বাংলাদেশে টেকসই ব্যাংকিংযাত্রার অন্যতম পথিকৃৎ হিসেবেদেশেরপ্রথম কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের একটি হিসেবে সব ধরনের গ্রিনহাউস গ্যাস (জিএইচজি)নিঃসরণের তথ্য প্রকাশ করেছে ব্র্যাক ব্যাংক। ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ কার্যক্রম থেকে শুরু করে ফাইন্যান্সিয়াল কার্যক্রম পর্যন্ত সকল বিষয়ে মোট কার্বন নিঃসরণের তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে এতে।
২০২৪ সালের ‘সাসটেইনেবিলিটি অ্যান্ড ইমপ্যাক্ট রিপোর্ট’প্রকাশের মাধ্যমে ব্র্যাক ব্যাংক পূর্ণাঙ্গ কার্বন অ্যাকাউন্টিং সম্পন্ন করেছে। এতে দেখা গেছে, ব্যাংকের মোট নিঃসরণকৃত কার্বন ডাই-অক্সাইড ইক্যুইভ্যালেন্ট (tCO₂e)১৪,৭৭,৪৬৮ টন,যার মধ্যে রয়েছে ডিরেক্ট (স্কোপ-১), এনার্জি বিষয়ক (স্কোপ-২) এবং ভ্যালু চেইন (স্কোপ-৩) নিঃসরণ। এটি আর্থিক খাতে পরিবেশগত স্বচ্ছতার দিকে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
স্কোপ-১ এর আওতায় আছে ব্যাংকের নিজস্ব মালিকানাধীন বা নিয়ন্ত্রণাধীন উৎস (ডিজেল জেনারেটর, রেফ্রিজারেন্ট, গাড়ির জ্বালানি) থেকে নিঃসরণকৃত কার্বনের পরিমাণ ১,৬৩০ টন।
স্কোপ-২ এর আওতায় আছে বিদ্যুৎ ক্রয়ের মাধ্যমে পরোক্ষভাবে সৃষ্ট কার্বনের পরিমাণ ১৬,৬৭১ টন।
স্কোপ-৩-এ আছে ব্যাংকের ভ্যালু চেইনের বিভিন্ন পর্যায়ে সৃষ্ট পরোক্ষ নিঃসরণ, যার পরিমাণ ১৪,৫৯,১৬৭ টন।স্কোপ ৩-এর সবচেয়ে বড় অংশটি এসেছে ব্যাংকের অর্থায়নকৃত খাতগুলো থেকে, যার পরিমাণ ১৪,২৩,৪৭৯ টন।এটিব্যাংকের মোট কার্বন ফুটপ্রিন্টের ৯৬ শতাংশেরও বেশি।স্কোপ-৩নির্গমনের বাকি অংশ(৩৫,৬৮৭ tCO₂e) উৎপাদনের জন্য দায়ীবিজনেস ট্রাভেল, বর্জ্য, প্রকিউরমেন্ট এবং কর্মীদের যাতায়াতে ব্যবহৃত পরিবহন।
এটি ব্র্যাক ব্যাংককে দক্ষিণ এশিয়ায় অনন্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্থান করে দিয়েছে, যারা গ্রিনহাউস প্রোটোকল দ্বারা সংজ্ঞায়িত স্কোপ ৩-এর অধীনে স্বেচ্ছায় ক্যাটাগরি ১৫ নির্গমন রিপোর্ট করে - যা একটি ব্যাংকের জলবায়ু প্রভাবের সবচেয়ে জটিল এবং বস্তুগত দিক হিসাবে বিবেচিত হয়, বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত পার্টনারশিপ ফর কার্বন অ্যাকাউন্টিং ফাইন্যান্সিয়ালস (PCAF) স্ট্যান্ডার্ডের উপর ভিত্তি করে পরিমাপের মাধ্যমে।
২০২৪ সালেক্লিন এনার্জি ও সৌরবিদ্যুৎ ব্যবস্থায় বিনিয়োগের মাধ্যমে ব্যাংকটি ১৮,১১২ টন কার্বন নিঃসরণ পরিহার করতে সমর্থ হয়েছে, যারফলে নিট নিঃসরণ দাঁড়িয়েছে ১৪,৫৯,৩৫৬ টনে।
বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ব্যাংকের অর্থায়নকৃত তিনটি খাত, যথা- পেট্রোলিয়াম ও কেমিক্যালস, খাদ্য ও পানীয়এবং ধাতব বস্তু উৎপাদন৬১.৫% কার্বন নিঃসরণের জন্য দায়ী, যদিও ব্যাংকটির দেওয়া মোট ঋণের মাত্র ২১% দেওয়া হয়েছিল উল্লিখিত খাতে। এই তথ্যগুলো ব্যাংকের ট্রানজিশন-ফাইন্যান্স কৌশল প্রণয়নে ভূমিকা রাখছে, যার মাধ্যমেব্যাংকটির লক্ষ্য হলো, উচ্চ কার্বন নিঃসরণকারী খাতগুলোর কার্বন ফুটপ্রিন্ট হ্রাসে সহায়তার পাশাপাশি টেকসই খাতে বিনিয়োগ বাড়ানো।
হিসাবের সঠিকতা নিশ্চিত করতে ব্যাংকটি ইন্টারন্যাশনাল সাসটেইনেবিলিটি স্ট্যান্ডার্ডস বোর্ড (আইএসএসবি)-এর অধীন ‘জিএইচজি প্রটোকল, জিআরআই স্ট্যান্ডার্ডস, আইএফআরএস এস-১ অ্যান্ড এস-২’আন্তর্জাতিক কাঠামোর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে এই প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এছাড়াও, ব্যাংকটি পোর্টফোলিও রিস্ক মূল্যায়নে সেক্টরভিত্তিক কার্বন ইনটেনসিটি মেট্রিকস ও ক্লাইমেট ভালনারেবিলিটি ইনডেক্স (সিভিআই)-এর মতো নিজস্ব টুলও ব্যবহার করেছে।
কার্বন নিঃসরণ তথ্য প্রকাশের বাইরেও এই উদ্যোগটি ব্যাংকটিরঅপারেটিং ফিলোসপিতে বড় পরিবর্তনের ইঙ্গিত বহন করে। ব্র্যাক ব্যাংকের ক্রেডিট রিস্ক ফ্রেমওয়ার্কে যুক্ত হয়েছে জিএইচজিইনটেনসিটি এবং সেক্টোরাল এক্সপোজার ইন্ডিকেটরস, যা রিয়েল-টাইম নিঃসরণ মনিটরিংয়ে সহায়তা করছে। এর ফলে ভবিষ্যতে টেকসই উন্নয়ন ও কার্বন হ্রাস-সম্পর্কিত লোন প্রোডাক্ট চালুর ভিত প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, যেগুলোর মাধ্যমে ক্লায়েন্টদের জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন আর্থিক সুবিধা দেওয়া সম্ভব হবে।
এই উদ্যোগটি বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে জলবায়ু দায়বদ্ধতা প্রতিষ্ঠায় এক নতুন মাইলফলক, যা বৈশ্বিক সবুজ অর্থায়ন পরিমণ্ডলে ব্র্যাক ব্যাংকের অবস্থানকে আরও শক্তিশালী করেছে। এর ফলে ব্র্যাক ব্যাংক শক্তিশালী অবস্থানে থেকে আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা, গ্রীন বন্ড মার্কেট এবং বৈশ্বিক ইএসজিবিনিয়োগকারীদের সঙ্গে আলোচনার সুযোগ পাবে।
জলবায়ু বিষয়ে ব্র্যাক ব্যাংকের এই প্রতিশ্রুতি উচ্চ কার্বন নিঃসরণকারী ক্লায়েন্টদের নির্গমন হ্রাসেরখাতভিত্তিক রোডম্যাপ তৈরি করেছে, যা তাদেরনির্গমন হ্রাসের নির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করে দেওয়ার পাশাপাশি তাদের জন্য কার্বন-লিটারেসি টুলও চালু করেছে। এগুলোর মধ্যেউল্লেখযোগ্য হলো,সম্প্রতি ব্যাংক একটি ৬৮ মেগাওয়াটের গ্রিড-টাইড সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্পে বিনিয়োগ করেছে, যা প্রতি বছর ৭০,০০০ টনেরও বেশিকার্বন নিঃসরণ প্রতিরোধ করতে পারবে। এছাড়াও,ব্যাংকটি এখন পর্যন্তজলবায়ু-স্মার্ট প্রযুক্তির উন্নয়নে৫৩,৩৫৭ মিলিয়ন টাকা ট্রানজিশন ফাইন্যান্সে বরাদ্দ দিয়েছে।
ব্র্যাক ব্যাংকের এই যুগান্তকারী উদ্যোগ এক নতুন বেঞ্চমার্ক স্থাপন করেছে। কার্বন নিঃসরণ রিপোর্ট প্রকাশের মাধ্যমে ব্র্যাক ব্যাংক প্রমাণ করেছে যে, শুধু প্রতিশ্রুতি দিয়েই নয়, বরং পরিমাপযোগ্য ওতথ্যভিত্তিক বাস্তব পদক্ষেপের মাধ্যমে আর্থিক প্রতিষ্ঠানও অর্থনীতির কার্বন নিরপেক্ষীকরণে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে।
গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনের পরিমাণ পরিমাপের মাধ্যমেব্র্যাক ব্যাংক বাংলাদেশের আর্থিক খাতে জলবায়ু জবাবদিহিতাকে নতুন মাত্রা দিয়েছে।
পাশাপাশি ব্যাংকটিএকটি ফিউচার-প্রুফ ও ইমপ্যাক্ট-ড্রিভেন নীলনকশাও তৈরি করেছে, যা পরিবেশের উন্নয়নে নীতি সংস্কার ও পারস্পরিকসহযোগিতার মাধ্যমে অর্থপূর্ণ বিনিয়োগকারীদের এই লক্ষ্যেসম্পৃক্ত করতে ব্যাপক ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা যাচ্ছে।