সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে ঝিনাইদহের ওয়েস্টজোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের (ওজোপাডিকো) গ্রাহকরা। গ্রাহকদের অভিযোগ ঘুষ দিলে অতি সহজেই মিলছে সেবা আর ঘুষ না দিলে নানা হয়রানিসহ ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ঝিনাইদহ ওজোপাডিকো একটি শক্তিশালী দালাল সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে। ওজোপাডিকো ঝিনাইদহের নির্বাহী প্রকৌশলী রাশেদুল ইসলাম চৌধুরী, সহকারী প্রকৌশলী জাকির হোসেন ও উপ-সহকারী প্রকৌশলী উত্তম কুমার এর তত্বাবধানে মূলত এই দালাল সিন্ডিকেট পরিচালিত হয়ে আসছে।
গ্রাহকদের অভিযোগের ভিত্তিতে তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, নির্বাহী প্রকৌশলী রাশেদুল ইসলাম চৌধুরীর গড়ে তোলা এই সিন্ডিকেটের প্রধান দায়িত্বে আছেন ইমদাদুল হক বাবু নামের এক ব্যক্তি। মূলত দালাল সিন্ডিকেট পরিচালনার দায়িত্বে থাকা বাবু নিজেকে সদর উপজেলা কৃষকলীগের সহ-সভাপতি, কখনো আবার ওজোপাডিকো'র কম্পিউটর অপারেটর হিসাবে পরিচয় দেন। মূলত এই সিন্ডিকেটের মাধ্যমে নির্বাহী প্রকৌশলী রাশেদুল ইসলাম, সহকারি প্রকৌশলী সহ অন্যান্য কর্মকর্তা-কর্মচারীরা প্রতি মাসে গ্রাহকদের কাছ থেকে লক্ষ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন।
মানবাধিকার কর্মী সোনিয়া খান তুলি বলেন, আমার বাসার মিটারে ওয়াট কম থাকায় বিদ্যুৎ অফিসে সমাধানের জন্য গেলে উপ-সহকারী প্রকৌশলী উত্তম কুমার নন্দী অসদাচরণ করেন। পরবর্তীতে বিষয়টি নিয়ে নির্বাহী প্রকৌশলী রাশেদুল ইসলাম চৌধুরীকে জানানোর পর তিনি বলেন, ট্রান্সফর্মারে শক্তি নেই, ওয়াট লোড বাড়াতে টাকা লাগবে। তার পরামর্শে লোড বাড়াতে টাকা প্রদানের পর রশিদ চাইলে প্রকৌশলী রাশেদুল ইসলাম রশিদ দিতে অস্বীকৃতি জানান। তিনি আরও বলেন, এসব বিষয়ে প্রতিবাদ করায় বিদ্যুৎ অফিসের লোকজন কর্তৃক আমাকে বিড়ম্বনার শিকার হতে হয়েছে। ভোগান্তিস্বরুপ বিদ্যুৎ অফিসের লোকজন বৈদ্যুতিক খুঁটি থেকে মিটারের সংযোগ তার ৮-১০ বার লুজ করে রেখে গেছে।
শহরের আরেক বাসিন্দা সাইদুল ইসলাম টিটোন বলেন, জরুরি বিদ্যুৎ সেবার জন্য অফিসে কল দিলে অপর প্রান্ত থেকে বলতে শোনা যায় এখন গাড়ি নেই, গাড়ি কখন আসবে বলতে পারছিনা। কিন্তু দালালদের ফোন দিলে ৩০০-৪০০ টাকার বিনিময়ে সাথে সাথে বিদ্যুৎ অফিসের লাইনম্যান গাড়ি নিয়ে হাজির হয়।
শহরের আসিফ অপটিক্যাল এর মালিক ফরিদুর রহমান অভিযোগ করেন, গত আগস্ট মাসে বিল পরিশোধ করলেও সেপ্টেম্বর মাসের সাথে পুনরায় আগস্টের বিল করে পাঠানো হয়েছে। পরক্ষণে বিদ্যুৎ অফিসে যোগাযোগ করা হলে অফিস কর্তৃপক্ষ দুই মাসের বিল-ই পরিশোধ করতে বলেছে।
অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, দালাল সিন্ডিকেটের প্রধান ইমদাদুল হক বাবুর খন্দকার কম্পিউটার এন্ড ফটোকপি নামে ওজোপাডিকো অফিসের সামনে একটি দোকান আছে। সেই দোকান থেকেই মূলত নতুন মিটার সংযোগের কাজ সহ বিদ্যুৎ অফিসের যাবতীয় কারবার করা হয়। বাবুর ফেসবুক প্রোফাইলে দেখা যায়, সে সদর উপজেলা কৃষকলীগের নেতা হিসেবে শুভেচ্ছা ব্যানার, কখনো ওজোপাডিকো'র কম্পিউটার অপারেটর হিসেবে ঈদ শুভেচ্ছা ব্যানার পোস্ট করেছে। এছাড়াও সে ওজোপাডিকোতে সাবস্টেশনের মেরামত কাজে নিজের ছবি ও বিভিন্ন কর্মকর্তাদের সাথে ছবি তুলে তা ফেসবুকে পোস্ট করেছে। এতে বিন্দুমাত্র বোঝার উপায় নেই বাবু ওজোপাডিকো’র কোনো স্টাফ নন। এছাড়া বাবুর নিয়ন্ত্রিত দালাল চক্রের অন্যতম সদস্য হলো ভুটিয়ারগাতি গ্রামের রকি, কাঞ্চনপুরের মিজান ড্রাইভার, খাজুরার বাসিন্দা মিজা ইলেকট্রিশিয়ান, মিটার সেকশনের আসিফ, পবহাটি গ্রামের রিপন ও ড্রাইভার লোকমান।
এদিকে ওজোপাডিকো'র গাড়ির ড্রাইভার লোকমান ও রাশেদ দৈনিক মজুরী ভিত্তিতে নিয়োগপ্রাপ্ত হলেও বাড়তি উৎকোচের আশায় দুজনই গাড়ি চালানোর পরিবর্তে অন্য লোক রেখে দালাল সিন্ডিকেটের সাথে মিলেমিশে কাজে ব্যস্ত থাকেন।
এ বিষয়ে অভিযুক্ত ইমদাদুল হক বাবুর কাছে জানতে চাইলে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, আমি ঝিনাইদহ ওজোপাডিকো'র নিয়োগপ্রাপ্ত কোন ব্যক্তি নই এবং আমাকে কোন নিয়োগপত্র দেননি। নির্বাহী প্রকৌশলী রাশেদুল ইসলাম ব্যক্তিগতভাবে আমাকে কাজে নিয়েছেন। কাজের পারিশ্রমিক হিসাবে প্রতি মাসে ১২ হাজার টাকা বেতন দেন। এর বাইরে অন্য কোন অনিয়মের সাথে আমি জড়িত নই।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওজোপাডিকো'র কয়েকজন কর্মচারী অভিযোগ করেন, ওজোপাডিকো'র দালাল চক্রের আরেকজন নিয়ন্ত্রণকর্তা সহকারী প্রকৌশলী মো: জাকির হোসেন। তার তত্ত্বাবধানে দালাল চক্র দীর্ঘদিন যাবত এ অফিসে কাজ করে যাচ্ছে। এমনকি দালাল চক্রের সমস্ত টাকা-পয়সা লেনদেন ও ভাগবাটোয়ারার কাজটি করে থাকেন জাকির হোসেন।
এ বিষয়ে ওজোপাডিকো ঝিনাইদহ এর সহকারী প্রকৌশলী জাকির হোসেন জানান, ইমদাদুল হক বাবু সহ অন্যান্যরা অফিসের নিয়োগ প্রাপ্ত কোন স্ট্যাফ নন কিন্তু লোকবল সঙ্কট ও গ্রাহকদের সেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে তাদেরকে কাজে নেওয়া হয়েছে।
অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, নির্বাহী প্রকৌশলী রাশেদুল ইসলাম এই দালাল চক্রের মাধ্যমে ওজোপাডিকো অফিসে লুটপাটের রাজত্ব কায়েম করেছেন। ওজোপাডিকো অফিসের কোন অনিয়মের সংবাদ যেন বাইরে না যায় সেজন্য তিনি দালাল সিন্ডিকেটের লোকজনের মাধ্যমে বিভিন্ন সময় সাংবাদিকদের আটকে রেখে লাঞ্চিত করা, তথ্য না দেয়া, সাংবাদিকদের নামে মামলাসহ ক্ষমতা প্রদর্শনের বলয় তৈরি করে রেখেছেন এজন্য যে কোন সাংবাদিক যেনো ওজোপাডিকো অফিসে তথ্য নিতে না আসে।
এ সকল অভিযোগের ব্যাপারে নির্বাহী প্রকৌশলী রাশেদুল ইসলামের মুঠোফোনে বারবার ফোন দিলেও তিনি রিসিভ করেননি।