× প্রচ্ছদ বাংলাদেশ বিশ্ব রাজনীতি খেলা বিনোদন বাণিজ্য লাইফ স্টাইল ভিডিও সকল বিভাগ
ছবি ভিডিও লাইভ লেখক আর্কাইভ

শ্রমিকের মন কি শুধুই কষ্টের কারখানা?

১৮ নভেম্বর ২০২৫, ২২:৩০ পিএম । আপডেটঃ ১৮ নভেম্বর ২০২৫, ২২:৩২ পিএম

মনুষ্যত্বের গল্পগুলো বরাবরই এমন এক নীরব অশ্রুধারার মতো, যা শুধু হৃদয় দিয়েই অনুভব করা যায়, চোখে দেখা যায় না। আমাদের বাংলাদেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড—যাদের অক্লান্ত শ্রমে গড়ে উঠেছে আজকের এই স্বপ্নিল অট্টালিকা, সেই উৎপাদন শিল্পের কর্মীদের জীবনযাত্রা আজ এক অদৃশ্য মানসিক প্রাচীরের আড়ালে ঢাকা। বাইরে থেকে আমরা দেখি চকচকে কারখানা, দ্রুত এগিয়ে চলা অর্থনীতি, কিন্তু ভেতরের মানুষটির মনোকষ্টের হিসাব কখনো কি রাখা হয়েছে?

২০১৫ সাল থেকে ২০২৫ সালের দিকে তাকালে একটা জিনিস স্পষ্ট হয়ে ওঠে: আমরা কেবল শ্রমের মূল্য নিয়ে কথা বলেছি, শ্রান্ত মনের মূল্যায়নে ব্যর্থ হয়েছি। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের ২০১৮-১৯ সালের জরিপ অনুযায়ী, দেশের প্রায় ১৮.১% প্রাপ্তবয়স্ক (যা প্রায় ২ কোটি ৯৬ লাখ মানুষ) মানসিক সমস্যায় ভুগছেন। এর মধ্যে নারী শ্রমিকদের হার পুরুষদের (১৫%) চেয়েও বেশি—প্রায় ১৯%। ভাবুন একবার, যিনি কারখানায় বসে দিনরাত সেলাই মেশিনের শব্দে জীবন কাটান, তার মনের মধ্যে যখন হতাশা আর উদ্বেগের ঢেউ ওঠে, তখন তার কাজের গুণগত মান বা জীবনের নিরাপত্তা কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়? ঠিক তেমনি একজন গার্মেন্টস কর্মী, যার মনে ৬.৫% গুরুতর মানসিক অসুস্থতার ছায়া রয়েছে সেই জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের তথ্যমতে, তার হাতে তৈরি পোশাকে নিখুঁত কারিগরি আশা করা বৃথা। এ হলো সেই ৯২.৩% মানুষের গল্প, যারা সেই একই জরিপ অনুসারে কোনো চিকিৎসা পেতেই পারে না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, হতাশা ও উদ্বেগের কারণে বিশ্বব্যাপী প্রতি বছর প্রায় ১,২০০ কোটি কর্মদিবস নষ্ট হয়, যার একটি বিশাল অংশ আমাদের অর্থনীতির ওপর চেপে বসেছে।

কর্মীদের এই মানসিক বিপর্যয়ের পেছনের কারণগুলো খুবই নিষ্ঠুর এবং বাস্তব। একটি কারণ হলো অতিরিক্ত কাজের চাপ ও অনিয়ন্ত্রিত কর্মঘণ্টা। শ্রম আইন অনুযায়ী সপ্তাহে ৪৮ ঘণ্টা কাজের সীমা থাকলেও, শ্রম গবেষণা ও বেসরকারি পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, উৎপাদন শিল্পে প্রায় ৬০% শ্রমিক সপ্তাহে ৬০ ঘণ্টারও বেশি কাজ করেন। এই অতিরিক্ত শ্রমের বোঝা তাদের ব্যক্তিগত জীবন ও পরিবারের কাছ থেকে তাদের দূরে ঠেলে দেয়। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (ILO) এর তথ্যমতে, কর্মীর ঘুমের অভাব বা ক্লান্তি দুর্ঘটনার ঝুঁকি প্রায় ২৫% বাড়িয়ে দেয়। এই অতিরিক্ত চাপেই সৃষ্টি হয় কাজের-জীবনের ভয়াবহ ভারসাম্যহীনতা (Work-Life Imbalance)। কর্পোরেট জরিপ বলছে, আইটি বা কর্পোরেট সেক্টরের প্রায় ৭০% পেশাজীবী এই দ্বন্দ্বে ভোগেন।

এছাড়াও রয়েছে আর্থ-সামাজিক চাপ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (BBS) এবং সিপিডি (CPD) এর রিপোর্ট অনুসারে, ঢাকা শহরে গত ১০ বছরে জীবনযাত্রার ব্যয় প্রায় ১৫০% বৃদ্ধি পাওয়ায়, কম মজুরির কারণে শ্রমিক অধিকার সংস্থাগুলোর তথ্যমতে ৯০% নিম্ন আয়ের কর্মী পারিবারিক চাহিদা মেটাতে হিমশিম খাচ্ছেন। বেসরকারি গবেষণা সংস্থার তথ্যানুসারে, প্রায় ৬০% এরও বেশি নারী শ্রমিক কর্মক্ষেত্রে হয়রানি বা বৈষম্যের শিকার হন, যা তাদের মনে এক গভীর ক্ষত তৈরি করে। এই ক্ষত ধীরে ধীরে তাদের উৎপাদনশীলতা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) এর অনুমান অনুযায়ী ২০% থেকে ৪০% পর্যন্ত কমিয়ে দেয়। তাদের হাতে তৈরি পণ্যটি যখন বিশ্ববাজারে যায়, তখন সেই পণ্যের সঙ্গে মিশে থাকে তাদের নীরব কান্না।

পরিবহন খাতের দিকে তাকালে আমরা দেখি ভিন্ন চিত্র: ট্রান্সপোর্ট ফেডারেশন-এর তথ্যমতে, প্রায় ৮৫% চালক মাদকাসক্তি বা অতিরিক্ত চাপের কারণে শারীরিক ও মানসিক ঝুঁকিতে থাকেন। নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের তথ্যমতে, এই মানসিক চাপই ১০% থেকে ১৫% সড়ক দুর্ঘটনার জন্য দায়ী। আবার কৃষি খাতে, কৃষি গবেষণা সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, ফসলের ন্যায্য দাম না পাওয়া এবং জলবায়ু পরিবর্তনের উদ্বেগ প্রায় ৪০% কৃষককে গভীর মানসিক উদ্বেগ ও হতাশায় নিমজ্জিত করে।

মানসিক অস্থিরতার এই চিত্র বিশেষ করে ১০টি সেক্টরে সবচেয়ে প্রকট: আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (ILO) এর অনুমান বলছে, তৈরি পোশাক শিল্পে বার্ষিক প্রায় ২৫০-৩০০ কোটি কর্মদিবসের ক্ষতি হয়; স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জরিপ অনুসারে, স্বাস্থ্যসেবা খাতে নার্স ও চিকিৎসকদের ৬০% কাজ-সংক্রান্ত মানসিক চাপ (Burnout) অনুভব করেন; ব্যাংকিং সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, উচ্চ লক্ষ্যমাত্রা ও তীব্র প্রতিযোগিতার চাপে ব্যাংকিং খাতে ২০% কর্মকর্তার পদোন্নতি বা ইনক্রিমেন্ট আটকে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে; আর আইটি গবেষণা সংস্থার তথ্যমতে, তথ্যপ্রযুক্তি (IT) পেশাজীবীদের গড় দৈনিক কাজের সময় ১০-১২ ঘণ্টা, এবং ৫৫% স্ক্রিন-টাইমজনিত সমস্যায় ভোগেন। এছাড়াও বেসরকারি হিসাবমতে, কল সেন্টার কর্মীদের ৬৫% নিয়মিত গ্রাহকদের কাছ থেকে মানসিক হয়রানির শিকার হন।

আমাদের এই কর্মীদের বাঁচাতে হলে শুধু সহানুভূতি দেখালে চলবে না, প্রয়োজন কাঠামোগত পরিবর্তন। বিশ্ব মানদণ্ড অনুযায়ী, নিয়োগকর্তাদের উচিত কর্মীদের মানসিক সুস্থতার জন্য Employee Assistance Program (EAP) চালু করা, যার মাধ্যমে ৫০% কোম্পানিতে গোপনে কাউন্সেলিং সুবিধা দেওয়া সম্ভব হবে। সব ম্যানেজারের জন্য ১০০% বাধ্যতামূলক মানসিক স্বাস্থ্য প্রশিক্ষণ প্রয়োজন, যাতে তারা কর্মীদের অবস্থা বুঝতে পারেন।

অন্যদিকে, সরকারের দায়িত্ব আরও বেশি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) এর সুপারিশ অনুযায়ী, স্বাস্থ্য বাজেটে মানসিক স্বাস্থ্যের বরাদ্দ ০.৫% থেকে ৪% এ উন্নীত করার একটি দৃঢ় লক্ষ্য নিয়ে এগোতে হবে। জাতীয় স্বাস্থ্য কৌশল অনুসারে, মনোরোগ বিশেষজ্ঞের সংখ্যা বাড়িয়ে প্রতি ১ লাখ মানুষের জন্য কমপক্ষে ২ জন নিশ্চিত করতে হবে এবং ৮০% প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে কাউন্সেলিং সুবিধা দিতে হবে। কর্মীর ব্যক্তিগত দায়বদ্ধতাও জরুরি: নিয়মিত ব্যায়াম এবং পর্যাপ্ত ৭-৮ ঘণ্টা ঘুম নিশ্চিত করা।

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, ILO, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, এবং বাংলাদেশ অর্থনীতি সমীক্ষা ভিত্তিক অনুমিত তথ্য অনুসারে এই সময়রেখা তৈরি করা হয়েছে:

বছর: মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় ভোগা প্রাপ্তবয়স্কের হার (শতাংশ): উৎপাদন শিল্পে অনুপস্থিতির হার (শতাংশ): মানসিক স্বাস্থ্য বাজেটের শতাংশ (জাতীয়): 

২০১৫: ১৮.০%: ৪.০%: ০.২%

২০১৮: ১৮.৫% : ৪.৫%: ০.৪%

২০২০ : ১৯.২%: ৬.০% : ০.৬%

২০২২ : ১৮.৮%: ৫.৫% :০.৬%

২০২৫ (অনুমান) : ২০.০% : ৬.৫% :০.৮%

২০৩০ (লক্ষ্যমাত্রা) : ১৬.০% : ৩.৫% : ২.৫%

২০৩৫ (লক্ষ্যমাত্রা) : ১৩.৫% : ২.৫% : ৩.৫%

২০৪০ (লক্ষ্যমাত্রা) : ১২.০% : ১.৫% :৪.০%

অর্থনৈতিক মডেলিং এর পূর্বাভাস অনুযায়ী, ২০২৫ সাল নাগাদ, যদি কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া না হয়, তবে কর্মক্ষেত্রে অনুপস্থিতির হার ৬.৫% এ পৌঁছাতে পারে। কিন্তু যদি আমরা এখনই উদ্যোগ নিই, তবে ২০৪০ সালের মধ্যে এই হার ১.৫% এ নেমে আসতে পারে, যা আমাদের অর্থনীতিতে $৫ বিলিয়ন পর্যন্ত অতিরিক্ত মূল্য সংযোজন করতে সক্ষম হবে। কর্মীরা যখন হাসবে, তখনই দেশের অর্থনীতির চাকা ঘুরবে দ্রুত গতিতে।

শোনো, ওগো রাষ্ট্রের কর্ণধার! যারা কারখানার কোণে নীরবে কাঁদে, যাদের শ্রমের মূল্য দিয়েছো, কিন্তু মনের মূল্য দিতে শেখোনি—সেই কর্মীদের হৃদয়ের হাহাকার আজ বিদ্রোহের ভাষা খুঁজুক। আর নয় নীরবতা, তাদের মানসিক সুস্থতা তোমার অর্থনৈতিক মানচিত্রের শেষ কথা হোক! হৃদয় দিয়ে শোনো, শ্রমিকের হাসিই আমাদের অর্থনীতির আসল ভিত্তি!

সংক্ষিপ্ত জীবনী :

ডঃ তারনিমা ওয়ারদা আন্দালিব, বর্তমানে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে সহকারী অধ্যাপক এবং যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড ইমপ্যাক্ট গ্রুপে গ্লোবাল কনসালট্যান্ট ডিরেক্টর হিসেবে কর্মরত আছেন।

দাউদ ইব্রাহিম হাসান, বর্তমানে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার্স-এর অর্থনীতি বিভাগে অধ্যয়নরত থাকার পাশাপাশি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় একজন রিসার্চ এসিস্ট্যান্ট এবং সেই সাথে আইডিএলসি ফাইন্যান্স পিএলসি-এর মার্কেটিং বিভাগের একজন সদস্য হিসেবে নিয়োজিত আছেন।

Sangbad Sarabela

সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী আবু জাফর

যোগাযোগ: । [email protected] । বিজ্ঞাপন ও বার্তা সম্পাদক: 01894944220

ঠিকানা: বার্তা ও বাণিজ্যিক যোগাযোগ : বাড়ি নম্বর-২৩৪, খাইরুন্নেসা ম্যানশন, কাঁটাবন, নিউ এলিফ্যান্ট রোড, ঢাকা-১২০৫।

আমাদের সঙ্গে থাকুন

© 2025 Sangbad Sarabela All Rights Reserved.