দেশের প্রখ্যাত বুদ্ধিজীবী, লেখক, গবেষক ও ইতিহাসবিদ বদরুদ্দীন উমর আর নেই। মৃত্যুর আগপর্যন্ত অকপটে মতপ্রকাশ ও স্বাধীন চিন্তার প্রতীক হয়ে ওঠা এই চিন্তাবিদ লেখালেখি ও গবেষণার স্বীকৃতিস্বরূপ একাধিকবার রাষ্ট্রীয় পদক ও পুরস্কারের জন্য মনোনীত হন। তবে জীবনের শেষ পর্যন্ত তিনি কোনো পুরস্কার গ্রহণ করেননি। এমনকি চলতি বছর (২০২৫) সরকারের ঘোষিত স্বাধীনতা পুরস্কারও প্রত্যাখ্যান করেন তিনি।
এক বিবৃতিতে স্বাধীনতা পুরস্কার গ্রহণ না করার ব্যাখ্যা দিয়ে বদরুদ্দীন উমর বলেন, ১৯৭৩ সাল থেকে আমাকে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা থেকে পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। আমি সেগুলোর কোনোটিই গ্রহণ করিনি। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আমাকে স্বাধীনতা পুরস্কার দেওয়ার ঘোষণা করেছে। এ জন্য তাদের ধন্যবাদ, কিন্তু তাদের দেওয়া এই পুরস্কারও গ্রহণ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।
বদরুদ্দীন উমর বহুবার সাক্ষাৎকার ও লেখার মাধ্যমে নিজের অবস্থান পরিষ্কার করেছেন। 'প্রতিধ্বনি' ম্যাগাজিনে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, আমি পুরস্কার নিই না এ কারণে যে, আমি যে লেখালেখি করি—এটা আমি নিজের আন্তরিক তাগিদ থেকে করি। এর জন্য আমাকে কেউ পুরস্কার দেবে, এটা আমার ভালো লাগে না। একজন লেখকের আসল পুরস্কার হলো—মানুষ তার লেখা পড়বে, আলোচনা করবে এবং উপকৃত হবে।
তিনি আরও বলেন, পুরস্কার সাধারণত দেওয়া হয় লেখকদের চিন্তাকে সীমাবদ্ধ করার জন্য। ধনিকশ্রেণি কিংবা রাষ্ট্র এসব পুরস্কার দেয় লেখককে একটি নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে আটকে রাখতে। একবার পুরস্কার নিলে আবার অন্য পুরস্কারের প্রতি ঝোঁক তৈরি হয়, আর সেটা লেখালেখির স্বাধীনতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
নিজের বক্তব্যে তিনি পশ্চিমবঙ্গের খ্যাতনামা লেখক মহাশ্বেতা দেবীর নাম উল্লেখ করে বলেন, মহাশ্বেতা দেবী প্রথমে পুরস্কার না নেওয়ার অবস্থান নিলেও পরে নোবেল থেকে শুরু করে ম্যাগসেসাই পুরস্কার নিয়েছেন। এর ফলে তার লেখার মান নষ্ট হয়েছে এবং তিনি রাজনৈতিকভাবে আপসহীনতা হারিয়েছেন।
বদরুদ্দীন উমরের মতে, একজন লেখককে মুক্ত থাকতে হলে পুরস্কার প্রত্যাখ্যানই প্রকৃত শক্তি ও সততার বহিঃপ্রকাশ।
বদরুদ্দীন উমর শুধুই লেখক বা গবেষক ছিলেন না, তিনি ছিলেন এক বাস্তববাদী চিন্তক যিনি ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, রাজনীতি ও ইতিহাস নিয়ে লিখেছেন সাহসিকতার সঙ্গে। তার লেখনি প্রান্তিক মানুষের কথা বলেছে, প্রশ্ন তুলেছে ক্ষমতার বিরুদ্ধে। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি যে নীতিগত অবস্থানে ছিলেন, তা তার পুরস্কার প্রত্যাখ্যানের মধ্য দিয়েই আবারও প্রতিফলিত হলো।