× প্রচ্ছদ বাংলাদেশ বিশ্ব রাজনীতি খেলা বিনোদন বাণিজ্য লাইফ স্টাইল ভিডিও সকল বিভাগ
ছবি ভিডিও লাইভ লেখক আর্কাইভ

ধানের ইতিহাস-ঐতিহ্যে সংরক্ষণাগার গাজীপুরের রাইস মিউজিয়াম

শাহনাজ পারভীন এলিস

৩০ জুলাই ২০২২, ০৭:২৯ এএম । আপডেটঃ ৩০ জুলাই ২০২২, ০৮:৫৫ এএম

ধান এ দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও গ্রামীণ সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। বাংলাদেশে খাদ্য নিরাপত্তা মানে আমরা ধান বা চালের নিরাপত্তাকে বুঝি। হেনরি কেসিঞ্জারের অবজ্ঞার সেই তলাবিহীন ঝুড়ি এখন উপচেপড়া উদ্বৃত্ত খাদ্যের সমৃদ্ধ এক বাংলাদেশ। স্বাধীনতা পরবর্তী সময় থেকে আজ পর্যন্ত গত পাঁচ দশকে ধাননির্ভর সমাজ ও সংস্কৃতিতে এসেছে অনেক পরিবর্তন, ধানভিত্তিক অর্থনীতিতেও ঘটেছে নানা রূপান্তর। গরু দিয়ে হাল চাষ, মই চাষ আর ধান মলনের দৃশ্য এখন আর গ্রামবাংলায় অদৃশ্য হতে চলেছে। সেখানে এসেছে কলের লাঙ্গল, অত্যাধুনিক বপন ও রোপণ যন্ত্র। সনাতন জাতের ক্ষেত্রে এসেছে উচ্চফলনশীল আধুনিক জাত। আগাছা দমন, বালাইনাশক স্প্রে কিংবা পাকা ধান কর্তন ও প্রক্রিয়াজাতকরণ সব কিছুতেই লেগেছে প্রযুক্তির ছোঁয়া। তাইতো গ্রামবাংলার ইতিহাস-ঐতিহ্য নিয়ে কবি-সাহিত্যিকরা লিখেছেন এমন আবেগঘন কত শত কবিতা। 

কোথায় গেল সোনার সময়, সোনার মানুষ কই!

কোথায় গেল লাঙ্গল-জোয়াল, কোথায় গেল মই।

কোথায় গেল গরুর গাড়ি, কোথায় গরুর হাল

কোথায় গেল রংবেরঙের ডিঙি নায়ের পাল।


এছাড়া ধান ক্ষেত কবিতায় কবি জসিম উদ্দিন লিখেছেন-


পথের কেনারে পাতা দোলাইয়া করে সদা সঙ্কেত,

সবুজে হদুদে সোহাগ ঢুলায়ে আমার ধানের ক্ষেত।

ছড়ায় ছড়ায় জড়াজড়ি করি বাতাসে ঢলিয়া পড়ে,

ঝাঁকে আর ঝাঁকে টিয়ে পাখিগুলে শুয়েছে মাঠের পরে।


তাই বলে কি দেশীয় ধানভিত্তিক জাত, কৃষ্টি কালচার হারিয়ে যাবে? না, তা তো হতে পারে না। তাইতো সেটি সংরক্ষণের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিআরআরআই)। দেশের ধান গবেষণার ইতিহাস-ঐতিহ্য, ধানভিত্তিক কৃষ্টি ও কালচার সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে গাজীপুরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে দেশের প্রথম এই রাইস মিউজিয়াম। 


কী রয়েছে এই মিউজিয়ামে

অত্যাধুনিক এই মিউজিয়ামে ধানের বীজ থেকে বীজ বৃদ্ধি পর্যায়, গত পাঁচ দশকে ব্রি উদ্ভাবিত বিভিন্ন উফশী জাতের ধান ও চালের নমুনা, দেশীয় বিভিন্ন আদি জাত, চালের তৈরি পিঠাপুলি, ধানের উপজাত পণ্যগুলো, প্রধান প্রধান আগাছা, রোগবালাইয়ের সচিত্র নমুনা, ধান চাষে ব্যবহৃত দেশীয় বিভিন্ন যন্ত্রপাতি, আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতির রেপ্লিকা, ধানভিত্তিক কৃষ্টি ও কালচারের রেপ্লিকা এবং ধান নিয়ে লেখা দেশি-বিদেশি বইপত্র এক ছাদের নিচে এনে প্রদর্শন করা হচ্ছে। এছাড়া খাদ্য নিরাপত্তায় বাংলাদেশের সাফল্য দেশি-বিদেশি পর্যটকদের কাছে সুন্দর ও ফলপ্রসূভাবে তুলে ধরা হয়েছে। 


ধানভিত্তিক ঐতিহ্য, কৃষ্টি ও সংস্কৃতি সংরক্ষণাগার

মিউজিয়ামটি পরিদর্শনে প্রতিদিনই ব্রিতে ভিড় করেন স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, দেশি-বিদেশি পর্যটক এবং গবেষণকরা। তাদের কাছে দেশের ধানভিত্তিক অর্থনীতির বিবর্তনের ইতিহাস ও ঐতিহ্য, এই খাতের অর্জন ও সাফল্য তুলে ধরাই এই মিউজিয়াম প্রতিষ্ঠার অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য বলে জানান উদ্যোক্তারা। দেশি-বিদেশি পর্যটকরা এ মিউজিয়ামে এসে ধান চাষাবাদের প্রতিটি বৃদ্ধি পর্যায় সম্পর্কে একটি স্বচ্ছ ধারণা পাবেন। সেখানে দেশে উদ্ভাবিত বিভিন্ন ধানের জাতসমূহ এবং এর সেদ্ধ ও আতপ চালের নমুনা যেমন এখানে আছে, দেশী জাতের বৈচিত্র্যময় ধান ও চালের নমুনাও তারা একছাদের নিচে দেখতে পচ্ছেন। রাইস মিউজিয়ামটিতে সনাতন সময়ের ধানচাষ থেকে শুরু করে আধুনিক সময় পর্যন্ত ধান রোপণ, মাড়াই ও কর্তন সময় পর্যন্ত যেসব পৌরাণিক ও আধুনিক উপকরণ ব্যবহার করা হতো বা হচ্ছে সেসবও প্রদর্শন করা হয়েছে।

২০১৮ সাল থেকে এই মিউজিয়াম স্থাপনের কাজ শুরু হলেও এর আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয় চলতি বছর ১২ মার্চ। কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আবদুর রাজ্জাক এবং জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) মহাপরিচালক কিউ ডুঙ্গা চলতি বছরের ১২ মার্চ আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। ড. কিউ ডুঙ্গার ব্রি সফর উপলক্ষ্যে এটি প্রথমবারের মতো উন্মুক্ত করা হয়। প্রসঙ্গত এটিই বাংলাদেশের একমাত্র ও প্রথম রাইস মিউজিয়াম। কেননা এর আগে এই ধরনের কোন মিউজিয়াম দেশের কোন প্রতিষ্ঠানে ছিল না। মিউজিয়ামটি স্থাপনে সরকারি রাজস্ব খাতের পাশাপাশি অর্থায়ন করেছে কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশন (কেজিএফ)। 

এটিই বাংলাদেশের একমাত্র ও প্রথম রাইস মিউজিয়াম। ব্রি ক্যাম্পাসে কাচ ও স্টিলের কাঠামো দিয়ে তৈরি করা হয়েছে মিউজিয়ামটি। গেল মার্চ থেকে এটি দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে ব্যতিক্রমী এই জাদুঘরে ভিড় করছেন উৎসুক মানুষ। প্রতি বছর অসংখ্য দেশি-বিদেশি পর্যটক, বিভিন্ন স্কুল-কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী, দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে কৃষকরা ব্রি পরিদর্শনে আসেন। তারা ব্রির অগ্রগতির ইতিহাস ও সার্বিক কর্মকাণ্ড এক নজরে দেখতে চান। আন্তর্জাতিক মানের একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান হওয়া সত্ত্বেও ব্রিতে ইতিপূর্বে কোনো সুসজ্জিত রাইস মিউজিয়াম না থাকায় দেশি-বিদেশি পর্যটকরা ব্রি পরিদর্শনে এসে হতাশ হতেন।


বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের সিনিয়র লিয়াজোঁ অফিসার এবং ব্রি রাইস মিউজিয়াম কর্মসূচির পরিচালক মোহাম্মদ আব্দুল মোমিন জানান, ব্রি উদ্ভাবিত জাত ও প্রযুক্তি প্রদর্শনীর জন্য এই মিউজিয়াম প্রতিষ্ঠা করা হয়। ব্রি উদ্ভাবিত নতুন জাত ও প্রযুক্তি জনপ্রিয়করণে একটি নলেজ হাব তৈরি এবং আধুনিক ধানবিষয়ক কৃষি প্রযুক্তি বিষয়ে দেশি-বিদেশি পরিদর্শকদের উদ্বুদ্ধকরণে কাজ করছে এই মিউজিয়াম। আন্তর্জাতিক মানের একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান হিসেবে ব্রিতে একটি সুসজ্জিত রাইস মিউজিয়ামের অভাব ছিল। তাই এই দেশের ধান গবেষণার অতীত ইতিহাস, ঐতিহ্য, ধানভিত্তিক আচার অনুষ্ঠান ও সংস্কৃতি এবং খাদ্য নিরাপত্তায় ব্রি তথা বাংলাদেশ সরকারের সাফল্য দেশি-বিদেশি পর্যটকদের কাছে সুন্দরভাবে তুলে ধরতে অত্যাধুনিক রাইস মিউজিয়াম স্থাপন করা হয়েছে। এই মিউজিয়ামে ধান রোপণ থেকে চাল হিসেবে কৃষকের ঘরে তোলা পর্যন্ত সকল প্রক্রিয়া ছবির মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে। এখানে ব্রি উদ্ভাবিত জাত ও প্রযুক্তি প্রদর্শণীর জন্য ১৫টি সেলফ স্থাপন করা হয়েছে। জাত ও প্রযুক্তিগুলোর নমুনা ও রেপ্লিকা রাখা হয়েছে। মিউজিয়ামে ডিসপ্লে সেলফে নতুন ও পুরনো কৃষি যন্ত্রপাতির প্রদর্শনী স্থাপন করা হয়েছে; যা দেখে দেশি-বিদেশি পরিদর্শকরা উদ্বুদ্ধ হবেন।


বাংলাদশ ধান গবেষণা ইনস্টিউটের পরিচালক (গবেষণা) ড. মোহাম্মদ খালেকুজ্জামান জানান, প্রতি বছর অসংখ্য দেশি-বিদেশি পর্যটক, বিভিন্ন স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী, দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে কৃষকরা ব্রি পরিদর্শনে আসেন। তারা খাদ্য নিরাপত্তায় ব্রি’র অগ্রগতির ইতিহাস ও সার্বিক কর্মকাণ্ড এক নজরে দেখতে চান। আন্তর্জাতিক মানের একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান হওয়া সত্ত্বেও ব্রিতে এর আগে কোনো সুসজ্জিত রাইস মিউজিয়াম ছিল না। ফলে দেশি-বিদেশি পর্যটকরা ব্রি পরিদর্শনে এসে হতাশ হতেন। তাই দেশের ধান গবেষণার অতীত ইতিহাস, ঐতিহ্য, ধানভিত্তিক আচার অনুষ্ঠান ও সংস্কৃতি এবং খাদ্য নিরাপত্তায় ব্রি তথা বাংলাদেশ সরকারের সাফল্য দেশি-বিদেশি পর্যটকদের কাছে সুন্দর ও ফলপ্রসূভাবে তুলে ধরার জন্য ব্রিতে একটি অত্যাধুনিক রাইস মিউজিয়াম স্থাপন করা হয়েছে।

বাংলাদশ ধান গবেষণা ইনস্টিউটের মহাপরিচালক ড. মো. শাহজাহান কবীর বলেন, ধানকে এদেশের জাতীয় অগ্রগতি ও সমৃদ্ধির প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। খাদ্য নিরাপত্তা বলতে এদেশে প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে ভাতের নিরাপত্তাকেই বুঝানো হয়। কোন দেশের শিল্প, সাহিত্য, অর্থনীতি কিংবা রাজনীতি সবকিছুই নিয়ন্ত্রিত হয় খাদ্য নিরাপত্তা দিয়ে। 

বিশ্বমানের একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান হিসেবে ১৯৭০ সালের ১ অক্টোবর থেকে গত সাড়ে চার দশকের বেশি সময় ধরে ব্রি এদেশের ক্রমর্বধমান জনসংখ্যার জন্য খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে অসামান্য অবদান রেখে চলেছে। ব্রি গত পাঁচ দশকে বন্যা, খরা ও লবণাক্ততা সহিষ্ণু ধান, শীত প্রধান অঞ্চলের উপযোগী ধান, সরু ও সুগন্ধি প্রিমিয়াম কোয়ালিটি ধান, জিংক সমৃদ্ধ ধান (বিশ্বের প্রথম) ও হাইব্রিড ধানসহ গত ১০১টি ইনব্রিড ও ৭টি হাইব্রিড মিলিয়ে মোট ১০৮টি ধানের জাত উদ্ভাবন হয়েছে; যার সবগুলোর নমুনা এই মিউজিয়ামে দর্শনার্থীদের জন্য প্রদর্শিত হচ্ছে।

বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট জানিয়েছে, দেশ-বিদেশ থেকে আসা বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যক্তি, শিক্ষার্থী ও গবেষকরা এ মিউজিয়ামে এসে ধান সম্পর্কে একটি স্বচ্ছ ধারণা নিয়ে যাচ্ছেন। দেশে উদ্ভাবিত বিভিন্ন জাতের ধানসমূহ তারা দেখতে পারছেন। রাইস মিউজিয়ামটিতে সনাতন সময়ের ধান চাষ থেকে শুরু করে আধুনিক সময় পর্যন্ত ধান রোপণ, মাড়াই ও কর্তনে যেসব উপকরণ ব্যবহার করা হয়েছে তা প্রদর্শনের জন্য রাখা হয়েছে। রাইস মিউজিয়ামে ধান রোপণ থেকে চাল হিসেবে কৃষকের ঘরে তোলা পর্যন্ত সব প্রক্রিয়া ছবির মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে।

ধানভিত্তিক অর্থনীতি রূপান্তরে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের অবদান দেশে-বিদেশের পর্যটকদের কাছে তুলে ধরতে ব্রিতে দেশের প্রথম রাইস মিউজিয়াম প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। আন্তর্জাতিক মানের গবেষণা প্রতিষ্ঠান হিসেবে ব্রিতে একটি সুসজ্জিত রাইস মিউজিয়াম স্থাপন করা প্রয়োজন ছিল। এই মিউজিয়ামে প্রাচীনকাল থেকে বর্তমান পর্যন্ত বিভিন্ন জাতের ধান, রোপনের কলাকৌশল ও রোগবালাই দমনের নানা দিক তুলে ধরা হয়েছে। 


Sangbad Sarabela

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী আবু জাফর

যোগাযোগ: । 01894-944220 । [email protected], বিজ্ঞাপন: 01894-944204

ঠিকানা: বার্তা ও বাণিজ্যিক যোগাযোগ : বাড়ি নম্বর-২৩৪, খাইরুন্নেসা ম্যানশন, কাঁটাবন, নিউ এলিফ্যান্ট রোড, ঢাকা-১২০৫।

আমাদের সঙ্গে থাকুন

© 2024 Sangbad Sarabela All Rights Reserved.