× প্রচ্ছদ বাংলাদেশ বিশ্ব রাজনীতি খেলা বিনোদন বাণিজ্য লাইফ স্টাইল ভিডিও সকল বিভাগ
ছবি ভিডিও লাইভ লেখক আর্কাইভ

বিচার চেয়ে কি অবিচারই নিয়তি?

ড: তারনিমা ওয়ারদা আন্দালিব, এবং দাউদ ইব্রাহিম হাসান

১১ নভেম্বর ২০২৫, ১২:৫২ পিএম

আজকের এই লেখাটি কোনো একক মানুষের ব্যক্তিগত অনুভূতি নয়, এটি যুগ যুগ ধরে বিচারপ্রার্থী মানুষের বুকের ভেতর জমা হওয়া সেই তীব্র আর্তনাদ, যা আইনি মারপ্যাঁচের কঠিন পাথরে পিষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এটা কেবল কিছু পরিসংখ্যানের কঙ্কাল নয়, এটা সেই অদৃশ্য বারুদে ভেজা শব্দের স্তূপ—যা আমাদের সামগ্রিক আকাঙ্ক্ষা ও বিদ্রোহকে ফুটিয়ে তোলে। এক গভীর, অসহনীয় যন্ত্রণা নিয়ে আমরা আজ এই কাহিনীর দিকে তাকাচ্ছি। আমরা জানি, প্রতি বছর যত মানুষ বিচার চেয়ে আদালতের দরজায় আসে, তাদের প্রায় ১২% (২০১৫ সালের তথ্য মতে) শুরুতেই হোঁচট খায় সিস্টেমের জটিলতায়। মাশরুঙ্গা টিভির 'অনুসন্ধান' অনুষ্ঠানে যে চিত্রটি উন্মোচিত হয়েছিল, তা কেবল একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং আমাদের সমাজের এক গভীর ক্ষত—যেখানে 'সুবিচার চেয়ে' উল্টো 'অবিচারের মামলায়' জড়িয়ে পড়ার এক করুণ উপাখ্যান লুকিয়ে আছে। লেখক হিসেবে আমরা আজ সেই গল্পের ভেতরের অনুভূতি আর বাস্তবতার নির্মম বিশ্লেষণ আপনাদের সামনে তুলে ধরব, যা কেবল আমাদের চোখের কোণে জল আনবে না, আমাদের সম্মিলিত শিরায় শিরায় এক তীব্র বিদ্রোহের আগুনও জ্বালিয়ে দেবে।

আমরা যখন বিচার চাই, তখন মনে করি রাষ্ট্রের আইন আমাদের শেষ আশ্রয় দেবে। কিন্তু যখন দেখি সেই আশ্রয়ই কাঁটা বিছানো পথে পরিণত হয়, তখন সম্মিলিত মনটা ভেঙে যায়। ভুক্তভোগী যখন তার প্রথম মামলাটি দায়ের করেন, তখন আমাদের চোখে থাকে এক ঝলক নতুন দিনের আলো, ঠিক যেন ভোরের প্রথম কিরণ। আমরা ভাবি, অন্যায়কারী শাস্তি পাবে, ন্যায় প্রতিষ্ঠিত হবে। কিন্তু ক্ষমতাবান বা প্রভাবশালী পক্ষ যখন দেখে তাদের স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হচ্ছে, তখনই তারা শুরু করে আইনি হয়রানির এক জঘন্য খেলা। ঠিক যেন একজন অসহায় পথিককে পথে বসিয়ে দিয়ে তার মাথার ছাতাটিও কেড়ে নেওয়া। তারা প্রথম মামলাটিকে দুর্বল করতে, কিংবা বাদীকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করতে, উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে উল্টো একাধিক মিথ্যা বা হয়রানিমূলক মামলা দায়ের করে। এই প্রক্রিয়াটি কেবল আর্থিক ক্ষতি করে না—গবেষণায় দেখা গেছে, এমন হয়রানির শিকার ৮৫% মানুষ তীব্র মানসিক চাপ (PTSD) এবং উদ্বেগে ভোগেন—বরং একজন মানুষের সামাজিক মর্যাদা এবং বেঁচে থাকার ইচ্ছাকেও তিলে তিলে শেষ করে দেয়।

বাস্তবিক চিত্রে যে বিষয়টি বারবার প্রতিধ্বনিত হয়, তা হলো—আইনের দীর্ঘসূত্রিতা আর প্রভাবশালীদের অন্যায় হস্তক্ষেপ। আমাদের দেশে, বিশেষ করে ২০১৫ সাল থেকে আইনি প্রক্রিয়ায় জনআস্থা বাড়ানোর নানা উদ্যোগ নেওয়া হলেও, মাঠ পর্যায়ে চিত্রটা অনেক ক্ষেত্রে ভিন্ন। যেখানে ২০১৬ সালে সারা দেশে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ছিল প্রায় ৩৩ লক্ষ, সেখানে ২০২৪ সালের মাঝামাঝি এই সংখ্যা ৪৬ লক্ষের মাইলফলক ছাড়িয়েছে। এই বিপুল সংখ্যক মামলার ভিড়ে একজন গরিব মানুষ দিনের পর দিন কোর্টের বারান্দায় বিচারকের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকেন—প্রতিদিন গড়ে প্রায় ২,৫০০ নতুন মামলা দায়ের হয়—কিন্তু প্রভাবশালীরা অর্থের জোরে বা ক্ষমতার দাপটে তদন্তের মোড় ঘুরিয়ে দেয়।

একটি সাম্প্রতিক বাস্তবিক উদাহরণ হিসেবে, ২০২১ সালের একটি বহুল আলোচিত ঘটনাকে উল্লেখ করা যায়, যেখানে একজন দরিদ্র ভূমিহীন কৃষক তার জমি দখলের বিরুদ্ধে মামলা করলে, প্রভাবশালী দখলদাররা উল্টো কৃষকের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে এবং চাঁদাবাজির মতো প্রায় ৫টি পাল্টা মামলা দায়ের করে। এই কৃষককে তার মূল মামলা লড়ার পাশাপাশি এই হয়রানিমূলক মামলাগুলোর জন্য বিপুল পরিমাণ অর্থ (যা তার বার্ষিক আয়ের প্রায় ৩০০%) এবং সময় ব্যয় করতে হয়েছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)-এর মতো সংস্থাগুলোর তথ্যানুসারে, ২০২২ সালে দায়ের হওয়া ফৌজদারি মামলাগুলোর মধ্যে প্রায় ১৪% ক্ষেত্রেই প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে পাল্টা অভিযোগ আনার প্রবণতা দেখা গেছে। এই সংখ্যা ২০২৩ সালে প্রায় ১৫.৫% এবং ২০২৪ সালে ১৮% এ উন্নীত হয়। অর্থাৎ, প্রতি ৫ জন বিচারপ্রার্থীর মধ্যে প্রায় ১ জনই কোনো না কোনোভাবে পাল্টা হয়রানির শিকার হচ্ছেন।

বিপ্লবী কথা হলো—এই হয়রানি শুধু মামলাতেই শেষ নয়। বিচারিক প্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, ৭০% ভুক্তভোগী সাক্ষী প্রভাবশালীদের হুমকির মুখে তাদের প্রাথমিক বক্তব্য থেকে সরে আসতে বাধ্য হন, যা ন্যায়বিচারের পথকে রুদ্ধ করে। আবার, পুলিশের তদন্তে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগও নতুন নয়; বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার মতে, ৬২% ক্ষেত্রেই প্রাথমিক তদন্তে দুর্বলতা বা প্রভাবশালী পক্ষের প্রতি দুর্বলতা দেখা যায়। এই চিত্র আমাদের মনে গভীর দাগ কাটে—সুবিচার পাওয়ার জন্য কত কঠোর মূল্য দিতে হয়! এটা শুধু একটি ব্যক্তির গল্প নয়, শত শত নীরবে কেঁদে যাওয়া আত্মার প্রতিচ্ছবি।

এই ধরনের 'অবিচারের মামলা' দায়েরের প্রবণতা একটি পরিসংখ্যানগত উদ্বেগ তৈরি করে। বিচারপতিদের মতে, বিচারাধীন মামলার জট কমাতে আরও অন্তত ১,২০০ নতুন বিচারক নিয়োগ দেওয়া প্রয়োজন। কিন্তু সেই নিয়োগ প্রক্রিয়াও চলছে ধীর গতিতে।

বিভিন্ন সংস্থার তথ্যানুসারে, ২০১৫ সাল থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে আইনি হয়রানির শিকার হয়েছেন এমন সাধারণ মানুষের সংখ্যা বছরে গড়ে প্রায় ১২% থেকে ১৮% বৃদ্ধি পেয়েছে। এর অর্থ হলো, কেবল এই ১০ বছরেই হয়রানির মাত্রা বেড়েছে ৫০% এরও বেশি। দ্রুত বিচার নিশ্চিত করার জন্য যদিও ট্রাইব্যুনাল বা বিশেষ আদালত রয়েছে, কিন্তু সেখানেও বিচারাধীন মামলার স্তূপ জমছে। যেমন, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালগুলিতেও ২০২৩ সাল পর্যন্ত প্রায় ১ লাখ ৮০ হাজার মামলা বিচারাধীন ছিল, যার মধ্যে প্রায় ৪৫,০০০ মামলায় আসামি পক্ষ থেকে পাল্টা মামলা করার অভিযোগ রয়েছে।

২০১৫ থেকে ২০২৫ পর্যন্ত হয়রানিমূলক মামলার তুলনামূলক চিত্র:

যদি এই প্রবণতা রোধ করা না যায়, তবে এর ভবিষ্যৎ চিত্রটি সত্যিই ভয়াবহ। আমরা মনে করি, ২০২৫ সালের শেষ পর্যন্ত হয়রানিমূলক মামলার শিকার হওয়ার হার প্রায় ১৯% এ দাঁড়াবে। এই পরিসংখ্যানটি কেবল একটি সংখ্যা নয়, এটি আমাদের সমষ্টিগত পরাজয়ের দলিল। আমরা কী ভুলে যাবো সেই কৃষকের কথা, যিনি মামলা লড়তে গিয়ে ভিটেমাটি বিক্রি করেছেন? নাকি সেই নারীর অশ্রু, যিনি যৌতুকের মামলায় সুবিচার চাওয়ার পর উল্টো মানহানির মামলায় জড়িয়েছেন?

এই লেখাটি যখন শেষ করছি, তখন আমাদের মন ভারী হয়ে আসছে। আমরা জানি, বিচার না পাওয়ার এই দীর্ঘসূত্রিতার কারণে দেশের প্রায় ৮০% পরিবার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রভাবিত হচ্ছে। মনে হচ্ছে, কেবল অক্ষর দিয়ে এই মানুষের ভেতরের কষ্ট বর্ণনা করা যায় না। তাদের চোখের জল, পরিবারের অনিশ্চয়তা আর সমাজের কাছে উপেক্ষিত হওয়ার যন্ত্রণা—সবকিছুই মিশে আছে এই 'অনুসন্ধান'-এর প্রতিটা ফ্রেমে। আমরা বিশ্বাস করি: আইনি মারপ্যাঁচে যেন ন্যায় ও মানবিকতা কখনও হারিয়ে না যায়। বিচার ব্যবস্থার প্রত্যেকটি অংশ যেন মনে রাখে, তাদের কাজ শুধু আইন প্রয়োগ করা নয়, বরং অসহায় মানুষের শেষ আশ্রয়টুকু নিশ্চিত করা। ৭৫% মানুষ বিশ্বাস করে, বিচার ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা নিশ্চিত হলে হয়রানির হার ৪০% কমবে। এই বিশ্বাসকে বাস্তবে রূপ দিতেই হবে। এই অপ্রাপ্তির যন্ত্রণা আর হতাশা নিয়ে আমরা আর বসে থাকব না। আমাদের সম্মিলিত কণ্ঠস্বর একদিন বিচারালয়ের প্রতিটি প্রকোষ্ঠে প্রতিধ্বনিত হবেই।

সংক্ষিপ্ত জীবনী :

ডঃ তারনিমা ওয়ারদা আন্দালিব, বর্তমানে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে সহকারী অধ্যাপক এবং যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড ইমপ্যাক্ট গ্রুপে গ্লোবাল কনসালট্যান্ট ডিরেক্টর হিসেবে কর্মরত আছেন। 

দাউদ ইব্রাহিম হাসান, বর্তমানে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় অর্থনীতি বিভাগে একজন নিয়মিত মাস্টার্স স্টুডেন্ট হওয়ার পাশাপাশি প্রজেক্ট এনালিস্ট হিসেবে ইউএনডিপি বাংলাদেশে নিয়োজিত থাকার পাশাপাশি আইডিএলসি ফাইনান্স পিএলসি-তে মার্কেটিং বিভাগে কর্মরত আছেন।


Sangbad Sarabela

সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী আবু জাফর

যোগাযোগ: । [email protected] । বিজ্ঞাপন ও বার্তা সম্পাদক: 01894944220

ঠিকানা: বার্তা ও বাণিজ্যিক যোগাযোগ : বাড়ি নম্বর-২৩৪, খাইরুন্নেসা ম্যানশন, কাঁটাবন, নিউ এলিফ্যান্ট রোড, ঢাকা-১২০৫।

আমাদের সঙ্গে থাকুন

© 2025 Sangbad Sarabela All Rights Reserved.