(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
এই পরিবর্তনের মাঝেও বাঙালি সংস্কৃতি মাথা উচু করে দাঁড়িয়ে থাকে আপন মহিমায়। ইংরেজদেরকে স্বাগত জানিয়ে এক শ্রেণির হিন্দু বাবুরা পুরোদস্তর ইংরেজি কায়দা রপ্তে অধিক মাত্রায় গদগদ হলেও সবার অজান্তেই বাঙালির দর্শন- বাউল দর্শন ঠিকই শহরের রোসনাইতেও কদরদানি পায়।
অনেক গবেষকের মতে বাউল দর্শন রবীন্দ্রনাথের হাত ঘুরে সুধী সমাজে প্রবেশের সুযোগ পায়, কথাটি সত্য নয়। কারণ রবীন্দ্রনাথের জন্মের বহু পূর্বে রাজা রামমোহন রায়, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিহারিলাল রায় এঁরা সবাই বাউল দর্শনকে মরমের আতরদানিতে ভিজিয়ে রাখে। যার অনিবার্য ফল দাঁড়ায় শহরের এই নব্য বাবু হওয়ার কোলাকহলের মধ্যেও কৈশোর পেরনো রবীন্দ্রনাথ বাউল দর্শনের উপর প্রবন্ধ লিখলেন ১৮৮৩ সালে। আর রবীন্দ্রনাথের হাত ধরে বাউল দর্শন সুধী সমাজে অনুপ্রবেশের গবেষকদের যে দাবী তা মূলত সংঘটিত হয়েছিলো বিশ শতকের গোড়ার দিকে। তবে এ কথা আমাদের সবাইকেই স্বীকার করতে হবে যে রবীন্দ্রনাথের মধ্য দিয়েই বাউল দর্শন বিশ্ব দর্শনের মান মন্দিরে পরিচিতি লাভ করে। এটাও বাউল দর্শনের প্রতি বিশ্বকবির মুগ্ধতার ফসল। রবীন্দ্রনাথ বাংলাভাষার শ্রেষ্ঠ কবি। বাঙালি মানসের প্রতিভূ। সুতরাং রবীন্দ্রনাথে বাউল দর্শন অনিবার্যভাবে একাকার হবে, এ বিষয়ে বাদানুবাদ করার কোন সুযোগ নেই।
ঠাকুর পরিবারে বাউল দর্শনের কদরদানী, রবীন্দ্রনাথ-পিতা দেবেন্দ্রনাথের ব্রহ্মধর্মে আত্মনিয়োগ, ব্রাহ্মধর্মে বাউল দর্শনের প্রভাব, দেবেন্দ্রনাথের সঙ্গে বাউল ফকির লালন শাহের ব্যক্তিগত ভাব-সম্পর্ক গড়ে ওঠা, রবীন্দ্র-ভ্রাত্রা জ্যোতিরিন্দ্র নাথের সাথে লালন শাহের ঘনিষ্ঠতা সবকিছু মিলিয়েই রবীন্দ্র মানসে বাউল প্রভাব আস্তে আস্তে দাগ কাটতে থাকে।
লালন এবং রবীন্দ্রনাথের মুখোমুখি সাক্ষাৎ নিয়ে গবেষকগণের মধ্যে মতভেদ থাকলেও রবীন্দ্র মানসে লালন দর্শন তথা বাউল দর্শনের প্রভাবের কথা অস্বীকার কোন সুযোগ কারোরই নেই । আবার রবীন্দ্র-লালনের মুখোমুখি সাক্ষাতের ব্যাপারটা যে একেবারেই অসম্ভব এমনটি বলাও মুসকিল। কারণ রবীন্দ্রনাথ ১৮৯০ সালের শেষের দিকে জমিদারীর দায়িত্ব নিয়ে কুষ্টিয়ার শিলাইদহে আসার পূর্বে ১৮৭২ এবং ১৮৭৫ তিনি জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে শিলাইদহে এসেছিলেন। এবং এই পর্বে রবীন্দ্রনাথের সাথে লালনের দেখা হয়েছে বলে অনেক গবেষক দৃঢ়ভাবে মত ব্যক্ত করেছেন। ডক্টর আনোয়ারুল করীম, মুহাম্মদ আবূ তালিব প্রমুখ গবেষকগণের তাই মত। লালন শাহের প্রথম জীবনীকার বসন্ত রঞ্জন পাল রবীন্দ্রনাথের কাছে সহযোগিত চেয়ে চিঠি লিখলে তার জবাবে কবির পক্ষে তাঁর একান্ত সচিব সুধীর চন্দ্রকর কর্তৃক ১৯৩৯ সালে লিখিত পত্রে রবীন্দ্রনাথ নিজেও স্পষ্টভাবে না হলেও কবুল করে নিয়েছেন ব্যাপারটি। চিঠিতে বলা হয়.‘ কবি আপনার চিঠি পেয়ে সুখী হয়েছেন। আপনাকে এই মহৎ কাজে সাহায্য করতে পারলে তিনি আরো সুখী হতেন সন্দেহ নাই। ফকির সাহেবকে তিনি জানতেন বটে কিন্তু সেতো বহু দিন আগে; বুঝতেই পারেন এখন সে সব সুদূর স্মৃতির বিষয় তাঁর মনে তেমন উজ্জ্বল নয়। তবে তিনি বললেন, কলকাতায়,‘‘লালবাংলা’’ ২০ নং মে ফেয়ার, বালিগঞ্জ- এই ঠিকানায় শ্রীযুক্ত সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুর মহাশয় থাকেন, তিনিও ফকির সাহেবকে জানতেন, তাঁর কাছে খোঁজ করলে অনেক বিষয় আপনার জানবার সুবিধা হতে পারে’।
আবার লালন শাহের একটি গানে এভাবে রবীন্দ্রনাথের নামোল্লেখ করা হয়েছে,
‘পারে যদি যাবি রবী গুরুর চরণ ভুলো না
গুরুর চরণ ভুল করিলে পারে যাওয়া ঘটবে না।’
লালনের সাথে রবীন্দ্রনাথের সাক্ষাৎ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের প্রচ্ছন্ন স্বীকারুক্তি এবং লালনের গানে রবীন্দ্রনাথের নামোল্লেখ আমাদের বিশ্বাস করতে সহায়তা করে যে রবীন্দ্রনাথ ও লালনের মধ্যে মুখোমুখি সাক্ষাৎ নিয়ে যে বিতর্ক রয়েছে তা মনে হয় অনেকাংশেই বিনা কারনে। এ নিয়ে আমরাও আর বিতর্কে জড়াতে চাই না।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জমিদারীর দায়িত্ব নিয়ে বাংলাদেশে আসার পূর্বে বিলেতে গিয়েছিলেন ব্যারিস্টারি পড়ার জন্য। অর্থাৎ কলকাতার জোড়াসাঁকোর অভিজাত পরিবারে জন্ম ও শৈশব পেরিয়ে যৌবনে বিলেতের অতি আধুনিক পরিবেশের স্বাদ পেয়ে হাল সংস্কৃতির রবীন্দ্রনাথ আসেন কুষ্টিয়াতে। তিনি প্রায় বিশ বছরকাল পূর্ববঙ্গের শিলাইদহ, শাহজাদপুর এবং পতিসরে কাটান। এই পর্বে রবীন্দ্রনাথের চেতনার জগতে এক অভূতপূর্ব পরিবর্তন সাধিত হয়। হাল সংস্কৃতিতে লালিত কবি রবীন্দ্রনাথ ধীরে ধীরে রবীন্দ্র বাউলে পরিণত হন। প্রেম ও প্রকৃতির কবি ধীরে ধীরে ঈশ্বর কেন্দ্রিক এবং সবশেষে মানবকেন্দ্রিক হয়ে ওঠেন। আমরা বাউল দর্শন ও রবীন্দ্রনাথের পারস্পারিক লেনদেনের সম্পর্ককে এক কথায় এভাবে বলতে পারি- বাউল দর্শনের শুরু মানুষ দিয়ে আর রবীন্দ্রনাথ মানুষে এসে শেষ করলেন। বাউল দর্শন রবীন্দ্রনাথের চেতনাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিলো। রবীন্দ্রনাথের জবানিতেই আমরা কথাটি শুনে নিই।
‘হারামণি’র ভূমিকাতে রবীন্দ্রনাথ বাংলা ১৩৩৪ সালে বিষয়টি এভাবে কবুল করে নিয়েছেন,‘আমার লেখা যাঁরা পড়েছেন, তাঁরা জানেন, বাউল পদাবলীর প্রতি আমার অনুরাগ আমি অনেক লেখায় প্রকাশ করেছি। শিলাইদহে যখন ছিরাম, বাউল দলের সঙ্গে আমার সর্ব্বদাই দেখা সাক্ষাৎ ও আলাপ আলোচনা হ’ত। আমার অনেক গানেই আমি বাউলের সুর গ্রহণ করেছি। এবং অনেক গানে অন্য রাগ বাগিনীর সঙ্গে আমার জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে বাউল সুরের মিল ঘটেচে। এর থেকে বোঝা যাবে, বাউলের সুর ও বাণী কোন সময়ে আমার মনের মধ্যে সহজ হ’য়ে মিশে গেছে।’
এই পর্বে রবীন্দ্রনাথের সব ধরনের রচনা, গান, কবিতা, গল্প, নাটক- সব ইবাউল দর্শন এবং বাউল ভাবে প্রভাবিত। রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যকর্মের এক উল্লেখযোগ্য অংশ তাঁর গান। এই গানে বাউল দর্শন এবং বাউল গানের কথা ও সুরের প্রভাব প্রত্যক্ষভাবে পড়ে। তাঁর প্রায় ৬৬টি গান বাউল সুরের আঙ্গিকে রচিত। স্বদেশী যুগে রচিত ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি’- যা আজ আমাদের জাতীয় সংগীত। এই গানটিও বাউল গান, গগন হরকরার ‘আমি কোথায় পাব তারে/ আমার মনের মানুষ যে রে’ এই গানটির হুবহু সুরে রচিত।
রবীন্দ্রনাথ শুধু যে বাউল গানের সুরকেই নিয়েছেন তা নয়, তিনি অনেক ক্ষেত্রে অনেক বাউল গানের বাণীকেও গ্রহণ করেছেন নিঃশঙ্কচিত্তে। বাউল দর্শন, বিশেষ করে বাউল গান ও রবীন্দ্রনাথের আলোচনা করতে গেলে অবশ্যই এ ক্ষেত্রে আমাদের লালন ও রবীন্দ্রনাথের আলোচনা বেশি করতে হবে। কারণ আমাদের একটি কথা অবশ্যই মনে রাখতে হবে-বাউল দর্শনের সাথে বরীন্দ্রনাথের যে সখ্যতা তা মূলত লালনের গানের মাধ্যমে। রবীন্দ্র মানসে আর কোন বাউল লালনের মতো এতো বেশি প্রভাব ফেলতে পারে নি। তাই রবীন্দ্রনাথ লালন শাহের কাছ থেকেই বেশি গ্রহণ করেছেন। লালনের ভাব, ভাষা, শব্দ, সুর সবই তিনি আত্মস্থ করে নিজের করে নিয়েছেন। তিনি লালনের অনেক গান ভেঙ্গে নতুন গান রচনা করেছেন-সেগুলো স্পষ্টতই রবীন্দ্র বাউলের রচনা।
লালনের গান তথা বাউল গান-বাউল দর্শনের মূল বিভাগ আমরা বলতে পারি আত্মতত্ত্বকে। বাউল-লালন সারাটা জীবন ভরে নিজেকে খুঁজে বেড়িয়েছেন- নিজেকে জানার অন্বেষণে ঘুরেছেন দেশ-বিদেশে। বাউল দর্শনের মূল সুরই হলো নিজেকে জানো- নিজেকে চেনো। আর এই নিজেকে জানা, নিজেকে বিবেচনার মধ্য দিয়েই বাউলেরা সেই মনের মানুষ আলেক মানুষ, অধর মানুষ, সোনার মানুষের খোঁজ করে ফিরেছেন। বাউল দর্শনের আদিতত্তের¡ প্রথম পাঠই হলো-‘আমি কি, আমি কে এবং আমি কেন’ এই প্রশ্নে উত্তর খুঁজে সাধনার পথে চলা। এই আদি প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই বাউলেরা ব্যাকুল। আর এই প্রশ্নের উত্তর তাঁরা খুঁজে বেড়িয়েছেন আপন দেহ জরিপের মধ্য দিয়ে।-বাউল গানকে তাই দেহজরিপের গান বলা হয়ে থাকে। এই মানব দেহের বাইরে তাঁর আর কোন কিছুতেই আস্থা রাখেন নি, রাখতে চান নি। তাই নিজের দেহকে জরিপ করে এর কোনা কান্চির আগম-নিগম খবর জেনে সেই পরমের সাথে লীলাভরে বাস করার সাধনায় বাউল মত্ত থেকেছেন, আত্মহারা হয়ে ফিরেছেন। আর তাঁদের এই ব্যাকুল মনের অনুভূতির প্রকাশ পেয়েছে তাঁদের গান-তাঁদের দর্শনের মধ্য দিয়ে। বাউল তাঁর জীবনাচারের কথা বলতে গিয়ে গান বেঁধেছেন। তাই বাউলের গান দেহজরিপের গান, বাউলের গান আত্মতত্ত্ব, আত্মদর্শনের গান। সে কারনেই বাউলের গান শুধু গীতিকবিতাই নয়-এটি একটি জীবনদর্শন, ধর্মদর্শন, জীবনাচারের সংবিধান। বাউলের এই জীবনদর্শন এক সময়ে রবীন্দ্রনাথের জীবন দর্শনেও একাত্ম হয়ে গিয়ে কবি রবীন্দ্রনাথকে রবীন্দ্র বাউলে বূপান্তরিত করে ফেলে। তাই বাউলের গানের মতোই রবীন্দ্রনাথের গানও এক সময় দেহজরিপের গানের খুব ঘনিষ্টজন হয়ে আত্মতত্ত্বের অন্বেষণের আকূল আকুতি হয়ে রবীন্দ্র ভাবনায় স্ফুরিত হয়ে ওঠে। লালনের সেই দেহ অন্বেষী ব্যাকুলতা
‘আমার ঘরখানায় কে বিরাজ করে।
আমি জনম-ভরে একদিন না দেখলাম তারে।।
নড়ে চড়ে ঈশান কোনে
দেখতে পাই নে এই নয়নে
হাতের কাছে যার ভবের হাট-বাজার
আমি ধরতে গেলে হাতে পাই নে তারে।।’
রবীন্দ্র বাউলের হৃদয়ের একতারাতে কি মধুর ব্যঞ্জনায় এই সুর ধ্বনিত হয়ে আপনাকে তোলপাড় করে তুলেছে। ব্যাকুল আক্ষেপে তাই বার বার প্রাণের ছেতারে বেজে উঠেছে,
‘আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে দেখতে আমি পাই নি
তোমায় দেখতে আমি পাই নি।
আমি বাহির পানে চোখ মেলেছি, আমার হৃদয় পানে চাই নি।’
(চলবে)
সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী আবু জাফর
যোগাযোগ: । [email protected] । বিজ্ঞাপন ও বার্তা সম্পাদক: 01894944220
ঠিকানা: বার্তা ও বাণিজ্যিক যোগাযোগ : বাড়ি নম্বর-২৩৪, খাইরুন্নেসা ম্যানশন, কাঁটাবন, নিউ এলিফ্যান্ট রোড, ঢাকা-১২০৫।
© 2025 Sangbad Sarabela All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh