দান-সাদকা করার ব্যাপারে পবিত্র কোরআন ও হাদিসে অসংখ্য নির্দেশনা ও উপদেশ রয়েছে। তবে সে দান যদি আত্মীয়-স্বজন বা নিজেরদের জন্য হয় তাতে দ্বিগুণ সওয়াব হবে বলে ঘোষণা দিয়েছেন নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। এ ব্যাপারে দীর্ঘ একটি হাদিস এসেছে।
সাদকা বা দান আল্লাহর নৈকট্য লাভের অন্যতম মাধ্যম। সাদকা সম্পর্কে হাদিসের বর্ণনা হলো বিপদগ্রস্ত ও মিসকিনকে সাদকাহ করলে নেকি হবে আর অধিনস্ত অথবা আত্মীয়কে সাদকা করলে তা হবে দুটি সাদকা বা নেকির দ্বিগুণ সওয়াব। আর তাহলো সাদকা এবং সুসম্পর্ক-আত্মীয়তা রক্ষা করা। (আত-তারগীব)
বুখারি ও মুসলিম শরিফে বর্ণিত দীর্ঘ এক হাদিসে নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দান সদকার দ্বিগুণ প্রতিদান পাওয়ার বিষয়টি এভাবে ঘোষণা করেছেন:
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহুর স্ত্রী হজরত যাইনাব রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি একবার মসজিদে নববিতে ছিলাম। তখন নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে দেখলাম যে, তিনি (মহিলাদেরকে লক্ষ্য করে) বললেন, তোমরা তোমাদের গহনা থেকে হলেও দান কর।
আর যাইনাব তার স্বামী (আবদুল্লাহ) এবং যেসব ইয়াতিম তার প্রতিপালনে ছিল তাদের জন্য খরচ করতেন। একদিন হজরত যাইনাব (তার স্বামী) আবদুল্লাহকে বললেন, আপনি রাসুলুল্লাহকে জিজ্ঞাসা করুন, আমি যে আপনার এবং যে ইয়াতিম আমার পোষ্য আছে; তাদের জন্য খরচ করছি তা কি দান হিসেবে আমার পক্ষে যথেষ্ট হবে?
তিনি (আবদুল্লাহ) বলেন, তুমি গিয়েই রাসুলুল্লাহকে জিজ্ঞাসা কর। তখন আমি রাসুলুল্লাহ’র কাছে উপস্থিত হলাম এবং (বিশ্বনবির) দরজার কাছে এক আনসারি মহিলাকে দেখতে পেলাম। তার প্রয়োজনটাও ছিল আমার প্রয়োজনের মতো। তখন (হজরত) বিল্লাল রাদিয়াল্লাহু আনহু আমাদের কাছ দিয়ে যাচ্ছিলেন। আমরা উভয়ে তাঁকে বললাম। আপনি রাসুলুল্লাহকে জিজ্ঞাসা করুন, আমি আমার স্বামী এবং যে ইয়াতিম আমার তত্ত্বাবধানে আছে; তাদের জন্য খরচ করছি, তা কি দান হিসেবে আমার পক্ষে যথেষ্ট হবে?
আমরা (তাঁকে) আরও বললাম (প্রিয় নবির কাছে) আমাদের নাম বলবেন না। (হজরত) বিল্লাল নবির কাছে উপস্থিত হলেন এবং তাঁকে প্রশ্ন করলেন। তিনি বললেন, ওই নারী দু’জন কে? বিল্লাল রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন, যাইনাব। তিনি আবার জিজ্ঞাসা করলেন, কোন যাইনাব? বিল্লাল রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন, আবদুল্লাহর স্ত্রী।
নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ‘হ্যাঁ’, তার দ্বিগুণ সাওয়াব হবে। সাদকার সাওয়াব এবং আত্মীয়তা রক্ষা করার সাওয়াব।’ (বুখারি ও মুসলিম)
অন্য হাদিসে হজরত সালমান ইবনে আমের প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন তিনি বলেছেন, ‘সাধারণ দরিদ্র ব্যক্তিকে সাদকা বা দান করেল কেবল সাদকার সাওয়াব পাওয়া যায়। কিন্তু রক্তসর্ম্পীয় আত্মীয়কে সাদকা বা দান করলে সাদকাও হবে, আত্মীয়তাও রক্ষা হবে। (তিরমিজি, ইবনে হাব্বান, ইবনে খুজাইমা, মুসতাদরেকে হাকেম )
সুতরাং আত্মীয়তার সম্পর্ক বিনষ্ট নয় বরং আত্মীয়দের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখা উত্তম। আপনজনদের সাহায্য-সহযোগিতা করা সুন্নাতে নববির একান্ত দাবি। এতে আত্মীয়দের সম্পর্ক জোরদার হয়।
তাছাড়া আল্লাহ তাআলা কুরআনে পাকেও আত্মীয়তা রক্ষার ব্যাপারে নির্দেশ দিয়েছেন। আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী ব্যক্তির প্রতি অভিসম্পাত করেন। আল্লাহ তাআলা বলেন, `ক্ষমতা লাভ করলে সম্ভবত তোমরা পৃথিবীতে অনর্থ সৃষ্টি করবে এবং আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করবে। এদের প্রতি আল্লাহতায়ালা অভিসম্পাত করেন, অতঃপর তাদের বধির ও দৃষ্টি শক্তিহীন করেন। (সুরা মুহাম্মদ : আয়াত ২২-২৩)।
যেসব দান করলে সওয়াব বেশি হয়
আল্লাহর রাস্তায়: দান যেমনই হোক; মহান আল্লাহ ওই দানকে লালন করেন। যা এক সময় দানকারীর জন্য পাহাড় সমতুল্য হয়ে যায়। হাদিসে পাকে বিষয়টি এভাবে এসেছে:
হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, রাসুলুল্লাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,‘যে ব্যক্তি হালাল উপার্জন থেকে একটি খেজুর পরিমাণ সদকা করে; আর আল্লাহ হালাল ব্যতীত অন্যকিছু গ্রহণ করেন না। আল্লাহ তাআলা তা তাঁর ডান হাতে গ্রহণ করেন। এরপর তিনি তা লালন করেন; যেমন তোমাদের কেউ তার ঘোড়ার বাচ্চাকে লালন করে। এমনকি একসময় সে (সামান্য খেজুর পরিমাণ) সদকা পাহাড়তুল্য হয়ে যায়।’(বুখারি ও মুসলিম)
সুতরাং সাদকা দিতে হবে নিজেদের অধিনস্ত ও আত্মীয়-স্বজন, অসহায় বা অন্যদেরকেও। হাদিসে অন্যদের চেয়ে অধিনস্ত ও আপনজনকে সাদকায় সাওয়াব দ্বিগুণ বলেছেন নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। হাদিসে এসেছে:
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,‘নিশ্চয়ই মিসকিনকে সদকাদান একটি সদকা, আর আত্মীয়কে দানে রয়েছে দুটি সদকা ও আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা।
গোপনে দান করা: পবিত্র কোরআনের সুরা বাকারার ২৭১ নম্বর আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন, যদি তোমরা প্রকাশ্যে দান-সাদকা করো তবেভালো কথা। আর যদি তা গোপনে গরিব-দুঃখীকে পৌঁছে দাও তবে তা তোমাদের জন্য অতি উত্তম এবং এভাবে তোমাদের অনেক গোনাহ মাফ হয়ে যাবে। আর তোমরা যা কিছু করে থাকো আল্লাহ অবশ্যই তা জানেন।’ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি দান-সদকা করল, অতঃপর তা গোপন করল, এমনকি তার বাম হাত জানল না তার ডান হাত কী দান করছে- ওই ব্যক্তি হাশরের ময়দানে মহান আল্লাহর সুশীতল ছায়া প্রাপ্ত হবেন। যেদিন তাঁর ছায়া ব্যতীত অন্য কোনো ছায়া থাকবেনা। (বুখারি ও মুসলিম)
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, নফল সদকা গোপনে দান করলে তাতে ৭০ বেশি সাওয়াবলাভ হয়, পক্ষান্তরে ফরজ সদকা তথা জাকাত প্রকাশ্যে আদায় করলে তাতে ২৫ গুণ বেশি সাওয়াব পাওয়া যায়। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন দানের মাধ্যমে সাওয়াবলাভের পাশাপাশি গোনাহ মাফের ঘোষণাও দিয়েছেন।
হালাল রুজি থেকে দান করা: আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ও তাঁর রাসুল প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা) সদকার জন্য সম্পদের হালাল ও ভালো অংশ বেছে নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। পাশাপাশি অবৈধ উপায়ে অর্জিত সম্পদে লোক দেখানো দান-সাদকায় কোনো সওয়াব নেই বলেও হুঁশিয়ার করা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে- তোমরা কখনো ছাওয়াব অর্জন করতে পারবে না, যতক্ষণ না ব্যয় করবে তা থেকে, যা তোমরা ভালবাসো। (সুরা আলে ইমরান : ৯২)
দান গ্রহীতাকে খোঁটা ও কষ্ট দেয়া থেকে বিরত থাকা: ইসলামে সাদকা দেওয়ার ক্ষেত্রে আত্মীয়স্বজনদের প্রাধান্যের গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, যেসব আত্মীয়স্বজনের ব্যয়ভার বহন করতে হয় না, এ ধরনের আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে যারা অভাবি, তাদের সদকা দেওয়া একজন মুসলমানের জন্য মুস্তাহাব।
পবিত্র কোরআনের সুরা বাকারায় সদকা গ্রহীতাকে খোঁটা ও কষ্ট দেওয়া থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সুরাটির ২৬৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, হে মুমিনগণ তোমরা খোঁটা ও কষ্ট দেওয়ার মাধ্যমে তোমাদের সদকা বাতিল করো না।
যাদের প্রয়োজন তাদের অগ্রাধিকার দেয়া: রাসুলুল্লাহ (সা) বলেন, সে ব্যক্তি আমার প্রতি (যথাযথভাবে) বিশ্বাস স্থাপন করেনি, যে পরিতৃপ্ত হয়ে ঘুমায় এবং তার প্রতিবেশী তার পাশে ক্ষুধার্ত থাকে অথচ সে তার সম্পর্কে জানে।’ (মুজামুল কাবির, হাদিস : ৭৫১) এদিকে, গোপন দান প্রদানের ক্ষেত্রে ইসলামে অধিক গুরুত্ব দেওয়া হলেও বিশেষ ক্ষেত্রে প্রকাশ্য অপরিহার্য বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
দুর্ভিক্ষের দিনে অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত শ্রেণির ব্যাপারে ইরশাদ হয়েছে, ‘সে তো বন্ধুর গিরিপথে প্রবেশ করেনি। তুমি কি জানো বন্ধুর গিরিপথ কী তা হলো দাসমুক্ত করা অথবা দুর্ভিক্ষের দিনে খাবার দান করো এতিম আত্মীয়কে অথবা দারিদ্র্য নিষ্পেষিত নিঃস্বকে। (সুরা বালাদ, আয়াত : ১১-১৬)
সুতরাং মুমিন মুসলমানের উচিত, যথাসাধ্য আল্লাহর রাস্তায় সাদকা করা। যেখনে যেভাবে দান করা প্রয়োজন; হক আদায় করে দান-সাদকা করা। দান-সাদকার ব্যাপারে কোরআন-সুন্নাহর সুন্দর ও উত্তম উপদেশগুলো মেনে চলা।
মহান আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে তাদের নিজেদের অধিনস্ত ও আত্মীয়দের সঙ্গে সুম্পর্ক রাখার তাওফিক দান করুন। গরিব ও অসহায়দের সঙ্গে সঙ্গে নিজের অধিনস্ত ও আপনজনদেরকেও সাহায্য-সহযোগিতা করার তাওফিক দান করুন। অধিনস্ত ও আত্মীয়-স্বজনকে সহযোগিতা বা দান করার মাধ্যমে দ্বিগুণ সাওয়াব লাভের তাওফিক দান করুন। আমিন।
সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী আবু জাফর
যোগাযোগ: । [email protected] । বিজ্ঞাপন ও বার্তা সম্পাদক: 01894944220
ঠিকানা: বার্তা ও বাণিজ্যিক যোগাযোগ : বাড়ি নম্বর-২৩৪, খাইরুন্নেসা ম্যানশন, কাঁটাবন, নিউ এলিফ্যান্ট রোড, ঢাকা-১২০৫।
© 2025 Sangbad Sarabela All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh