× প্রচ্ছদ বাংলাদেশ বিশ্ব রাজনীতি খেলা বিনোদন বাণিজ্য লাইফ স্টাইল ভিডিও সকল বিভাগ
ছবি ভিডিও লাইভ লেখক আর্কাইভ

বিভেদই কি গ্রাস করছে আমাদের স্বপ্নের বাংলাদেশকে?

১০ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৭:৩৭ পিএম

ড: তারনিমা ওয়ারদা আন্দালিব, এবং দাউদ ইব্রাহিম হাসান চারিদিকে কেবল এক নিদারুণ হতাশার ছবি। শহরের অলিতে-গলিতে ধুলো আর জঞ্জাল, যেন অতীতের জরাজীর্ণতা আজও বর্তমানকে গ্রাস করে রেখেছে। আর মাত্র কদিন পরই বিজয় দিবস। এই মহান জাতীয় দিবসের প্রাক্কালে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের করিডোরে দাঁড়িয়ে সদ্য স্নাতক ইব্রাহিম তার শিক্ষিকা, বাস্তবসম্মত দৃষ্টিভঙ্গির জন্য সুপরিচিত হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট (HRM) বিভাগের তমা ম্যাডামের দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকালো। ইব্রাহিমের মনে তখন প্রশ্ন, "ম্যাডাম, স্বাধীনতার এতগুলো বছর পেরিয়ে গেলেও কেন এই বিভেদ আর বঞ্চনার প্রগাঢ় উপস্থিতি? বিজয় দিবস যখন সমাগত, তখন কেন মনে হয়, ২০১৫ সালের পর থেকে আমরা প্রতিদিন কোন দিক থেকে পেছাচ্ছি?"

তমা ম্যাডাম স্নেহভরে ইব্রাহিমের দিকে তাকালেন। তিনি বললেন, "ইব্রাহিম, তোমার এই প্রশ্নটিই হলো আসন্ন বিজয় দিবসের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনার দিক থেকে, প্রবৃদ্ধির সংখ্যাগুলো আমাদের স্বাধীনতা এনে দেওয়া লক্ষ্য থেকে অনেক দূরে। দেখ, দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার বর্তমানে ৬.৫ শতাংশ এর আশেপাশে স্থির হয়েছে বলে আইএমএফ পূর্বাভাস থেকে আমরা বুঝতে পারি, যেখানে ২০১৫ সালে এই হার ছিল ৬.৫৫ শতাংশ। এই তথ্য ইঙ্গিত দেয় যে, গত এক দশকে আমাদের প্রবৃদ্ধির গতি প্রত্যাশিত হারে বাড়েনি, বরং একটি নির্দিষ্ট বৃত্তে আটকে আছে যা প্রমাণ করে অর্থনৈতিক সংস্কারে আমরা পিছিয়েছি।" ম্যাডাম আরও যোগ করলেন, "আমাদের সমাজের বিভাজন কতটা গভীর, তা বোঝা যায় যখন দেখি গিনি সহগ, যা আয় বৈষম্য পরিমাপ করে, তা ২০১৫ সালের ০.৪৮ থেকে বেড়ে বর্তমানে ০.৫ এর উপরে রয়েছে বলে বিবিএস রিপোর্ট নির্দেশ করে।

এই চরম বৈষম্য প্রমাণ করে যে, সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় আমরা মারাত্মকভাবে ব্যর্থ হয়েছি, কারণ ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান প্রতিনিয়ত বাড়ছে এবং বিজয় দিবসের মূলমন্ত্র থেকে আমরা সরে যাচ্ছি।"

ইব্রাহিম এবার প্রশ্ন তুলল কর্মসংস্থান ও বিনিয়োগ নিয়ে, যা যুবকদের জীবনকে অনিশ্চিত করছে। "ম্যাডাম, কর্মসংস্থান কেন বাড়ছে না?" তমা ম্যাডাম ল্যাপটপ খুলে দেখালেন। "দেখো, ইব্রাহিম, ২০১৫ সালে বেকারত্বের হার ছিল ৪.২ শতাংশ, যা বর্তমানে ৩.৫ শতাংশে নেমে এলেও শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় ধারণা করে, প্রকৃত বেকারত্বের হার (ছদ্ম বেকারত্ব সহ) প্রায় ১২ শতাংশে পৌঁছেছে। এই বিশাল কর্মহীন জনশক্তি ইঙ্গিত দেয় যে, আমাদের মানবসম্পদ অব্যবহৃত থেকে যাচ্ছে।

বৈদেশিক প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ (FDI) ২০১৫ সালে যেখানে ছিল ২.২৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, তা বর্তমানে সামান্য বেড়ে ৩.০০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছালেও বাংলাদেশ ব্যাংক ডেটা থেকে আমরা বুঝতে পারি, এটি জিডিপির অনুপাতে দক্ষিণ এশিয়ার সর্বনিম্নগুলোর মধ্যে অন্যতম। এই অপর্যাপ্ত বিনিয়োগ প্রমাণ করে যে, বিনিয়োগকারীরা আমাদের রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে আস্থা হারাচ্ছে-এটাই আমাদের পিছিয়ে পড়ার অন্যতম কারণ।"

আলোচনা গড়াল শিক্ষা ও মানবসম্পদ উন্নয়নের দিকে। তমা ম্যাডাম দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, "আমরা কোথায় পেছাচ্ছি তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ হলো শিক্ষা ও স্বাস্থ্য। ২০১৫ সাল থেকেই শিক্ষা খাতে জিডিপির বরাদ্দ ২ শতাংশের নিচেই ঘোরাফেরা করছে বলে শিক্ষা মন্ত্রণালয় রিপোর্ট থেকে আমরা পাই। এই অপর্যাপ্ত বরাদ্দই আমাদের ভবিষ্যৎ মানবসম্পদকে দুর্বল করে দিচ্ছে এবং সাম্যের স্বপ্নকে দূর করে দিচ্ছে। এর ফলে, বর্তমানে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্তির হার ৯৮ শতাংশ হলেও, আন্তর্জাতিক মানের দক্ষতা সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ১২০টির মধ্যে ৯০-এর নিচে রয়েছে বলে বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম (WEF) রিপোর্ট নির্দেশ করে। এই চিত্র প্রমাণ করে, আমরা সংখ্যাগতভাবে শিক্ষিত হলেও গুণগতভাবে দক্ষ নই— এটিই আমাদের আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা থেকে পিছিয়ে দিচ্ছে।" তিনি আরও বললেন, "স্বাস্থ্য খাতে জনগণের গড় পকেট থেকে স্বাস্থ্য ব্যয় (Out-of-pocket expenditure) ২০১৫ সালের ৬৭ শতাংশ থেকে কমে বর্তমানে ৬৫ শতাংশে এলেও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) ডেটা দ্বারা প্রমাণিত, এটি এখনও অনেক বেশি। সরকার স্বাস্থ্যখাতে পর্যাপ্ত বিনিয়োগ না করায় সাধারণ মানুষ মৌলিক স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, যা মানবিক মর্যাদার পরিপন্থী।"

"ম্যাডাম," ইব্রাহিম জিজ্ঞাসা করল, "যদি এই সমস্যাগুলো সমাধান না হয়, তবে ২০৫০ সাল নাগাদ আমাদের পরিণতি কী হবে? আমাদের করণীয় কী?" তমা ম্যাডাম এবার ভবিষ্যতের ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরলেন। "যদি এই বিভাজন ও অব্যবস্থাপনা চলতে থাকে, তবে ২০৫০ সাল নাগাদ রাজনৈতিক মেরুকরণ আরও তীব্র হবে। বৈদেশিক প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ (FDI) ২০৪০ সালের মধ্যে ৪০ শতাংশ কমে যেতে পারে বলে অর্থনৈতিক পূর্বাভাসে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এই বিনিয়োগ হ্রাস ২০৫০ সালে বেকারত্বের হারকে ১৮ শতাংশে নিয়ে যেতে পারে, যা দেশের মানবসম্পদকে চরম সংকটে ফেলবে।"

তিনি করণীয় দিকগুলো স্পষ্টভাবে তুলে ধরলেন। "ইব্রাহিম, আমাদের বুঝতে হবে যে, এই পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পেতে প্রথম করণীয় হলো রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা। দ্বিতীয়ত, ২০৩০ সালের মধ্যে শিক্ষায় জিডিপি বরাদ্দ ন্যূনতম ৪ শতাংশে উন্নীত করতে হবে, অন্যথায় জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতি প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। তৃতীয় করণীয় হলো সামাজিক নিরাপত্তা বলয় তৈরি করা। ২০৩০ সালের মধ্যে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে বরাদ্দ ৫০০ কোটি টাকা বাড়িয়ে নিম্ন আয়ের মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত করতে হবে। চতুর্থ করণীয় হলো সুশাসন নিশ্চিত করা; বিশ্বব্যাংকের সুশাসন সূচকে বর্তমানে বাংলাদেশের অবস্থান অবনতি হওয়ায় দুর্নীতি ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা বিনিয়োগে বাধা দিচ্ছে। এই অবনতি ঠেকাতে হলে প্রশাসনিক সংস্কার ১০০ শতাংশ কার্যকর করা জরুরি।"

তমা ম্যাডাম উপসংহার টানলেন। "ইব্রাহিম, আমরা যদি ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করি, তবে এই কঠিন পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব। আমাদের সম্মিলিত উদ্যোগগুলো প্রমাণ করে যে, রাষ্ট্রের বিভিন্ন অংশের আন্তরিকতা এবং জনগণের সচেতনতা একত্র হলে নতুন এক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখা সম্ভব। ২০৫০ সাল নাগাদ আমরা যদি সঠিক পদক্ষেপ নিই, তবে আমাদের প্রবৃদ্ধি ৯ শতাংশ ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (ADB) রিপোর্ট থেকে আমরা বুঝতে পারি। মনে রেখো, 'নতুন বাংলাদেশ গড়তে আমাদের শুধু ইটের পর ইট গাঁথতে হবে না, গাঁথতে হবে বিশ্বাস আর ঐক্যের ভিত্তি।' বিজয় দিবসের এই প্রাক্কালে শপথ নিতে হবে, যেন আর কোনো দিন আমাদের কোনো তরুণকে এমন প্রশ্ন নিয়ে দাঁড়াতে না হয়।"

সংক্ষিপ্ত জীবনী :

ডঃ তারনিমা ওয়ারদা আন্দালিব, বর্তমানে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে সহকারী অধ্যাপক এবং যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড ইমপ্যাক্ট গ্রুপে গ্লোবাল কনসালট্যান্ট ডিরেক্টর হিসেবে কর্মরত আছেন।

দাউদ ইব্রাহিম হাসান, বর্তমানে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার্সে ইকোনোমিকস বিভাগের অধ্যায়নরত থাকার পাশাপাশি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় একজন রিসার্চ এসিস্ট্যান্ট এবং সেই সাথে আইডিএলসি ফাইন্যান্স পিএলসি-এর মার্কেটিং বিভাগের একজন সদস্য।

Sangbad Sarabela

সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী আবু জাফর

যোগাযোগ: । [email protected] । বিজ্ঞাপন ও বার্তা সম্পাদক: 01894944220

ঠিকানা: বার্তা ও বাণিজ্যিক যোগাযোগ : বাড়ি নম্বর-২৩৪, খাইরুন্নেসা ম্যানশন, কাঁটাবন, নিউ এলিফ্যান্ট রোড, ঢাকা-১২০৫।

আমাদের সঙ্গে থাকুন

© 2025 Sangbad Sarabela All Rights Reserved.