্যত মানবিক সংকটের মুখে শ্রীলংকা এখনো।

১৯৪৮ সালে ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা পাওয়ার পর থেকে সংঘাত-সহিংসতায় নাস্তানাবুদ হতে হয়েছে ভারতের দক্ষিণ প্রান্তে অবস্থিত এই দ্বীপরাষ্ট্রটিকে। সিংহলিদের নিয়ন্ত্রণাধীন সরকারের সঙ্গে বিচ্ছিন্নতাবাদী লিবারেশন টাইগার্স অব তালিম ইলমের (এলটিটিই) মধ্যকার লড়াই চলে কয়েক দশক ধরে। এই গৃহযুদ্ধে প্রাণহানি হয় এক লাখের বেশি মানুষের। ২০০৯ সালে দীর্ঘ এই লড়াইয়ের অবসান ঘটে। তবে শ্রীলংকা সরকারের বিরুদ্ধে ব্যাপক মানধাধিকার লঙ্ঘন ও হত্যাযজ্ঞের অভিযোগ ওঠে। যদিও সিংহলিদের কাছে রাজাপক্ষের পরিবারই বীর হিসেবেই সম্মানিত হয়। তিন বছর আগেও গোতাবায়া রাজাপক্ষে নিরঙ্কুশ ভোটে জয়ী হয়ে প্রেসিডেন্ট হন। প্রেসিডেন্টের আরেক ভাই মাহিন্দা রাজাপক্ষে প্রধানমন্ত্রী। মন্ত্রিপরিষদ এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন এ পরিবারের কয়েক ডজন সদস্য।

তবে পরিস্থিতি পাল্টে যেতে থাকে ২০১৯ সাল থেকেই। ওই বছরের শেষ দিকে রাজাপক্ষে সরকার কর কর্তনের পদক্ষেপ নেয়। ফলে করোনা মহামারির শুরুর কয়েক মাস আগেই সরকারের রাজস্ব ব্যাপকভাবে কমে যায়। প্রবাসী শ্রীলংকানদের পাঠানো রেমিট্যান্সেও ভাটা পড়ে। করোনা মহামারি শুরুর পর প্রবাসীদের অনেকে চাকরি হারান। ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব পড়ে দেশটির প্রধান অর্থনৈতিক খাত পর্যটনে।

বৈদেশিক মুদ্রার আয় কমার সঙ্গে সঙ্গে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধে হিমশিম খেতে থাকে শ্রীলংকা। এই ঋণের বড় অংশই ছিল উচ্চাভিলাষী অবকাঠামোগত প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য চীনের কাছ থেকে নেওয়া অর্থ। এমনকি ভারতের মতো প্রতিবেশীদের কাছেও দেনাদার হয়ে পড়ে শ্রীলংকা। পরিস্থিতি আরও খারাপ হয় ২০২১ সালে রাজাপক্ষের জৈব সারভিত্তিক চাষের সিদ্ধান্ত। এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে গিয়ে রাসায়নিক সারের ব্যবহার নিষিদ্ধ করায় বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন কৃষকরা। রাতারাতি এমন পদক্ষেপে দেখা যায়, চা ও ধান উৎপাদনে ধস নামে।

বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ রেকর্ড পরিমাণ তলানিতে নামার পর শ্রীলংকার ৮ হাজার ১০০ কোটি ডলারের অর্থনীতি এখন পুরোপুরি ধসে পড়েছে। ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযানের প্রভাবে বিশ্বব্যাপী জ্বালানি তেল ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়ে গেছে। এর আঁচ লাগে শ্রীলংকায়ও। গত কয়েক বছরের মধ্যে শ্রীলংকায় এখন মুদ্রাস্ফীতি সর্বোচ্চ। জ্বালানি তেলসহ খাদ্য ও ওষুধের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানির নিয়মিত অর্থ পরিশোধে ব্যর্থ হতে থাকে সরকার।

এক সময় যে ভোটাররা রাজাপক্ষে পরিবারকে নিরঙ্কুশ সমর্থন দিয়ে এসেছেন, তারা প্রতিদিন জীবনযাপনে সরকারের বিতর্কিত নীতি দ্বারা আক্রান্ত হতে থাকেন। গত মার্চ থেকে বিদ্যুৎ সংকটে গৃহস্থালির কাজকর্ম ও ব্যবসা-বাণিজ্য চালিয়ে নেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। জ্বালানি তেলের জন্য পাম্প স্টেশনগুলোতে লম্বা লাইন তৈরি হতে থাকে। নিত্যদিনের খাদ্যপণ্যের সংকট তৈরি হয়। জীবন রক্ষাকারী ওষুধও পাওয়া যাচ্ছে না। সবকিছুই হয়ে পড়ে ব্যয়বহুল, যা সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে যায়। এ অবস্থায় রাজাপক্ষের বিরোধীরা তার পদত্যাগের বিক্ষোভের ডাক দেয়। এতে ব্যাপক জনগণের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে আন্দোলন ক্রমেই তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে। 

তবে আজকের বাস্তবতা হলো- আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে শ্রীলংকা নিয়ে দুই মাস আগের মতো আর আগ্রহ নেই। রাজপথ দুই মাস আগের মতো উত্তপ্ত নেই। বিরোধী দলগুলো রাজাপক্ষেদের মোকাবেলা করতে পারেনি। চীন-ভারতও সেখানকার শাসকদের সমর্থন দিচ্ছে। অথচ সেখানে দৈনন্দিন সংকটের তীব্রতা মোটেও কমেনি। বাড়তি দাম দিয়ে খাদ্যশস্য কেনা গেলেও গ্যাস খুব দুর্লভ। মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত পরিবারগুলোতে তরুণেরা একদিকে জিনিসপত্রের বাড়তি দাম জোগাড় করতে পেশাগত জীবনে দিশাহারা। অন্যদিকে নারী, শিশু আর বৃদ্ধদের দীর্ঘ সময় যাচ্ছে গ্যাসের খোঁজে। কলম্বোয় দৈনন্দিন চাহিদার তিন ভাগের এক ভাগ জ্বালানি পাওয়া যাচ্ছে। সশস্ত্র সেনা পাহারা ছাড়া গ্যাস সিলিন্ডার বিতরণ করা যাচ্ছে না। সংকট মেটেনি বিদ্যুৎ সরবরাহেও। দেখা দিয়েছে জ্বালানি তেলের জন্য তীব্র হাহাকার। গত এক সপ্তাহে পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। দেশটিতে এই মুহূর্তে যে পরিমাণ তেল মজুদ আছে, তা কয়েক দিনের মধ্যেই শেষ হয়ে যাবে বলে জানিয়েছেন জ্বালানিমন্ত্রী কাঞ্চনা উইজেসেকরা। গত সাত দশকে এমন সংকটের মধ্যে পড়েননি দেশটির বাসিন্দারা। 

তবে আপাতত বিক্ষোভ কমিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে রাজাপক্ষে পরিবার। মাহিন্দা খুব স্পষ্টভাবেই চীনের দিকে ঝুঁকেছিলেন, যা ভারত খুব সহজভাবে মেনে নেয়নি। প্রধানমন্ত্রী পদে রদবদলে রাজাপক্ষে পরিবারের প্রতি জনরোষ যেমন কমেছে, তেমনি ভারত-চীন দুই প্রতিবেশীর কাছ থেকেও সমর্থন পাওয়া গেছে। প্রেসিডেন্ট তার বিদেশি বন্ধুদের বোঝাতে পেরেছেন, তিনি বিরোধী শিবিরকে সঙ্গে নিয়ে সংকট সামাল দিতে চান। তবে বিরোধী শিবিরের প্রধান দল সাজিথ প্রেমাদাসার ‘সঙ্গী জন বালাওয়াগা’ গোতাবায়ার পদত্যাগের দাবিতে অনড় এখনো।

রনিলকে পাশে পেয়ে ক্ষমতা আগের মতো গোতাবায়ার হাতেই আছে। দেশটির শক্তিশালী সামরিক আমলাতন্ত্রের জন্যও এ সমাধান স্বস্তিকর। তাতে ক্ষমতাকাঠামোতে এমন কেউ ঢুকতে পারছে না, যারা রাষ্ট্রকাঠামোরই সংস্কার করতে চান। কার্যত বিক্রমাসিংহের ‘সহযোগিতা’য় রাজাপক্ষে পরিবার গণ-অভ্যুত্থানের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে। রনিল জাতীয় ঐক্যের নামে রাজনৈতিক সংস্কারের প্রশ্নটিকেই কার্যত আড়াল করেছেন- বলছেন অর্থনৈতিক সংস্কারের কথা। যদিও নিজের অবস্থানকে ন্যায্যতা দিতে তিনি সংবিধান পরিবর্তনেরও ডাক দিয়েছেন।

পার্লামেন্টে সংবিধানের ২১তম সংশোধনীর প্রস্তাব পেশ করা হয়েছে। সেখানে প্রেসিডেন্ট পদের ক্ষমতা কমিয়ে তা মন্ত্রিসভার হাতে ন্যস্ত করার কথা বলা হয়েছে। প্রস্তাবিত সংশোধনীতে আরও বলা হয়, এমন একটি ‘সাংবিধানিক পরিষদ’ করা, যা সাংবিধানিক পদগুলোর নিয়োগ দেবে। এসব পদে নিয়োগ ও পরিবর্তনের ক্ষমতা প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে সরানোর দাবি শ্রীলংকায় বেশ পুরনো। তবে রনিল চাইলেও প্রেসিডেন্টের নির্বাহী ক্ষমতা কমানোর ক্ষমতা তার নেই। পার্লামেন্টের সংখ্যাগরিষ্ঠ দল ‘পডুজানা পেরামুনা’র নেতৃত্ব রাজাপক্ষে পরিবারের হাতেই রয়েছে। তারা সিংহলি-বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদের ধারক। শ্রীলংকার আমলাতন্ত্র, নিরাপত্তা বাহিনী, সামরিক বাহিনীসহ দেশটির সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণও এ দ্বারা প্রভাবিত। এ বিক্ষোভ কমে এলে ওই জাতীয়তাবাদী ভাবাবেগেই সব চালিত হতে পারে। তাই তারা সিংহলি আধিপত্য কমার বিপক্ষে।

কলম্বোভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি অলটারনেটিভসের নির্বাহী পরিচালক পাকিয়াসোথি সারাভানামুত্তু বলেন, ‘বিক্ষোভকারীরা প্রেসিডেন্টের শুধু পদত্যাগ চান না, তারা তার দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য জবাবদিহির মুখোমুখি করার দাবিও জানিয়েছেন। তারা একটি নতুন শ্রীলংকা চান, আর পুরনো কার্ডের রদবদল নয়। পুরনো লোককে রেখেও রাজনীতিতে মৌলিক পুনর্বিন্যাস সম্ভব নয়। গোতাবায়েকে রক্ষা করার বিষয়ে রাজনীতিবিদদের সতর্ক হওয়া উচিত। নয়তো জনগণ এটাকে বিশ্বাসঘাতকতা হিসেবে দেখবে।’

Sangbad Sarabela

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী আবু জাফর

যোগাযোগ: । 01894-944220 । [email protected], বিজ্ঞাপন: 01894-944204

ঠিকানা: বার্তা ও বাণিজ্যিক যোগাযোগ : বাড়ি নম্বর-২৩৪, খাইরুন্নেসা ম্যানশন, কাঁটাবন, নিউ এলিফ্যান্ট রোড, ঢাকা-১২০৫।

আমাদের সঙ্গে থাকুন

© 2024 Sangbad Sarabela All Rights Reserved.