২০২৩ সালের বাংলাদেশ অপরাধ গবেষণা কেন্দ্রের একটি প্রতিবেদনে খুব সুন্দর ভাবে ফুটে ওঠে, নগরাঞ্চলে অপরাধের পরিমাণ বৃদ্ধি যে শুধু বাংলাদেশের নাগরিকদের জন্য একটি স্বাভাবিক সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে, তা নয়; এটি সমাজের পুরো কাঠামোতে গভীর প্রভাব ফেলছে।
প্রতিদিনের জীবনযাত্রা অপরাধের কারণে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, বিশেষ করে ঢাকা শহরের মতো ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায়, যেখানে অপরাধের হার ভয়াবহভাবে বেড়ে চলেছে। মাদকাসক্তি, চুরি, ডাকাতি, এবং সড়ক অপরাধ এখন শহরের নানা প্রান্তে একটি অবিচ্ছিন্ন প্রবণতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অপরাধের এই বিস্তার সাধারণ নাগরিকদের মনে এক ধরনের অস্থিরতা সৃষ্টি করছে, যার ফলে তারা নিজের নিরাপত্তা নিয়ে চরম উদ্বেগে দিন কাটাচ্ছে।
এই পরিস্থিতি শুধু সমাজের শৃঙ্খলা ও সুরক্ষা ব্যবস্থা নষ্ট করছে না, বরং আমাদের মানবিক মূল্যবোধকেও প্রশ্নবিদ্ধ করছে।
ঢাকা শহরের অপরাধ বৃদ্ধির এক মৌলিক কারণ হল মাদকাসক্তি, যা বিশেষত তরুণ সমাজকে অপরাধে জড়িয়ে ফেলছে। প্রতি বছর হাজার হাজার তরুণ মাদকসেবনের কারণে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অপরাধে যুক্ত হচ্ছে। মাদকদ্রব্য যেমন হেরোইন, কোকেন এবং মাদক এলএসডি, এই তরুণদের মানসিক অবস্থা ও আচরণকে ক্রমশ বিপথগামী করে তুলছে, ফলে তারা প্রতিদিন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হচ্ছে।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকায় মাদকাসক্ত যুবকদের দ্বারা সড়ক চুরি, ছিনতাই, এবং ডাকাতি ঘটছে। ২০২৩ সালে পুলিশ রিপোর্টে দেখা গেছে, মাদকদ্রব্যের ব্যবহার বেড়ে যাওয়ার কারণে চুরি ও অপরাধের হার প্রায় ৩০% বৃদ্ধি পেয়েছে। এই মাদকাসক্তি শুধু একজন ব্যক্তির জীবনকে ধ্বংস করছে না, বরং পুরো সমাজের জন্য বিপজ্জনক পরিস্থিতি তৈরি করছে। তাইতো রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ , ‘বাতাসে লাশের গন্ধ’ বলে যান যে ”আমি কবি, তবু শুধু প্রেম নয়, আমার ছন্দে শোনা যায় হাহাকার।
আমার কণ্ঠে উঠে আসে—
নিপীড়িতদের অপমানিত আর্তনাদের চিৎকার।”
আরেকটি সমস্যার দিক হলো নারীর প্রতি সহিংসতা, যা দিন দিন বাড়ছে। একাধিক ঘটনা দ্বারা প্রমাণিত, বিশেষত রাজধানী ঢাকায়, নারীরা একাধিক ধরনের অপরাধের শিকার হচ্ছে—যেখানে ধর্ষণ, যৌন হেনস্থা এবং ঘরোয়া সহিংসতা অন্যতম। এই ধরনের অপরাধ কেবল অপরাধীর দৃষ্টিকোণ থেকে নয়, বরং সমাজের বৃহত্তর সিস্টেমের মধ্যেও এক ধরনের সিস্টেমিক সমস্যা হিসেবে দাঁড়িয়ে রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ২০২৩ সালের একটি পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, নারীর প্রতি সহিংসতার শিকার হওয়া ৪০% নারী ঘটনার পরও থানায় অভিযোগ করতে সাহস পান না, কারণ তাদের কাছে আইন ব্যবস্থার প্রতি আস্থা নেই। তাছাড়া, সামাজিক শৃঙ্খলা ও অপরাধের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার পরিবেশ তৈরি না হওয়ার কারণে অনেক নারীই তাদের সমস্যাগুলি চেপে রাখে, ফলে অপরাধ আরও বৃদ্ধি পায়। এই ধরনের সহিংসতা শুধুমাত্র ব্যক্তিগত সমস্যা নয়, এটি সমাজের মধ্যে সুষ্ঠু সম্পর্কের অভাবের কারণে ঘটছে।
এছাড়া, অপরাধের এই বৃদ্ধি মফস্বল শহরগুলোতে আরও বড় সমস্যা সৃষ্টি করছে। বর্তমানে চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, সিলেট—এই শহরগুলোতে অপরাধ বৃদ্ধি পেয়ে যায়। ছোট শহরগুলো, যেখানে সাধারণত অপরাধ কম হয়, সেখানে এখন ক্রমবর্ধমান সামাজিক অস্থিরতা ও অপরাধের প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। এদের মধ্যে অনেকেই মনে করছেন যে, অপরাধ করা এখন তাদের জীবনের অঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে, কারণ সরকার ও প্রশাসন সেখানে যথেষ্ট কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করছে না। মফস্বল শহরগুলোতে এর কারণে অনেক সমাজে উদ্বেগ বেড়ে যাচ্ছে। এখানে প্রশাসনিক দায়িত্বহীনতা, সীমিত আইন প্রয়োগ এবং অপরাধ দমনে অভাবের কারণে অপরাধ বেড়েই চলেছে।
এই সমস্ত পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য সরকারকে তাৎক্ষণিক এবং স্থায়ী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। আইনের শাসন নিশ্চিত করার জন্য পুলিশ বাহিনীর দক্ষতা বৃদ্ধি করা উচিত। শুধু তাই নয়, পুলিশের সঙ্গে জনগণের সম্পর্ক আরও দৃঢ় করা জরুরি, যাতে তারা সমাজের নিরাপত্তা বজায় রাখতে সহযোগিতা করতে পারে। এক্ষেত্রে প্রযুক্তির ব্যবহার অপরিহার্য। অপরাধ রোধে প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি করতে হবে, যেমন ক্যামেরা সিস্টেম, ড্রোন পর্যবেক্ষণ এবং স্বয়ংক্রিয় নজরদারি ব্যবস্থা।
এছাড়া, মাদক নিয়ন্ত্রণের জন্য কার্যকর নীতি গ্রহণ করা জরুরি। মাদক পরিবহন, উৎপাদন এবং ব্যবহার রোধে আরও কঠোর আইন প্রয়োগ করা উচিত। শাস্তির বিধান যেন যথাযথভাবে কার্যকর হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে। অপরাধীদের পুনর্বাসন কেন্দ্র গঠন করে তাদের সমাজে সঠিকভাবে ফিরে আসার সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। সামাজিক ও শিক্ষা সংক্রান্ত প্রচারণার মাধ্যমে তরুণ সমাজকে অপরাধের বিরুদ্ধে সচেতন করতে হবে। শুধু শাস্তি নয়, বরং শিক্ষা ও পুনর্বাসন ব্যবস্থা নিশ্চিত করা জরুরি।
এমনকি, সামাজিক নিরাপত্তা এবং সহিংসতা প্রতিরোধে স্থানীয় কমিউনিটিকে আরও শক্তিশালী করতে হবে। জনগণকে উদ্বুদ্ধ করা, একে অপরের পাশে দাঁড়ানো এবং শক্তিশালী সমাজ গঠন করা অপরাধের বিরুদ্ধে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হতে পারে। এই ক্ষেত্রে সরকারের পাশাপাশি সামাজিক সংগঠন এবং জনগণের সমন্বিত প্রচেষ্টা অপরিহার্য।
ড. ইউনূসের প্রধান উপদেষ্টা হওয়ার পর, তার অভিজ্ঞতা ও সমাজ-দর্শনভিত্তিক কৌশলের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানে এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গির সূচনা ঘটে। নারী উদ্যোক্তাদের জন্য ‘সোশ্যাল বিজনেস ইনকিউবেশন সেন্টার’ প্রতিষ্ঠা ও তরুণদের জন্য ‘ইমপ্যাক্ট ইনভেস্টমেন্ট প্রোগ্রাম’ চালু হওয়ার পর, ২০২৪ সালের মধ্যেই ৫০০+ স্টার্টআপ সফলভাবে দাঁড়িয়ে যায়। তার দিকনির্দেশনায় গ্রামীণ অর্থনীতিতে কর্মসংস্থান, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার প্রসার ঘটে, যা সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তনের আলোকবর্তিকা হয়ে দাঁড়ায়। এই উদ্যোগগুলো প্রমাণ করে—উপদেষ্টার সঠিক দিকনির্দেশনা কেবল একটি প্রতিষ্ঠানকেই নয়, গোটা সমাজকেই বদলে দিতে পারে।
“একটি নিরাপদ সমাজ গড়ে ওঠে তখনই, যখন প্রতিটি মানুষ অপরাধ নয়, মানবতাকে বেছে নেয়।”
সংক্ষিপ্ত জীবনী :
ড: তারনিমা ওয়ারদা আন্দালিব বর্তমানে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে সহকারী অধ্যাপক এবং যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড ইমপ্যাক্ট গ্রুপে গ্লোবাল কনসালট্যান্ট ডিরেক্টর হিসেবে কর্মরত আছেন।
দাউদ ইব্রাহিম হাসান, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিএস ডিপার্টমেন্টের একজন রিসার্চ এসিস্ট্যান্ট হওয়ার পাশাপাশি আইডিএলসি ফাইন্যান্স পিএলসি’র মার্কেটিং ডিপার্টমেন্টের সাথে নিয়োজিত আছেন।