× প্রচ্ছদ বাংলাদেশ বিশ্ব রাজনীতি খেলা বিনোদন বাণিজ্য লাইফ স্টাইল ভিডিও সকল বিভাগ
ছবি ভিডিও লাইভ লেখক আর্কাইভ

পূর্ণিমা রাতে লঞ্চভ্রমণ: নদী, জোছনা ও নিঃসঙ্গতার ত্রিভুজপ্রেম

আবুল হাসনাত

১১ নভেম্বর ২০২৫, ২০:০০ পিএম । আপডেটঃ ১১ নভেম্বর ২০২৫, ২০:০২ পিএম

ঘুরতে যাওয়ার কোনও পরিকল্পনাই ছিল না। অফিস শেষে সন্ধ্যায় বাসার ব্যালকনিতে বসে কফির কাপে চুমুক দিতেই দেখলাম বিশাল এক চাঁদ দুর্দান্ত প্রতাপে রাজত্ব করছে বিশাল আকাশজুড়ে। ঢাকা শহরে বসবাসরত মানুষের চোখ প্রয়োজন ছাড়া খুব একটা আকাশের দিকে যায় না। এই শহরের মানুষ ভুলে গেছে— আকাশের ঠিকানায়ও মাঝে মাঝে চিঠি লেখা যায়। অমাবস্যা-পূর্ণিমার হিসাব এখানে যেন জটিল কোনো ক্যালকুলাস।

মাঝে মাঝে মনে হয়, এমন মায়াবী পূর্ণিমা রাতে নগরের গায়ে জামা-কাপড়ের মতো লেপ্টে থাকা নাগরিক সভ্যতার সব বাতি কয়েক ঘন্টার জন্য নিভিয়ে দিলে কী এমন হয়? অবিশুদ্ধ নগরীর সকল মানুষ চন্দ্রকিরণ সেতু দিয়ে বিশুদ্ধ সৌন্দর্যবোধের কাছে নিজেদের সঁপে দিবে। কিছুক্ষণের জন্য স্বপ্নবিলাসী তনয়া ভিতরে জমে থাকা সব নান্দনিকতা নিয়ে জানালার ফাঁক দিয়ে আত্নীয়তা করবে রূপার থালার মতো ফুটফুটে ঐ রূপালী আলোর সাথে। কাকপক্ষীর মতো অন্যের করুণার উপর বেঁচে থাকা সাহেবটাও হয়তো খুঁজে পাবে হারিয়ে ফেলা আত্নপরিচয়। 

কোটি কোটি মানুষের ভার বহন করতে থাকা একটা নগরীরও তো বিশ্রামের অধিকার আছে। কিন্তু ঢাকা শহরকে এমন বিশ্রামের সুযোগ কে দিবে? এ শহর শুধু যান্ত্রিকতার ভার বয়ে যাবে অনন্তকাল ধরে, অর্থনীতির সমীকরণ মিলিয়ে যাবে যুগের পর যুগ ধরে। এ শহরেও চাঁদ আভা দেয়; কিন্তু বিশাল দালান ও নিঃসঙ্গ আলোকসজ্জায় হারিয়ে যায় তার কোমল রূপ। 

তাই ভাবলাম এমন মায়াবী চাঁদের রূপ ইট-কাঠের এই নগরী থেকে দেখা রীতিমতো অন্যায়। সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম হঠাৎ করেই। চাঁদের এমন সৌন্দর্যে অবগাহন করার জন্য চলে যাবো মাঝ-নদীতে। হুট করে করা এই পরিকল্পনায় সামিল হয়ে গেল আরও ৫ জন। জাবের, সাকিব, গিয়াস, সাজাহান ও মাসরুর। সবাই আমার শেশব-কৈশোরের সারথী। শৈশব-কৈশোরের সাথীরা কাছে থাকলে মনে কোনো জড়তা কাজ করে না, থাকে না কোনা সংকোচ। যা খুশি বলা যায় অবলীলায়। আচরণবিধি মেনে পরিমাপ করে কথা বলতে হয় না। বিধি লংঘনেরও কোনো ভয় থাকে না। এখানে সবকিছুই সদাচরণ। ছয় জন মিলে লঞ্চে করে রওনা হলাম ঢাকার সদরঘাট থেকে বরিশালের দিকে। যাত্রাপথে লঞ্চের রিভার-ভিউ কেবিন এনে দিয়েছে বাড়তি আনন্দ। জানালা খোলা রেখে শুয়েই উপভোগ করা যায় চাঁদনিরাতের স্বপ্নীল মুহুর্ত।

ছোটো ছোটো সৌন্দর্য মানুষকে আন্দোলিত করে আর বড় বড় সৌন্দর্য মানুষের হৃদয়ে তৈরি করে এক ধরনের হাহাকার। কী কারণে এমন হাহাকার তৈরি হয় তা আমরা জানি না। হয়তো ভাষায় প্রকাশ করতে না পারা কিংবা সৌন্দর্যের উৎস না জানার জন্য এমন হাহাকারের জন্ম। সেদিনের ভরা পূর্ণিমা রাতে ঢাকা-বরিশাল রুটের লঞ্চজানিও এনে দিয়েছিলো এমন এক বিশাল নিঃসঙ্গ হাহাকার- লাবণ্যের বেদনামিশ্রিত আনন্দ। 

কিছু মুহুর্তের জন্য জীবনের এক অন্যরকম রস আস্বাদনের জন্য, জীবনকে খুব কাছ থেকে অনুভব করার জন্য, বয়স বৃদ্ধির সময়টাকে উপভোগ করার জন্য, যান্ত্রিকতা থেকে কিছুক্ষণের জন্য ছুটি নিয়ে নিভৃতে সময় কাটানোর জন্য, ভবিষ্যতের একাকিত্বে সঙ্গ দেয়ার মতো কিছু মনোরম স্মৃতি জমানোর জন্য কিংবা নিজের ভিতর প্রায় মরে যাওয়া মানবসত্তাকে জাগিয়ে তুলে আনন্দ-বেদনার গল্প করার জন্যও সবার জীবনে অন্তত একবার ঢাকা-বরিশাল লঞ্চভ্রমণ করা উচিত৷ আসলেই উচিত৷ সেটা অবশ্যই হতে হবে জোছনা রাতে৷ ভরা পূর্ণিমা হলে তো কথাই নাই৷ 

রাতের স্নিগ্ধতা ছড়ানো মায়াবী চাঁদটাকে সাথে নিয়ে যখন বুড়িগঙ্গা থেকে বরিশালের দিকে যাত্রা শুরু করে, তখন মনে হচ্ছিলো কোনো এক অচীন স্বর্গপুরীতে আছি। যতোই রাত গভীর হতে শুরু করলো, ততোই নিজেকে চিনতে শুরু করলাম৷ মাঝনদীতে বাতাসের শিরশির মৃদু ছন্দ মনকে আন্দোলিত করছিলো খুব৷ নদীর এই মৃদু ঠাণ্ডা বাতাস আমার ভীষণ প্রিয়। 

ধীরে ধীরে ভেসে চলছে লঞ্চ৷ চোখের দিগন্ত থেকে আস্তে আস্তে হারিয়ে যাচ্ছিলো সদরঘাটের নগরসভ্যতার রূপ। ধীরলয়ে চলতে চলতে বুড়িগঙ্গার দূষিত জল ভেদ করে একটা সময় প্রবেশ করে মেঘনার বুকে৷ এতাক্ষণ বুড়িগঙ্গার দূষিত জলের দুর্গন্ধের স্বাদ নিতে থাকা নাক হঠাৎ পেয়ে যায় এক আরামদায়ক অনুভূতি। জনস্রোতের কোলাহল থেমে গেলো একসময়, সরব হয়ে উঠলো প্রকৃতির কন্ঠস্বর। বাতাসে মিশে যাচ্ছিলো ডিজেলের হালকা গন্ধ আর দূরের বাঁশির সুর। প্রতিটি ঢেউ চাঁদের আলোয় ঝলমল করে উঠছিলো, তখন মনে হচ্ছিল কেউ একজন জলের শরীরে জ্বেলে দিয়েছে ছোট ছোট আগুনের ফুলকি। জলের বুক চিরে ঢেউয়ের ছন্দ তুলে এগিয়ে যাচ্ছিলো বিশাল নৌ-যান৷ হঠাৎ অন্ধকার ভেদ করে উঁকি দিলো চাঁদ। মুহূর্তেই বদলে গেল নদীর চেহারা। পুরো নদী যেন ঝলমল করে উঠলো নিমিষেই। থেমে গেল সকল আড্ডা, কোলাহল। মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়ে রইলাম। চাঁদ থেকে চুইয়ে চুইয়ে জোছনা ঝরে পড়ছে নদীতে। সেই জোছনা যেন নদীর ঢেউয়ের সঙ্গে ভেসে চলেছে দূরের কোন দিগন্তে। মনে হলো যেন ঝকমকে এক জোছনার নদীর মাঝে দাঁড়িয়ে আছি। এই সৌন্দর্য বর্ণনার নয়, কেবলই উপভোগের।

জোছনার আলোয় ছিটকে পড়া জলকণাগুলো যেন এক একটা মুক্তোদানা৷ নদীর দুই পাশের ঘরবাড়িকে মনে হচ্ছিলো নিস্তব্ধ কোনো জনপদ৷ নদী, লঞ্চ ও জোছনার ত্রিভুজপ্রেম দেখতে দেখতেই গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছিলো কার্তিকের হালকা শীতের রাত। লঞ্চের তলায় ঢেউয়ের মৃদু থপথপ শব্দ, ওপরের নরম স্বর্গীয় কিরণ— মনে হচ্ছিলো, এই পৃথিবীটাও যেন এক বিশাল দোলনা; যেখানে মানুষ, নদী আর লঞ্চ একসাথে দুলে ওঠছে। সেই দোলায় হারিয়ে যাচ্ছে ক্লান্তি, অভিমান, একাকিত্ব- বেঁচে থাকার অর্থ আবারও ফিরে আসে নীরবে। এমন মুহুর্তের সান্নিধ্য পেয়ে জীবনের অর্থ না জানা রস-কষহীন মানুষটাও হঠাৎ জীবনের প্রতি একটা প্রবল টান অনুভব করবে৷ বেঁচে থাকার স্বাদ বেড়ে যাবে নিমিষেই৷ লঞ্চ চলার তালে তালে নদীর মৃদু সমীরণের ছন্দে মনের উঠানে একটু পর পর ভেসে উঠবে পুরনো প্রেম; স্মৃতির ধূসর প্রাঙ্গনে জেগে উঠবে আপন মানুষদের সাথে কাটানো প্রিয়সব মুহুর্ত;  বুকের বাম পাশে অভিমানী বালকের মতো ঘুমিয়ে থাকা নীরব দুঃখগুলোও উঠে বসবে। রাতের গভীরতা বাড়ার সাথে সাথে মনে পড়বে পরপারে পাড়ি দেয়া প্রিয় মানুষগুলোর কথা৷ চোখের কোণে দুই-এক ফোটা অশ্রুও চিকচিক করবে প্রিয়জনদের বিয়োগ-বেদনায়৷ 

লঞ্চের ছাদে বা করিডোরে বসে কিংবা ডেকের শক্ত ফ্লোরে শুয়ে যখন নদীর পানিতে পূর্ণিমার প্রতিফলন হওয়া দেখবেন, তখন মনে হবে- জীবন এতো ছোটো কেনো! যারা নিয়মিত এই পথে ভ্রমণ করেন, তাদের কাছে এমন সৌন্দর্য সহজে ধরা পড়বে না৷ কারণ তাদের চোখ প্রতিনিয়ত এমন সৌন্দর্যের মুখোমুখি হয়ে অভ্যস্ত হয়ে গেছে৷ প্রতিটি দৃশ্য তাদের কাছে মুখস্থ৷ একই রকম দৃশ্য অনেক দিন ধরে দেখলে সৌন্দর্য ধীরে ধীরে ম্লান হয়ে যায়৷ এমন সৌন্দর্য দেখার জন্য আয়োজন করে বের হতে হবে। কোনো পিছুটান থাকা যাবে না। রাখা যাবে না কোনো ব্যস্ততা। 

চন্দ্রকিরণ ধীরে ধীরে হালকা হতে থাকে, নদীর বুক থেকে হারিয়ে যেতে থাকে তার ঝলমলে প্রতিফলন। লঞ্চ এগিয়ে চলে গন্তব্যের দিকে, কিন্তু মন যেন রয়ে যায় সেই জোছনার মধ্যে, সময়ের ওপারে, শব্দহীন এক সৌন্দর্যের রাজ্যে। হয়তো এই কারণেই মানুষ মাঝে মাঝে শহর ছেড়ে ছুটে যেতে চায় নদীর ধারে, পাহাড়ের কোলে বা মেঘের রাজ্যে- শুধু নিজেকে নতুন করে খুঁজে পাওয়ার জন্য। জীবন যতই যান্ত্রিক হোক না কেন, কোথাও না কোথাও আমাদের সবার ভেতরেই বেঁচে আছে এক টুকরো নরম আলো কিংবা এক টুকরো জোছনা, যা কখনো নিভে যায় না। তখন আসলে অনুভব করা যায়- জোছনা আসলে নদীতে নয়, আমাদের মনের ভেতরেই ঘাপটি মেরে বসে থাকে। সুযোগ ও পরিবেশ বুঝে নিজের অস্তিত্বের জানান দেয়। 

সূর্য তখনও পুরোপুরি ওঠেনি, তবে ওঠার আয়োজন শুরু করেছে মাত্র। পূর্ব আকাশ লালচে আলোয় রঙ নিতে শুরু করেছে সবে। নদীর বুক থেকে ভেসে আসছে মৃদু ঠাণ্ডা বাতাস, তাতে মিশে আছে ভোরের স্নিগ্ধতা আর রাতের শেষ জোছনার কোমল স্পর্শ। চুপচাপ বসে ভাবছিলাম- এমন নির্মল ভোর শেষ কবে দেখেছি? চমৎকার পূর্ণিমা রাতের স্মৃতি, নদীর ঢেউয়ের সুর, বন্ধুদের হাসি, ভোরের কোমল রূপ আর মনভরা ভালো লাগার শিরশির অনুভূতি সঙ্গে নিয়ে বাসায় আসার পর অবচেতন মন বারবার মিনমিনে হাসছে, অকারণে। দর্শনের দূর দিগন্তে এখনো ভাসছে নদীর জোছনা আর মনে জেগে আছে ভোরের নতুন সূর্যের মতো এক অনন্ত প্রশান্তি। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় মতো আক্ষেপ করে বলতে মন চাচ্ছে- 

“এই খেদ আমার মনে- ভালোবেসে মিটল না এ সাধ, কুলাল না এ জীবনে!

হায়- জীবন এত ছোট কেনে? এ ভুবনে”।

*লেখক পরিচিতি: জনসংযোগ কর্মকর্তা, বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ, খাদ্য মন্ত্রণালয়।*

Sangbad Sarabela

সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী আবু জাফর

যোগাযোগ: । [email protected] । বিজ্ঞাপন ও বার্তা সম্পাদক: 01894944220

ঠিকানা: বার্তা ও বাণিজ্যিক যোগাযোগ : বাড়ি নম্বর-২৩৪, খাইরুন্নেসা ম্যানশন, কাঁটাবন, নিউ এলিফ্যান্ট রোড, ঢাকা-১২০৫।

আমাদের সঙ্গে থাকুন

© 2025 Sangbad Sarabela All Rights Reserved.