× প্রচ্ছদ বাংলাদেশ বিশ্ব রাজনীতি খেলা বিনোদন বাণিজ্য লাইফ স্টাইল ভিডিও সকল বিভাগ
ছবি ভিডিও লাইভ লেখক আর্কাইভ

সব ভালো তার শেষ ভালো যার

ডেস্ক রিপোর্ট।

১৯ নভেম্বর ২০২৫, ১০:০৩ এএম

ছবি: সংগৃহীত।

গত বছরের ৮ আগস্ট জাতির এক ক্রান্তিকালে দেশের দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিন দিন সরকারবিহীন থাকার পর জাতীয় ঐকমত্যের প্রতীক হিসেবে শান্তিতে নোবেল জয়ী বরেণ্য এই ব্যক্তিত্বকে প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে সর্বসম্মতিক্রমে মনোনীত করা হয়। দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই ক্ষতবিক্ষত একটি দেশকে পুনর্গঠনের যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন তিনি। ড. ইউনূস তাঁর দায়িত্ব গ্রহণের পর তিনটি প্রধান লক্ষ্য নির্দিষ্ট করেন।

প্রথমত, রাষ্ট্র সংস্কার। এমনভাবে রাষ্ট্র কাঠামো মেরামত করা যাতে নতুন করে আর কোনো ফ্যাসিবাদের  উত্থান না হয়। জুলাই বিপ্লবের শহীদদের স্বপ্নের দেশ গড়তে রাষ্ট্রের নানা ক্ষত সারতে সংস্কার উদ্যোগ গ্রহণ করেন।

দ্বিতীয় লক্ষ্য ছিল, জুলাই গণহত্যার বিচার।

গত বছরের জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতাকে নির্বিচারে হত্যার বিচার ছিল ড. ইউনূসের দ্বিতীয় অঙ্গীকার।

তৃতীয় লক্ষ্য হলো, একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা। নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর।

গত দেড় বছরে এই তিনটি মূল লক্ষ্য সামনে রেখেই কাজ করে যাচ্ছেন অন্তর্র্বর্তী সরকার।

অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্র্বর্তী সরকার ১১টি সংস্কার কমিশন গঠন করে। এর মধ্যে সংবিধান, নির্বাচনব্যবস্থা, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কার, পুলিশ ও জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রধানদের নিয়ে গঠিত হয় জাতীয় ঐকমত্য কমিশন, যার সভাপতি ছিলেন অধ্যাপক ড. ইউনূস নিজেই।

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে ছয়টি কমিশনের ১৬৬টি গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব ও বাস্তবায়নপদ্ধতি নিয়ে আলোচনা হয়। এতে স্থান পায়নি স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশন, স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন, গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন, নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন ও শ্রম সংস্কার কমিশনের সুপারিশ। অবশ্য এসব কমিশনের প্রস্তাব সরকার কিছু কিছু বাস্তবায়ন করছে।

জাতীয় ঐকমত্য কমিশন ছয়টি সংস্কার কমিশনের সুপারিশ নিয়ে প্রায় ৯ মাস ধরে ৩০টি রাজনৈতিক দল ও জোটের সঙ্গে আলোচনা করে।

আলোচনায় ৮৪টি প্রস্তাব নিয়ে ঐকমত্য ও সিদ্ধান্ত হয়। এগুলো নিয়েই তৈরি হয়েছে জুলাই জাতীয় সনদ, যা সই হয় গত ১৭ অক্টোবর (এনসিপি ও চারটি বাম দল সই করেনি)। এর মধ্যে ৪৮টি সংবিধান-সম্পর্কিত। সংবিধান-সম্পর্কিত প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়নের জন্যই জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ জারি হয়েছে এবং তা নিয়ে গণভোট হবে। গত ১৩ নভেম্বর জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা একই দিনে গণভোট এবং জাতীয় নির্বাচনের ঘোষণা দেন। এ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতবিরোধ থাকলেও রাষ্ট্র সংস্কারের একটি সুস্পষ্ট রূপরেখা তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে এ সরকার।

সরকারের দ্বিতীয় অগ্রাধিকার হলো জুলাই গণহত্যার বিচার। দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই প্রধান উপদেষ্টা গণহত্যার স্বচ্ছ তদন্ত ও বিচারের উদ্যোগ নেন। জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার নিজে বাংলাদেশের গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের ব্যাপারে তদন্ত করেন। স্বল্পতম সময়ের মধ্যে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট গণহত্যা এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তদন্ত করে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এই প্রতিবেদন জুলাই-আগস্ট গণহত্যার বিচারের শক্ত ভিত্তি তৈরি করে দেয়।

ড. ইউনূসের নির্দেশে, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন করা হয়। পুনর্গঠিত ট্রাইব্যুনালে প্রথম মামলার কার্যক্রম শুরু হয় গত বছরের ১৭ অক্টোবর। সেদিন শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে প্রথম মামলা (মিসকেস বা বিবিধ মামলা) হয়। একই দিনে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন ট্রাইব্যুনাল।

এ মামলায় প্রথমে শেখ হাসিনাই ছিলেন একমাত্র আসামি। এরপর চলতি বছরের ১৬ মার্চ শেখ হাসিনার পাশাপাশি সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনকেও এ মামলায় আসামি করা হয়। একাধিকবার সময় বাড়ানোর পর চলতি বছরের ১২ মে এই মামলায় চিফ প্রসিকিউটরের কার্যালয়ে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয় ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা।

এ মামলায় আসামি হিসেবে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের নাম প্রথমবারের মতো আসে তদন্ত প্রতিবেদনে (১২ মে)। সেদিন থেকে এ মামলায় আসামি হন তিনজন (শেখ হাসিনা, আসাদুজ্জামান ও চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন)। শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে গত ১ জুন ট্রাইব্যুনালে ফরমাল চার্জ বা আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করে প্রসিকিউশন।

ফরমাল চার্জ দাখিলের মাধ্যমে ‘মিসকেস’ আনুষ্ঠানিকভাবে মামলায় রূপ নেয়। এ মামলায় গত ১০ জুলাই আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন করেন ট্রাইব্যুনাল। সেদিনই (১০ জুলাই) সাবেক আইজিপি মামুন ‘অ্যাপ্রুভার’ (রাজসাক্ষী) হওয়ার আবেদন করেন। গত ৩ আগস্ট এ মামলায় সূচনা বক্তব্য উপস্থাপন করেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম। এর মধ্য দিয়ে এ মামলার আনুষ্ঠানিক বিচার শুরু হয়। সূচনা বক্তব্য টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়। সূচনা বক্তব্যের পর এ মামলায় প্রথম সাক্ষী হিসেবে জবানবন্দি দেন জুলাই গণ অভ্যুত্থানের গুরুতর আহত হওয়া খোকন চন্দ্র বর্মণ। তাঁর সাক্ষ্য গ্রহণের মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক বিচার শুরু হয়।

এ মামলায় জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামসহ মোট ৫৪ জন সাক্ষী জবানবন্দি দেন। সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হয় গত ৮ অক্টোবর। এরপর যুক্তিতর্ক শুরু হয় গত ১২ অক্টোবর, যা শেষ হয় ২৩ অক্টোবর। সর্বশেষ ১৩ নভেম্বর ট্রাইব্যুনাল জানান, ১৭ নভেম্বর এ মামলার রায় ঘোষণা করা হয়েছে। ‘মিসকেস’ থেকে এ মামলার রায় ঘোষণা পর্যন্ত সময় লেগেছে ৩৯৭ দিন।

গত ১৭ নভেম্বর এ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ৪৫৩ পৃষ্ঠার এই রায়ে ছয়টি অংশ রয়েছে। রায়ে ট্রাইব্যুনাল বলেছেন, শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির অপরাধ প্রমাণিত। দুটি অভিযোগে শেখ হাসিনাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। একটি অভিযোগে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামালকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। অ্যাপ্রুভার (রাজসাক্ষী) হওয়ায় পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। এই রায়ের মধ্য দিয়ে ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্র্বর্তী সরকার, তাদের আরও একটি মৌলিক দায়িত্ব পালন করল। এখন জুলাই গণহত্যার বাকি মামলার বিচার প্রক্রিয়া স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় চলবে।

ড. ইউনূসের যে শেষ মৌলিক দায়িত্বটি এখন একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্পন্ন করা। তিনি আগামী বছরের ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে বলে নিশ্চিত করেছেন। গত দেড় বছরের এ সরকার সবক্ষেত্রে সফল হয়েছে, এমনটি কেউই মনে করে না। অনেক ক্ষেত্রেই সরকারের ব্যর্থতা রয়েছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এখনো স্বাভাবিক হয়নি। মব সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, দখল নিয়ন্ত্রণহীন। সাধারণ মানুষ চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতিও ভালো না। বেকারত্ব বাড়ছে। দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। অনেক শিল্প-কলকারখানা বন্ধ।

প্রতিদিন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার আন্দোলন জনজীবনকে অতিষ্ঠ করে তুলেছে। সরকারের পক্ষ থেকেও বলা হচ্ছে, একটি গণতান্ত্রিক সরকার ছাড়া এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের উপায় নেই। নির্বাচনই তাই এ সরকারের এখন প্রধান দায়িত্ব। সংস্কার এবং বিচারের মতো একটি ভালো নির্বাচনের আয়োজন করতে পারলেই ড. ইউনূস বাংলাদেশের জনগণের কাছে অমর হয়ে থাকবেন। একটা সুন্দর নির্বাচন জনগণকে সরকারের ভুলত্রুটি ভুলিয়ে দেবে। অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে সাধারণ মানুষ এ সরকারকে সফল হিসেবে বিবেচনা করবে। ডঃ. ইউনূস তাঁর প্রধান তিনটি লক্ষ্যের দুটিই অর্জন করেছেন। এখন নির্বাচনি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় তিনি নিরলসভাবে পরিশ্রম করছেন। কারণ তিনি জানেন, সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে না পারলে সব অর্জন ব্যর্থ হয়ে যাবে। অন্য অর্জন এবং সাফল্য কেউ মনে রাখবে না। কারণ, সব ভালো তার শেষ ভালো যার।

Sangbad Sarabela

সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী আবু জাফর

যোগাযোগ: । [email protected] । বিজ্ঞাপন ও বার্তা সম্পাদক: 01894944220

ঠিকানা: বার্তা ও বাণিজ্যিক যোগাযোগ : বাড়ি নম্বর-২৩৪, খাইরুন্নেসা ম্যানশন, কাঁটাবন, নিউ এলিফ্যান্ট রোড, ঢাকা-১২০৫।

আমাদের সঙ্গে থাকুন

© 2025 Sangbad Sarabela All Rights Reserved.