× প্রচ্ছদ বাংলাদেশ বিশ্ব রাজনীতি খেলা বিনোদন বাণিজ্য লাইফ স্টাইল ভিডিও সকল বিভাগ
ছবি ভিডিও লাইভ লেখক আর্কাইভ

স্বপ্নকে কবর দিচ্ছে তালেবান: ধ্বংসের মুখে আফগানিস্তানের নারী সমাজ?

আফিফা শহীদ মাম

১৮ অক্টোবর ২০২৫, ১৪:৫৩ পিএম

আফগানিস্তানের আকাশে যখন রক্তিম সূর্যোদয় ঘটে, তখন সেই আলোয় প্রতিফলিত হয় সমগ্র এক জাতির সংগ্রাম, আশা, আর নিঃশব্দ কান্নার প্রতিচ্ছবি। সেই কান্নার স্রোত, ভেসে বেড়ায় কাবুলের রাস্তায়, মাজার-ই-শরীফের অলিতে-গলিতে আর হেরাতের বুকে। আফগান মহিলাদের ভবিষ্যৎ এখন কার হাতে? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে, আমাদের ফিরে তাকাতে হবে সেই নিষ্ঠুর বাস্তবতার দিকে, যেখানে স্বপ্নের ডানা ভেঙে যায় প্রতিনিয়ত, যেখানে আশার আলো অর্ধনির্মীত সূর্যের মতনই ডুবন্ত। কিন্তু, এই অন্ধকারে কিছু আলোর রেখা উদীয়মানের কোনো সম্ভাবনা আদৌ নেই? এই জিজ্ঞাসাটি কেবল একটি প্রশ্ন নয়, এটি যেন লক্ষ লক্ষ আফগান মেয়ের হৃদয়ের অব্যক্ত আর্তি।

২০২১ সালে তালেবান আবার ক্ষমতায় আসার পর যেন আফগানিস্তানের মেয়েদের পায়ে শেকল পড়ে। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় লাখ লাখ মেয়ে স্কুলের ক্লাসরুমের ঘণ্টা শোনার সুযোগ হারিয়েছে। কল্পনা করুন, ক্লাস শেষের সেই পরিচিত হাঁকডাক, বই-খাতার মলাট উল্টানোর মিষ্টি শব্দ আর সহপাঠীদের সঙ্গে হাসি-ঠাট্টা—এসবই আজ তাদের কাছে এক দূর স্মৃতি। ইউনেস্কোর তথ্যমতে, ২০২৪ সালের আগস্ট পর্যন্ত প্রায় ২.২ মিলিয়ন মেয়ে স্কুলে শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ হারিয়েছে। শুধুই স্কুল নয়, বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষামূলক প্রতিষ্ঠানেও মেয়েদের জন্য পাঠ্যক্রম, ক্লাস প্রদান এবং লাইব্রেরি সুযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। যেন জ্ঞানের আলো থেকে তাদের দূরে সরিয়ে, এক রুদ্ধ দুয়ারের ওপারে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। যখন গোটা দুনিয়া প্রযুক্তির হাত ধরে এগিয়ে চলেছে, তখন তালেবান প্রশাসন ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বরে বালখ প্রদেশে ফাইবার অপটিক ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়, যা মেয়েদের অনলাইন শিক্ষার পথেও এক দুর্ভেদ্য প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে এবং তাদের শিক্ষাজগৎ থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। এটি কেবল একটি ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ করা নয়, এটি যেন লক্ষ লক্ষ হৃদয়ের আশার বাতি নিভিয়ে দেওয়া।

শিক্ষার পথ বন্ধ হওয়া মাত্রই, কর্মক্ষেত্রেও তালেবান মহিলাদের অংশগ্রহণ কার্যত নিষিদ্ধ করেছে সরকার। একজন নারীর স্বাধীনভাবে নিজের জীবন গড়ার স্বপ্ন, পরিবারকে সহায়তা করার আকাঙ্ক্ষা—সবই যেন আজ মরুভূমির বালিতে মিশে যাচ্ছে। ২০২৫ সালের জুনে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ৭৮% আফগান তরুণী শিক্ষা, কর্মসংস্থান এবং প্রশিক্ষণ থেকে বঞ্চিত, যা পুরুষদের তুলনায় প্রায় চারগুণ বেশি। অর্থাৎ, মহিলারা শুধু শিক্ষার অধিকার হারাচ্ছে না, স্বাধীনভাবে অর্থ উপার্জন বা নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার সুযোগ থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে, যা তাদের আত্মমর্যাদা ও স্বাবলম্বী হওয়ার পথে এক বিশাল বাধা।

শিক্ষা এবং কর্মসংস্থান থেকে বঞ্চনার পাশাপাশি স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা ক্ষেত্রেও মহিলারা মারাত্মক সীমাবদ্ধতার মুখোমুখি। স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলোতে মহিলাদের প্রবেশাধিকার সীমিত করা হয়েছে। এছাড়াও নার্স, ডাক্তার এবং স্বাস্থ্যকর্মী হিসেবে তাদের অংশগ্রহণ প্রায় শূন্য (WHO, 2023)| একজন নারীর স্বাস্থ্যসেবার জন্য অপর একজন নারীর প্রয়োজন, কিন্তু সেই পথও রুদ্ধ। এর করুণ পরিণতি দেখা যায় পরিসংখ্যানেও: ২০২৩ সালে প্রকাশিত World Bank Gender Data Portal অনুযায়ী, ১৫-১৯ বছর বয়সী প্রতি ১,০০০ জন মেয়ে থেকে ৬৪ জন গর্ভবতী হয়েছে। এটি কেবল দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার দুর্বলতা ও মহিলাদের প্রতি অবহেলার স্পষ্ট চিত্রই ফুটিয়ে তোলে না, বরং অপরিণত মাতৃত্বের অসহনীয় যন্ত্রণা আর দীর্ঘশ্বাসের গল্প শোনায়।

তালেবান আফগানী মহিলাদের লেখালেখির স্বাধীনতাও হরণ করেছে। ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে, তালেবান আফগান বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পাঠ্যক্রম থেকে ৬৭৯টি বই নিষিদ্ধ করেছে, যার মধ্যে ১৪০টি বই মহিলাদের লেখা। এই বইগুলোর মধ্যে মানবাধিকার, নারীর অধিকার ও পশ্চিমা রাজনৈতিক চিন্তা-ধারার উপর লেখা বই অন্তর্ভুক্ত ছিল। এই নিষেধাজ্ঞার প্রভাব মহিলাদের চিন্তা-ভাবনা ও সৃজনশীলতাকে স্তব্ধ করে দিয়েছে। যখন একজন লেখক তার কলমের ডগায় হাজারো স্বপ্ন আর ভাবনাকে জীবন্ত করে তোলেন, তখন সেই কলম কেড়ে নেওয়া মানে শুধু কাগজ আর কালির ক্ষতি নয়, বরং একটি স্বাধীন মনকে শৃঙ্খলিত করা। তারা তাদের অভ্যন্তরীণ কল্পনা ও চিন্তাধারা প্রকাশ করতে পারছে না, যা তাদের মানসিক স্বাস্থ্য ও আত্মবিশ্বাসকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। এছাড়া, এই নিষেধাজ্ঞাগুলো আন্তর্জাতিক মহলে আফগানিস্তানের ভাবমূর্তিকে আরও খারাপ করছে, যা দেশের বৈদেশিক সম্পর্ক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করছে।

তালেবানের নিপীড়ন ও নিষেধাজ্ঞার মাঝে, আফগান মহিলারা তাদের অধিকার ও স্বাধীনতার জন্য অদম্য সাহসিকতার সঙ্গে সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন। এই সংগ্রাম শুধুমাত্র তাদের নিজস্ব জীবনের জন্য নয়, বরং পুরো জাতির ভবিষ্যতের জন্যও এক আশার প্রদীপ। যেমন, ১৯ বছর বয়সী সামিরা, যিনি তালেবানের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও অনলাইনে মেয়ে শিক্ষার্থীদের শিক্ষা দিয়ে যাচ্ছেন। তার শিক্ষার্থীরা সীমিত জায়গা ও ইন্টারনেট সংযোগ সমস্যার মধ্যেও পড়াশুনা চালিয়ে যাচ্ছে, যা তাদের দৃঢ় সংকল্পের প্রমাণ। যেন নিভে যাওয়া প্রদীপের সলতে থেকে আরেকবার আলো জ্বালানোর প্রচেষ্টা। এছাড়া পাশতানা দুওরানি, যিনি LEARN Afghanistan প্রতিষ্ঠা করেছেন, যা আফগানিস্তানের প্রথম ডিজিটাল স্কুল নেটওয়ার্ক। তিনি ২০১৮ সালে এই উদ্যোগ শুরু করেন, যা এখন ১০,০০০ ছাত্রছাত্রীকে শিক্ষা প্রদান করছে। তালেবান শাসন প্রতিষ্ঠার পর, তিনি আফগানিস্তান থেকে পালিয়ে গেলেও আন্তর্জাতিক মঞ্চে আফগান মেয়েদের শিক্ষা অধিকার নিয়ে কাজ করছেন। তিনি যেন দুর্গম পথের মশালবাহী।

তবে, আফগান মহিলাদের এই সংগ্রামের আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ঐকান্তিক সমর্থন প্রয়োজন। তা না হলে এসকল প্রচেষ্টা সময়সাপেক্ষ ও ব্যয়বহুল হবে। বিশ্ববিদ্যালয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে তাদের শিক্ষা কার্যক্রমের জন্য অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ও সংস্থান প্রদান করতে হবে। এছাড়া, বিভিন্ন দেশের সরকারগুলোকে আফগান মহিলাদের অধিকার রক্ষায় কূটনৈতিক চাপ প্রয়োগ করতে হবে। তা করা না হলে আফগান মহিলাদের ভবিষ্যৎ প্রতিনিয়ত অন্ধকারে নিমজ্জিত হবে। আফগান মহিলাদের এই লড়াই যেন এক অবিরাম নদীর মতো—যা বহু বাধা পেরিয়েও তার গন্তব্যের দিকে এগিয়ে চলে। “ভাঙা ডানা নিয়েও উড়ব আকাশে, কণ্ঠরোধ করেও গাইব মুক্তির গান; প্রতিটি শৃঙ্খল হবে বিদ্রোহের ভাষা, আফগান নারী, তোমার মধ্যেই নতুন সূর্যের সন্ধান।”

লেখক, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী 


Sangbad Sarabela

সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী আবু জাফর

যোগাযোগ: । [email protected] । বিজ্ঞাপন ও বার্তা সম্পাদক: 01894944220

ঠিকানা: বার্তা ও বাণিজ্যিক যোগাযোগ : বাড়ি নম্বর-২৩৪, খাইরুন্নেসা ম্যানশন, কাঁটাবন, নিউ এলিফ্যান্ট রোড, ঢাকা-১২০৫।

আমাদের সঙ্গে থাকুন

© 2025 Sangbad Sarabela All Rights Reserved.