ছবি: সংগৃহীত।
ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় চলমান সংঘাত শুরুর পর থেকে প্রায় দুই বছর পেরিয়ে গেছে। এ সময়ে গাজায় ইসরায়েলি হামলায় ৬০ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন এবং উপত্যকা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। এই দীর্ঘ যুদ্ধে অবসান ঘটাতে হোয়াইট হাউস ২০ দফা বিশিষ্ট একটি তাৎক্ষণিক যুদ্ধবিরতি পরিকল্পনা ঘোষণা করেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নেতৃত্বে তৈরি এই পরিকল্পনায় বলা হয়েছে, উভয় পক্ষ যদি এটি গ্রহণ করেন, তবে গাজায় ইসরায়েলের যুদ্ধ তাৎক্ষণিকভাবে বন্ধ হবে এবং জীবিত ও মৃত জিম্মিদের ৭২ ঘণ্টার মধ্যে মুক্তি দিতে হবে। বিনিময়ে, ইসরায়েলের কারাগারে থাকা ফিলিস্তিনি বন্দীদের মুক্তি দেওয়া হবে।
পরিকল্পনায় আরও উল্লেখ রয়েছে, গাজা উপত্যকায় অস্থায়ীভাবে একটি টেকনোক্র্যাট সরকারের মাধ্যমে প্রশাসন চালানো হবে, যেখানে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী গোষ্ঠী হামাসের কোনো ভূমিকা থাকবে না। পাশাপাশি, ইসরায়েল গাজা উপত্যকার কোনো ভূখণ্ড দখল করতে পারবে না।
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু ইতিমধ্যে এই পরিকল্পনা মেনে নিয়েছেন বলে হোয়াইট হাউস জানিয়েছে। তবে হামাসের কর্মকর্তা মাহমুদ মারদাবি কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরাকে জানিয়েছেন, তারা এখনও লিখিত কোনো শান্তি পরিকল্পনা পাননি এবং এই প্রস্তাব নিয়ে তাদের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক কোনো বক্তব্য নেই।
গাজায় ইসরায়েলি গণহত্যা বন্ধে ট্রাম্পের ২০ দফা পরিকল্পনা
• গাজাকে উগ্রবাদ ও সন্ত্রাসমুক্ত অঞ্চল হিসেবে গড়ে তোলা হবে; যা প্রতিবেশীদের জন্য কোনও হুমকি তৈরি করবে না।
• গাজা উপত্যকাকে পুনর্গঠন করা হবে সেখানকার জনগণের কল্যাণের জন্যই; যারা ইতোমধ্যে প্রচুর ভুগেছেন।
• এই প্রস্তাবে যদি উভয়পক্ষ রাজি হয়, তাহলে তাৎক্ষণিকভাবে যুদ্ধ বন্ধ হবে। ইসরায়েলি বাহিনী জিম্মিদের মুক্তির প্রস্তুতির জন্য নির্ধারিত সীমারেখায় সরে যাবে। এ সময়ে সব ধরনের সামরিক অভিযান; বিমান হামলা ও কামানের গোলা নিক্ষেপ বন্ধ থাকবে। ধাপে ধাপে সৈন্য প্রত্যাহারের সব শর্ত পূরণ না হওয়া পর্যন্ত যুদ্ধরেখা স্থির থাকবে।
• ইসরায়েল প্রকাশ্যে এই চুক্তি মেনে নেওয়ার ৭২ ঘণ্টার মধ্যে জীবিত ও মৃত সব জিম্মিকে ফেরত দেওয়া হবে।
• সব জিম্মি ফেরতের পর ইসরায়েল যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত ২৫০ জন বন্দী এবং ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের পর নারী ও শিশুসহ আটক ১ হাজার ৭০০ গাজাবাসীকে মুক্তি দেবে। প্রত্যেক ইসরায়েলি জিম্মির মৃতদেহ ফেরতের বিনিময়ে ইসরায়েল ১৫ জন গাজাবাসীর মরদেহ ফেরত দেবে।
• সব জিম্মিকে ফেরত দেওয়ার পর হামাসের যেসব সদস্য শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হবেন এবং অস্ত্র সমর্পণ করবেন, তাদের জন্য সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা হবে। আর হামাসের যে সদস্যরা গাজা ছেড়ে যেতে চাইবেন, তাদের নিরাপদে গ্রহণকারী দেশে পৌঁছে দেওয়া হবে।
• চুক্তি মেনে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাৎক্ষণিকভাবে গাজায় পুরোপুরি মানবিক সহায়তা পাঠানো হবে। ন্যূনতম সাহায্যের পরিমাণ ১৯ জানুয়ারি ২০২৫ সালের মানবিক সহায়তা চুক্তির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে। অবকাঠামো (পানি, বিদ্যুৎ, বর্জ্য ব্যবস্থা) পুনর্গঠন, হাসপাতাল ও বেকারি মেরামত, ধ্বংসস্তূপ অপসারণ ও সড়ক খুলে দেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম গাজায় প্রবেশ করবে।
• জাতিসংঘ ও এর অঙ্গ সংগঠনের পাশাপাশি রেড ক্রিসেন্ট এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান, যারা কোনো পক্ষের সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়, তাদের মাধ্যমে সহায়তা প্রবেশ ও বিতরণ করা হবে। এতে কোনো পক্ষ হস্তক্ষেপ করবে না। রাফাহ সীমান্ত উভয় দিক থেকে খোলার বিষয়ে ২০২৫ সালের ১৯ জানুয়ারি কার্যকর হওয়া চুক্তির আওতায় একই প্রক্রিয়ায় চালু থাকবে।
• একটি অরাজনৈতিক, টেকনোক্র্যাট ফিলিস্তিনি কমিটির অস্থায়ী অন্তর্বর্তী শাসনের আওতায় গাজা পরিচালিত হবে। যারা গাজার জনগণের জন্য দৈনন্দিন জনসেবা ও পৌর কার্যক্রম পরিচালনা করবে। এই কমিটি যোগ্য ফিলিস্তিনি ও আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের নিয়ে গঠন করা হবে। এর তদারকি করবে নতুন আন্তর্জাতিক অন্তর্বর্তী সংস্থা ‘বোর্ড অব পিস’। যার নেতৃত্ব দেবেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। সংস্থাটির সদস্য সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার ও অন্যান্য রাষ্ট্রপ্রধানদের নাম পরবর্তীতে ঘোষণা করা হবে। এই সংস্থা গাজা পুনর্গঠনের জন্য কাঠামো নির্ধারণ ও অর্থায়নের কাজ পরিচালনা করবে। ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের নিজেদের সংস্কার কর্মসূচি সম্পন্ন এবং নিরাপদ ও কার্যকরভাবে গাজার নিয়ন্ত্রণ পুনরায় গ্রহণে সক্ষম না হওয়া পর্যন্ত এই সংস্থা তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাবে। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী, গাজায় আধুনিক ও কার্যকর শাসন ব্যবস্থা গড়ে তুলবে সংস্থাটি; যা বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে সক্ষম হবে।
• গাজার পুনর্গঠন ও উন্নয়নের জন্য ট্রাম্পের অর্থনৈতিক উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নে বিশেষজ্ঞ প্যানেল গঠন করা হবে। এই প্যানেলে থাকবেন মধ্যপ্রাচ্যের আধুনিক সমৃদ্ধ শহরগুলোর উন্নয়নে ভূমিকা রাখা বিশেষজ্ঞরা। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার বিনিয়োগ পরিকল্পনা ও উন্নয়নের ধারণা বিবেচনা নেওয়া হবে। এসব প্রস্তাবনা সেখানকার নিরাপত্তা ও শাসন কাঠামোর সঙ্গে সমন্বয় করা হবে, যাতে বিনিয়োগ আকৃষ্ট ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং গাজার ভবিষ্যতের জন্য সুযোগ ও আশা তৈরি হয়।
• গাজায় একটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করা হবে, যেখানে অংশগ্রহণকারী দেশগুলোর সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে শুল্ক ও প্রবেশাধিকার সুবিধা নির্ধারিত থাকবে। কাউকে গাজা ছেড়ে যেতে বাধ্য করা হবে না। যারা যেতে চাইবেন, তারা স্বাধীনভাবে যেতে ও ফিরে আসতে পারবেন। তবে লোকজনকে সেখানে থাকার জন্য উৎসাহিত করা এবং উন্নত গাজা গড়ার সুযোগ দেওয়া হবে।
• হামাস ও অন্যান্য দল গাজা শাসনে প্রত্যক্ষ, পরোক্ষ কিংবা অন্য কোনও উপায়েও ভূমিকা রাখতে পারবে না। সব ধরনের সামরিক স্থাপনা, অস্ত্রাগার, টানেল ও অস্ত্র উৎপাদন ব্যবস্থা ধ্বংস করা হবে এবং এগুলো আর পুনর্নির্মাণ করা হবে না। নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষকদের তত্ত্বাবধানে গাজার নিরস্ত্রীকরণ প্রক্রিয়া পরিচালনা করা হবে। অস্ত্র স্থায়ীভাবে নিষ্ক্রিয় করা হবে। আন্তর্জাতিকভাবে অর্থায়নকৃত অস্ত্র ক্রয়-ফেরত ও পুনর্বাসন কর্মসূচির মাধ্যমে এই কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে; যা নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষকরা যাচাই-বাছাই করে দেখবেন। সমৃদ্ধ অর্থনীতি গড়ে তোলা এবং প্রতিবেশীদের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের বিষয়ে নতুন গাজা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকবে।
• হামাস ও অন্যান্য গোষ্ঠী তাদের দায়বদ্ধতা মেনে চলবে, আঞ্চলিক অংশীদাররা এমন নিশ্চয়তা দেবেন। নতুন গাজা তার প্রতিবেশী কিংবা জনগণের জন্য কোনও হুমকি তৈরি করবে না।
• আরব ও আন্তর্জাতিক অংশীদারদের সঙ্গে মিলে গাজায় তাৎক্ষণিকভাবে মোতায়েনের জন্য একটি অস্থায়ী আন্তর্জাতিক বাহিনী ‘ইন্টারন্যাশনাল স্ট্যাবিলাইজেশন ফোর্স (আইএসএফ) গঠন করা হবে। এই বাহিনী যাচাই করা ফিলিস্তিনি পুলিশ বাহিনীকে প্রশিক্ষণ ও সহায়তা দেবে। জর্ডান ও মিসরের সঙ্গে পরামর্শ করবে; যাদের এ ক্ষেত্রে ব্যাপক অভিজ্ঞতা রয়েছে। এই বাহিনী দীর্ঘমেয়াদি অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা সংকটের সমাধান করবে। আইএসএফ নতুন প্রশিক্ষিত ফিলিস্তিনি পুলিশ বাহিনীর সঙ্গে ইসরায়েল ও মিসরের সহযোগিতায় সীমান্ত এলাকা সুরক্ষিত করার কাজ করবে। গাজায় অস্ত্রের প্রবেশ ঠেকানো এবং পুনর্গঠন ও পুনরুজ্জীবনের জন্য পণ্যের দ্রুত ও নিরাপদ সরবরাহ নিশ্চিত করবে এই বাহিনী। এ জন্য সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে সংঘর্ষ-এড়ানোর প্রক্রিয়ায় সম্মত হতে হবে।
• ইসরায়েল গাজা দখল কিংবা সংযুক্ত করবে না। আইএসএফ গাজায় নিয়ন্ত্রণ ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা করবে। এরপর ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) নির্ধারিত সময়সীমা অনুযায়ী, ধাপে ধাপে সৈন্য প্রত্যাহার করবে। যা আইডিএফ, আইএসএফ ও নিশ্চয়তা প্রদানকারী রাষ্ট্র এবং যুক্তরাষ্ট্রের মাঝে সমঝোতার ভিত্তিতে নির্ধারিত হবে। এসবের লক্ষ্য হবে নিরাপদ গাজা গড়ে তোলা; যা আর ইসরায়েল, মিসর কিংবা তাদের নাগরিকদের জন্য হুমকি তৈরি করবে না। অন্তর্বর্তী কর্তৃপক্ষের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী , আইডিএফ ধাপে ধাপে গাজার নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলগুলো আইএসএফের হাতে তুলে দেবে। শেষ পর্যন্ত ইসরায়েলি সব সৈন্য পুরোপুরি প্রত্যাহার করা হবে। তবে গাজা পুনরায় সন্ত্রাসের হুমকি থেকে যথাযথ সুরক্ষিত না হওয়া পর্যন্ত নিরাপত্তা বেষ্টনী বজায় রাখবে আইডিএফ।
• যদি হামাস এই প্রস্তাব বিলম্বিত কিংবা প্রত্যাখ্যান করে, তাহলেও সব পরিকল্পনা বাস্তবায়ন ও সন্ত্রাসমুক্ত এলাকায় সহায়তা কার্যক্রম পরিচালনার দায়িত্ব আইএসএফের হাতে তুলে দেবে আইডিএফ।
• সহনশীলতা ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের মূল্যবোধের ভিত্তিতে একটি আন্তঃধর্মীয় সংলাপ প্রক্রিয়া শুরু করা হবে; যাতে ফিলিস্তিনি ও ইসরায়েলিদের দৃষ্টিভঙ্গি ও বর্ণনা পরিবর্তনের চেষ্টা করা যায়।
• গাজার পুনর্গঠনের চলাকালীন এবং ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের সংস্কার কর্মসূচি সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হলে ফিলিস্তিনিদের আত্মনিয়ন্ত্রণ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বিশ্বাসযোগ্য পথ তৈরির শর্ত তৈরি হতে পারে—যা ফিলিস্তিনি জনগণের আকাঙ্ক্ষা হিসেবে স্বীকৃত।
• ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনিদের মধ্যে সংলাপের আয়োজন করবে যুক্তরাষ্ট্র; যাতে শান্তিপূর্ণ ও সমৃদ্ধ সহাবস্থানের একটি রাজনৈতিক দিকনির্দেশনায় ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারেন তারা।
সূত্র: আল জাজিরা
সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী আবু জাফর
যোগাযোগ: । [email protected] । বিজ্ঞাপন ও বার্তা সম্পাদক: 01894944220
ঠিকানা: বার্তা ও বাণিজ্যিক যোগাযোগ : বাড়ি নম্বর-২৩৪, খাইরুন্নেসা ম্যানশন, কাঁটাবন, নিউ এলিফ্যান্ট রোড, ঢাকা-১২০৫।
© 2025 Sangbad Sarabela All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh