মালদ্বীপকে একটি বিশেষ যুদ্ধজাহাজসহ আরও আধুনিক সমরাস্ত্র সরবরাহের ঘোষণা দিয়েছে তুরস্ক, যা দুই দেশের মধ্যে প্রতিরক্ষা সহযোগিতার এক নতুন অধ্যায় সূচনা করছে। মালদ্বীপের নৌবাহিনীর জন্য তুরস্ক যেই জাহাজটি দিচ্ছে, সেটির নাম টিসিজি ভলকান (পি-৩৪৩)। এটি দোয়ান-শ্রেণির একটি দ্রুতগতির আক্রমণাত্মক নৌযান, যা এর আগে তুরস্কের নৌবাহিনীতে সক্রিয়ভাবে ব্যবহৃত হয়েছে। ঘোষণা অনুযায়ী, এই জাহাজটি এপ্রিল থেকে জুনের মধ্যে মালদ্বীপে পাঠানো হবে এবং জুলাই মাসে আনুষ্ঠানিকভাবে মালদ্বীপের নৌবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করা হবে।

জাহাজটি হস্তান্তরের পাশাপাশি তুরস্কের একটি নৌ-প্রশিক্ষণ দল মালদ্বীপে পৌঁছে এর প্রযুক্তি ও অস্ত্র সিস্টেম পরিচালনায় স্থানীয় নৌসেনাদের প্রশিক্ষণ দেবে। দুই সপ্তাহব্যাপী এই প্রশিক্ষণ কর্মসূচি ইতোমধ্যেই তুরস্কে শুরু হয়েছে, যার সমাপ্তি হবে ৯ মে। এই উদ্যোগের মাধ্যমে শুধু একটি যুদ্ধজাহাজ নয়, বরং প্রযুক্তিগত সহায়তা এবং সামরিক সক্ষমতা স্থানান্তরের দ্বারও খুলে যাচ্ছে।

টিসিজি ভলকান মূলত জার্মানির বিখ্যাত জাহাজ নির্মাতা প্রতিষ্ঠান লরসেন ওয়ারফটে দ্বারা নির্মিত। এটি ১৯৮১ সালে তুরস্কের নৌবাহিনীতে যুক্ত হয় এবং সেসময় হারপুন অ্যান্টি-শিপ মিসাইলসহ সজ্জিত হয়ে তুরস্কের সামুদ্রিক সক্ষমতায় বড় অবদান রাখে। যদিও এটি বর্তমানে তুলনামূলক পুরনো, ২০২৪ সালে এটিকে পুনর্গঠন ও রক্ষণাবেক্ষণের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ ও সীমিত সমুদ্র অভিযান উপযোগী জাহাজে রূপান্তর করা হয়েছে। এর দৈর্ঘ্য ৫৮.১ মিটার, প্রস্থ ৭.৬ মিটার, এবং এটি ৩৬ নট গতিতে চলতে সক্ষম। ৩০ নট গতিতে এটি ১,০৫০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত যাত্রা করতে পারে।

মালদ্বীপের জন্য এই জাহাজের প্রাপ্তি কৌশলগত দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দেশটির বিশাল অর্থনৈতিক জলসীমা, যা প্রায় ৯ লাখ বর্গকিলোমিটার জুড়ে বিস্তৃত, রক্ষার দায়িত্ব মালদ্বীপ ন্যাশনাল ডিফেন্স ফোর্সের ওপর রয়েছে। এতদিন তারা সীমিত পরিসরের, ছোট আকারের নৌযান দিয়ে এই বিশাল দায়িত্ব পালন করছিল। টিসিজি ভলকান যুক্ত হওয়ায় তাদের টহল ও উপকূলীয় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় এক বিশাল অগ্রগতি ঘটবে। এছাড়া, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্রমবর্ধমান দুর্যোগ পরিস্থিতিতে উদ্ধার ও মানবিক সহায়তার ক্ষেত্রেও এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে।

তবে সবকিছু ইতিবাচক না-ও হতে পারে। বিশেষজ্ঞদের একাংশ বলছে, এই অনুদান হয়তো তুরস্কের একটি বৃহত্তর অস্ত্র চুক্তির অংশ, যার মধ্যে রয়েছে প্রায় ৩২.৪ মিলিয়ন ডলারে ৩৫টি স্বল্পপাল্লার ভূমি-থেকে-আকাশ ক্ষেপণাস্ত্র ক্রয়ের প্রস্তাব। ফলে, ‘বিনামূল্যে সহায়তা’ হিসেবে উপস্থাপিত হলেও এই জাহাজটি রক্ষণাবেক্ষণের খরচ মালদ্বীপের সীমিত প্রতিরক্ষা বাজেটের ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করতে পারে।

অন্যদিকে, ভারতের জন্য এই হস্তান্তর কৌশলগতভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও কিছুটা উদ্বেগজনক। মালদ্বীপ বরাবরই ভারতের ‘নিকট প্রতিবেশী’ নীতির গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে বিবেচিত। ভারতের দক্ষিণ উপকূলের একেবারে সন্নিকটে অবস্থিত মালদ্বীপ, যার মধ্য দিয়ে অতিক্রম করে বিশ্বের অন্যতম ব্যস্ত সামুদ্রিক বাণিজ্যপথ। এ অবস্থানে তুরস্কের মতো একটি আঞ্চলিক শক্তিধর দেশের উপস্থিতি ভারতের নিরাপত্তা নীতিকে স্পষ্টভাবে চ্যালেঞ্জ করছে।

তুরস্ক শুধুমাত্র যুদ্ধজাহাজ দিচ্ছে না—তারা ইতোমধ্যে ড্রোন বিক্রি, প্রশিক্ষণ সহায়তা এবং ক্ষেপণাস্ত্র চুক্তির মতো পদক্ষেপ নিয়েছে, যা ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে তাদের সক্রিয় সামরিক উপস্থিতির ইঙ্গিত বহন করে। বিশেষ করে তুরস্কের বিমানবাহী রণতরী ও ডেস্ট্রয়ার নির্মাণ প্রকল্প, এই অঞ্চলে তাদের দীর্ঘমেয়াদি ভূ-রাজনৈতিক লক্ষ্যকে আরও স্পষ্ট করছে।

এই প্রেক্ষাপটে, মালদ্বীপের বর্তমান প্রেসিডেন্ট মুহাম্মদ মুইজ্জুর নেতৃত্বে দেশটির পররাষ্ট্রনীতিতে যে ধীরে ধীরে একটি স্খলন ঘটছে—ভারতের ঘনিষ্ঠতা থেকে চীন ও তুরস্কের দিকে ঝুঁকে পড়ছে—তাও নয়াদিল্লিকে চিন্তিত করে তুলেছে।