পদ্মা সেতু
বাঙালির
স্বপ্নের পদ্মা সেতু। দৈর্ঘ্য ৬ দশমিক ১৫
কিলোমিটার। পৃথিবীর দীর্ঘতম সেতুর মধ্যে পদ্মা সেতুর অবস্থান ১২২তম। বাংলাদেশ ও বাঙালির দীর্ঘদিনের
লালিত এই স্বপ্নের বাস্তবায়ন
হতে বাকি আর মাত্র ক’দিন। সেতুর দুই প্রান্তেই চলছে এখন উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চূড়ান্ত সময় দিলেই জুন মাসের শেষে উদ্বোধনের লক্ষ্যে সব কাজ এগিয়ে
নিচ্ছে সেতু বিভাগ। সেতুর ওপর দিয়ে চলাচলের জন্য অপেক্ষার প্রহর গুনছে দেশবাসী।
সেতু
প্রকল্পের পরিচালক মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম সংবাদ সারাবেলাকে জানিয়েছেন, ‘এরই মধ্যে মূল সেতুর ৯৯ শতাংশ কাজ
শেষ হয়েছে। এখন ফিনিশিংয়ের কাজ চলছে। নদীশাসন কাজের অগ্রগতি ৯২ শতাংশ। আর
সব মিলিয়ে এ পর্যন্ত পদ্মা
সেতু প্রকল্পের কাজের অগ্রগতি ৯৫ শতাংশ। প্রধানমন্ত্রীর
সঙ্গে আলোচনা করে সেতু উদ্বোধনের চূড়ান্ত দিনক্ষণ নির্ধারণ করবেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী এবং
সচিব। আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের জন্য সেতুর দুই প্রান্তকেই প্রস্তুত করা হচ্ছে।’
সেতু
বিভাগের সচিব মনজুর হোসেন জানিয়েছেন, প্রধানমন্ত্রী মাওয়া প্রান্ত থেকে পদ্মা সেতুর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করবেন। এরপর তিনি জাজিরা প্রান্তের টোল প্লাজায় আয়োজিত উদ্বোধনী কাজেও অংশ নেবেন। সেজন্য মুন্সীগঞ্জের মাওয়া ও শরীয়তপুরের জাজিরা
উভয় প্রান্তেই নেওয়া হচ্ছে বিশেষ ব্যবস্থা। জাজিরা প্রান্তের টোল প্লাজায় উদ্বোধনী কাজ শেষ করে মাদারীপুরের শিবচর উপজেলার কাঁঠালবাড়িতে জনসভায় যোগ দেবেন প্রধানমন্ত্রী। সেই লক্ষ্যে সার্বিক কাজ দ্রুত শেষ করতে সেতু বিভাগ ও স্থানীয় প্রশাসনকে
নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
তিনি
আরও জানান, পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ শুরুর আগে থেকেই এই প্রকল্প নিয়ে
দেশে-বিদেশে নানা ধরনের আলোচনা হওয়ায় এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠান
যতটা সম্ভব আকর্ষণীয় করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের জন্য সেতু বিভাগ থেকে বেশ কয়েকটি উপ-কমিটি করা
হয়েছে। বর্ণাঢ্য সেই আয়োজনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জনসভায় উদ্বোধনী ভাষণ দেবেন। জমকালো অনুষ্ঠানে মন্ত্রিসভার সদস্য, বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ, আওয়ামী লীগের সিনিয়র সদস্য, বাংলাদেশে নিযুক্ত বিভিন্ন দেশের কূটনীতিক, বিশিষ্ট ব্যক্তিসহ বিভিন্ন পর্যায়ের অতিথিদের আমন্ত্রণ জানানো হবে।
সেতু
বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, উদ্বোধনের নির্দিষ্ট দিন এখনো ঘোষণা না হলেও সেতু
মন্ত্রণালয় এবং প্রকল্প-সংশ্লিষ্টরা জুনের শেষ দিকে উদ্বোধনের জন্য সব ধরনের প্রস্তুতি
নিচ্ছেন। সেতুর উভয় প্রান্তের প্রকল্প এলাকার চারপাশে এক কিলোমিটারের মধ্যে
চার স্তরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে। এজন্য স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্স (এসএসএফ), স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তারা উভয় প্রান্ত পরিদর্শনের পর টহল ও
নজরদারি জোরদার করার ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে সেতু বিভাগ।
পদ্মা
সেতু প্রকল্পের নির্বাহী প্রকৌশলী দেওয়ান মো. আব্দুল কাদের জানান, সেতুর ৯৮ ভাগ কাজ
শেষ হওয়ায় সব ধরনের যানবাহন
সেতুর ওপর দিয়ে চলাচলে কোন অসুবিধা হবে না। এছাড়া রোড মার্কিং ও সংকেত, স্টিলের
রেলিং বসানো ও ভায়াডাক্টের সামান্য
যে কাজ বাকি আছে, সেগুলো চলছে। সেতুর নামফলক স্থাপন করা হচ্ছে। আনুষ্ঠানিকভাবে পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের আগে এখন চলছে ম্যুরাল ও ফলক নির্মাণের
কাজ। ৪০ ফুট উচ্চতার
দুটি করে ম্যুরাল স্থাপন করা হচ্ছে মাওয়া ও জাজিরা পয়েন্টে।
এই ম্যুরাল দুটির একটিতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যটিতে প্রধানমন্ত্রী
শেখ হাসিনার প্রতিকৃতি স্থাপন করা হবে। খুব শিগগিরই এসব কাজ শেষ হবে। জাজিরা প্রান্তের নদী শাসন পুরোপুরি শেষ। অন্যদিকে মাওয়া অংশেও নদী শাসনের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে।
তিনি
আরও জানান, সেতু বিভাগের নির্দেশনা অনুযায়ী চলতি মাসের মধ্যেই সেতুর সব লাইটপোস্টেও বিদ্যুৎ
সংযোগ দেয়া হচ্ছে। আলো জ্বালানোর কার্যক্রম চালাচ্ছে পল্লীবিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষ। মূল সেতুতে সরবরাহ করা হবে ৮০ কিলোওয়াট বিদ্যুৎ।
এই বিদ্যুৎ সংযোগের জন্য প্রয়োজনীয় টাকা পল্লীবিদ্যুৎ সমিতিতে জমা দেওয়া হয়েছে। একইভাবে শরীয়তপুর পল্লীবিদ্যুৎ সমিতিকে চিঠি দেওয়া হয়। পদ্মা সেতুতে মোট ৪১৫টি ল্যাম্পপোস্ট বসানো হয়েছে। ৩০ জুনের মধ্যে
সেতুটির কাজ শেষ হবে। তারপরই যানবাহন চলাচলের জন্য সেতুটি উন্মুক্ত করে দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। সেই লক্ষ্যে সব ধরনের কাজ
দ্রুত শেষ করতে সংশ্লিষ্টদের তাগিদ দেওয়া হচ্ছে।
সড়ক
ও জনপথ বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, পদ্মা সেতুর রক্ষণাবেক্ষণের জন্য টোল আদায়কারী ও ঠিকাদার নিয়োগ
দিয়েছে সেতু বিভাগ। কাজটি দেওয়া হয়েছে কোরিয়া এক্সপ্রেসওয়ে কর্পোরেশন (কেইসি) এবং চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানিকে (এমবিইসি); যারা বর্তমানে মূল সেতু নির্মাণের কাজ করছে। আর পরামর্শক সংস্থা
হিসেবে কাজ করবে কেইসি। আগামী পাঁচ বছরের জন্য সেতু ও সেতুর দুই
প্রান্তে যানবাহন চলাচলে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা, আধুনিক পদ্ধতিতে টোল আদায় এবং সেতু ও নদীশাসনের কাজ
রক্ষণাবেক্ষণ করবে। এর জন্য আগামী
৫ বছরে তাদের দিতে হবে ৬শ’৯৩ কোটি
টাকা।
এরই
মধ্যে পদ্মা সেতু পারাপারের জন্য টোল আদায়ের হার নির্ধারণ করেছে সরকার। গত ১৭ মে
এ সংক্রান্ত একটি প্রজ্ঞাপন জারি করেছে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়।
তাতে বিভিন্ন পরিবহনের জন্য আলাদা আলাদা টোল হার নির্ধারণ করা হয়েছে। পদ্মা সেতু পার হতে সর্বনিম্ন টোল দিতে হবে মোটরসাইকেল আরোহীকে। মোটরসাইকেলের জন্য টোল নির্ধারণ হয়েছে ১০০ টাকা, কার ও জিপের জন্য
৭৫০ টাকা, পিকআপ ১ হাজার ২০০
টাকা, মাইক্রোবাস ১ হাজার ৩০০
টাকা। ছোট বাস (৩১ আসন বা
এর কম) ১ হাজার ৪০০
টাকা, মাঝারি বাস (৩২ আসন বা
এর বেশি) ২ হাজার টাকা
এবং বড় বাস (৩
এক্সেল) ২ হাজার ৪০০
টাকা। ছোট ট্রাক (৫ টন পর্যন্ত)
১ হাজার ৬০০ টাকা, মাঝারি ট্রাক (৫ টনের অধিক
থেকে ৮ টন পর্যন্ত)
২ হাজার ১০০ টাকা, মাঝারি ট্রাক (৮ টনের অধিক
থেকে ১১ টন পর্যন্ত)
২ হাজার ৮০০ টাকা, ট্রাক (৩ এক্সেল পর্যন্ত)
৫ হাজার ৫০০ টাকা এবং ৪ এক্সেলের ট্রেইলারের
টোল ৬ হাজার টাকার
বেশি নির্ধারণ করা হয়েছে।
প্রজ্ঞাপনে
বলা হয়েছে, পদ্মা সেতু চালু হওয়ার দিন থেকেই এই টোল হার
কার্যকর হবে। এর আগে, টোল
হারের প্রস্তাব অনুমোদনের জন্য গত ২৮ এপ্রিল
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে পাঠায় সেতু মন্ত্রণালয়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বর্তমানে পদ্মা নদী পার হতে ফেরিতে যানবাহনভেদে ভাড়া দিতে হয় ৭০ থেকে
৩ হাজার ৯৪০ টাকা। নির্ধারিত প্রস্তাব অনুসারে, পদ্মা সেতুতে যানবাহনভেদে এখন টোল দিতে হবে ১০০ থেকে সাড়ে ৫ হাজার টাকা।
টোল বৃদ্ধির হার ৪২ শতাংশ থেকে
সাড়ে ৫১ শতাংশ; যা
বর্তমান ফেরিভাড়ার দেড়গুণ। আর দেশের দ্বিতীয়
দীর্ঘতম সেতু বঙ্গবন্ধু সেতুর টোলের তুলনায় পদ্মা সেতুর টোল হার হবে প্রায় দ্বিগুণ।
দেশের
সর্ববৃহৎ নবনির্মিত এই পদ্মা সেতু
নির্মাণে ১৫০ মিটার দৈর্ঘ্যর ৪১টি স্প্যান বসানো হয়েছে। মূল পদ্মা সেতুর দৈর্ঘ্য ৬ দশমিক ১৫
কিলোমিটার, আর প্রস্থ ১৮
দশমিক ১০ মিটার। দুই
প্রান্তের উড়ালপথ (ভায়াডাক্ট) ৩ দশমিক ৬৮
কিলোমিটার। সব মিলিয়ে সেতুর
দৈর্ঘ্য ৯ দশমিক ৮৩
কিলোমিটার। এটির জন্য প্রয়োজনীয় এবং অধিগ্রহণকৃত মোট জমির পরিমাণ ৯১৮ হেক্টর। পদ্মা সেতু প্রকল্পের জন্য মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৩০ হাজার ১৯৩
কোটি টাকা। এখন পর্যন্ত খরচ হয়েছে প্রায় ২৭ হাজার ৩৪১
কোটি টাকা। সেতু চালুর আগে প্রকল্প প্রস্তাব আবার সংশোধন হতে পারে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে ব্যয় বাড়বে কি না এবং
বাড়লেও কত বাড়তে পারে,
তা এখনো চূড়ান্ত হয়নি।
পদ্মা
সেতু চালু হলে দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের
২১টি জেলা সরাসরি ঢাকার সঙ্গে যুক্ত হবে। তখন বেশিরভাগ যানবাহনই ফেরির বদলে পদ্মা সেতু দিয়ে পারাপার করবে। এ সেতুর মাধ্যমে
মোংলা বন্দর ও বেনাপোল স্থলবন্দরের
সঙ্গে রাজধানী ও বন্দরনগরী চট্টগ্রামের
সরাসরি যোগাযোগ স্থাপিত হবে। এছাড়া ঢাকা-ভাঙ্গা সড়কে এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের ফলে এই রুটে যাতায়াতের
সময়ও কমবে প্রায় এক ঘণ্টা। যাতায়াতে
সুবিধার পাশাপাশি এই সেতু দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলসহ দেশের অর্থনীতিতেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। এক সমীক্ষায় দেখা
গেছে, পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) ১ দশমিক ২৩
শতাংশ হারে বাড়বে। আর দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জিডিপি বাড়বে ২ দশমিক ৩
শতাংশ।
সবমিলিয়ে
স্বপ্নের পদ্মা সেতু নিয়ে সারাদেশের মানুষের আগ্রহের শেষ নেই। এই সেতুর মাধ্যমে
শুধু দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের যাতায়াতের দুর্ভোগেরই অবসান হবে না; ওই অঞ্চল তথা
দেশে সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়নেও এটি এক মাইলফলক হবে।
তাই সেতুর ওপর দিয়ে কবে গড়াবে গাড়ির চাকা, সেই দিনক্ষণ গণনা চলছে। তবে অপেক্ষার পালা শেষ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উদ্বোধনের পর পর এবার
শুধু সেতুর ওপর দিয়ে পদ্মা পাড়ি দেয়ার পালা।
সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী আবু জাফর
যোগাযোগ: । [email protected] । বিজ্ঞাপন ও বার্তা সম্পাদক: 01894944220
ঠিকানা: বার্তা ও বাণিজ্যিক যোগাযোগ : বাড়ি নম্বর-২৩৪, খাইরুন্নেসা ম্যানশন, কাঁটাবন, নিউ এলিফ্যান্ট রোড, ঢাকা-১২০৫।
© 2025 Sangbad Sarabela All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh