ঢাকার পুরনো লাল ইটের গলিঘুঁজির মতোই-যেখানে প্রতিটি দেয়াল অতীতের শত তরঙ্গ স্মৃতি বহন করে-২০২৫ সালও বাংলাদেশের ইতিহাসে জমে থাকা হাজারো অপ্রকাশিত আখ্যানের এক বিস্ময়কর অধ্যায়। এই বছরটি ছিল যেন সুড়ঙ্গের ভেতর লুকিয়ে থাকা আলোর মতো—অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার নীচে ধীর, স্থির, নীরব এক সামাজিক জাগরণ; ছিল রেকর্ডভাঙা ডিজিটাল অগ্রগতির ছায়ায় তরুণ সমাজের নিজের পরিচয় খোঁজার এক অন্তহীন যাত্রা।জানুয়ারির কুয়াশাভেজা উত্তরের হাওয়া থেকে শুরু করে নভেম্বরের বিদায়ী সূর্যের সোনালি অবগাহন—প্রতিটি দিন যেন আমাদের কানে ফিসফিস করে বলেছে: “তোমরা এক দুর্দম স্রোতের নাগরিক; স্বপ্ন, সম্ভাবনা আর সংগ্রামের প্রবাহ তোমাদের ছুঁয়ে যাচ্ছে।” এই অদৃশ্য, অথচ প্রবল নদী পাড়ি দিতে গিয়ে আমরা কখনো উদ্ভাবনের রঙিন পাল তুলেছি; কখনো দুর্নীতি, বৈষম্য ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ঘূর্ণাবর্তে আটকে গেছি; আবার কখনো মানবিকতা, প্রতিরোধ আর সাহসিকতার ঢেউ আমাদের এগিয়ে নিয়ে গেছে।এখানে তাই তুলে ধরা হলো আমাদের জাতীয় জীবনের স্পন্দন—মাইলফলক ও মনভাঙ্গা মুহূর্ত, আশা আর ক্ষোভ, উল্লাস ও শোক—সব মিলিয়ে প্রতিটি নাগরিকের হাসি-কান্না, ভাঙাগড়ার অনিবার্য, নির্মম, তবু আশাব্যঞ্জক গল্প।
আশা আর অস্থিরতার জানুয়ারি: প্রথম প্রভাতে জাতির অর্থনীতি, শিক্ষা ও উন্নয়নের দ্বৈত বাস্তবতা
জানুয়ারি যখন প্রথম প্রভাতের আলোয় দেশকে ছুঁয়ে দিল, তখন মনে হয়েছিল—একটি নতুন বছর নয়, যেন নতুন এক প্রতিশ্রুতির দরজা খুলে গেছে। ১ জানুয়ারির সকাল ঠিক ১০:০০টা—৪৫ সদস্যের অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক দল যখন নতুন লক্ষ্যের অভিষেক করছিল, তখন দেশের কোটি মানুষের দৃষ্টিতে ছিল এক গভীর, উজ্জ্বল আকাঙ্ক্ষা: অর্থনৈতিক মুক্তি। মুদ্রাস্ফীতির দহন থামুক, দুর্নীতির শৃঙ্খল ভাঙুক—এই দুই কামনাই যেন মানুষের হৃদয়ে নিবদ্ধ ছিল। কিন্তু স্বপ্নের পথ যে সদা সমতল নয়, তা বছর শুরুতেই মনে করিয়ে দিল নির্মম বাস্তবতা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের জানুয়ারি ২০২৫-এর তথ্য জানালো, রেমিট্যান্স প্রবাহে ৬ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ ‘১৮ শতাংশ পতন’—এক অদৃশ্য অন্ধকারের মতো হুন্ডির কালো থাবা দেশের অর্থনীতির শিরায়-বহুশিরায় ব্যথার রেখা টেনে দিল। এর প্রতিফলন এসে আঘাত করলো গৃহস্থের রান্নাঘরে, সন্তানের স্কুল-ফিসের খাতায়, অসুস্থ বাবার ওষুধের ব্যয়ে—প্রবাসীদের ঘামে গড়া জীবনরস যেন আচমকা শুকিয়ে যেতে লাগলো।এদিকে ৫ জানুয়ারি, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ঘোষিত ‘শিক্ষানীতি ২০২৫’ আবার এক নতুন আলোড়ন তুলল। প্রযুক্তি, উদ্ভাবন, স্মার্ট শিক্ষার প্রতিশ্রুতির নিচে শিক্ষাবিদরা খুঁজতে লাগলেন আরেকটি প্রশ্নের ছায়া—প্রাথমিক স্তরে ‘নৈতিক ও সামাজিক শিক্ষার ভারসাম্য’ কি সত্যিই যথাযথভাবে ধারণ করা হয়েছে? মানুষের মন গড়ার যে সূক্ষ্ম শিল্প, সেখানে একটু অসমতা মানেই প্রজন্মের ভিত কেঁপে ওঠা।
এই বিক্ষুব্ধ স্রোতের মাঝেই ১৫ জানুয়ারি সকাল ১১:৩০-এ চট্টগ্রাম বন্দরে রিয়ার অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ সোহাইলের হাত ধরে ‘বে-টার্মিনালের প্রথম পর্যায়ের নির্মাণ কাজ’ শুরু হল—বাণিজ্য জগতের বুকে যেন নতুন বাতিঘর জ্বলে উঠল। আমদানি-রপ্তানি সক্ষমতা ২৫ শতাংশ বাড়ানোর সেই ঐতিহাসিক লক্ষ্যে একটি সাহসী পদক্ষেপ।ঢাকা শহরও জানুয়ারিতে যেন নতুন গতিময়তার শপথ নিল। DMTCL ঘোষণা দিল—MRT লাইন-৬ এর সম্প্রসারণ,নতুন MRT লাইন-১ (বিমানবন্দর থেকে কমলাপুর) এবং MRT লাইন-৫ (হেমায়েতপুর থেকে ভাটারী) দ্রুত শেষ করার পরিকল্পনা।
ঢাকার কংক্রিট নগর যেন দূর দিগন্তে তাকিয়ে বলল—“আমি বদলাতে চাই, আমি শ্বাস নিতে চাই।” দেশ তখন জ্বালানি নিরাপত্তার প্রশ্নে এক সিদ্ধান্তমূলক পথ নিয়েছিল। সরকার কাতার পেট্রোলিয়াম (QP) ও ওমান এলএনজি’র সঙ্গে ‘দীর্ঘমেয়াদি LNG আমদানি চুক্তি’ সম্পন্ন করল—শিল্পখাতের চুল্লিগুলো যেন নিশ্চিত শ্বাস পেতে লাগল। কৃষকের ঘরেও আশার আলো জ্বলে উঠল: কৃষি ঋণে ‘১০ শতাংশ অতিরিক্ত ভর্তুকি’ ঘোষণা—মাটির মানুষ জানল, তাদের ফসলের ভবিষ্যৎ এখনও নিরাপদ।
তারপরও জানুয়ারি থামল না, নানামুখী আলো-ছায়ার গল্প নিয়ে এগিয়ে চলল।২০ জানুয়ারি সংসদে ‘সাইবার নিরাপত্তা আইনের (CSA)’ কিছু বিতর্কিত ধারা সংশোধন হলো। তরুণরা, যারা ডিজিটাল ভাষা ও ভাবনার নাগরিক, তারা আবার প্রশ্ন তুলল: বাকস্বাধীনতা কি সত্যিই শ্বাস নিতে পারবে?২৪ জানুয়ারি ERD সচিব শাহরিয়ার কাদের সিদ্দিকী ‘বৈদেশিক ঋণ ব্যবহারে কঠোর নীতিমালা’ প্রণয়ন করে অব্যবহৃত ঋণ ৫ শতাংশ কমানোর লক্ষ্য স্থির করলেন—কারণ জাতির ভবিষ্যৎ ঋণের বোঝায় নয়, বুদ্ধিমান ব্যবস্থাপনায় তৈরি হয়। ২৫ জানুয়ারি পদ্মা সেতুর টোল গড়ে ‘১২ শতাংশ বৃদ্ধি’ পেল—বাজারে, পথে, পণ্যবাহী ট্রাকে—সবখানে সেই চাপের ঢেউ পৌঁছে গেল।জানুয়ারি ২৯-এ বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের ঘোষণায় আরও কঠোর ভর্ৎসনা নেমে এলো—’ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা’। বছরের প্রথম মাসে অর্থনীতির প্রতি এই শৃঙ্খলার ডাক যেন এক কঠিন, কিন্তু প্রয়োজনীয় সতর্কবার্তা।
তবে জানুয়ারি শুধু অর্থনীতি বা প্রশাসনের গল্প নয়। ২০ জানুয়ারি DNCC মেয়র আতিকুল ইসলামের উদ্যোগে ‘BTI জৈবিক কীটনাশক’ এবং ‘উচ্চ প্রযুক্তির ড্রোনের মশা নিধন অভিযান’ শুরু হল—ক্লান্ত নগরবাসীর রাতগুলো যেন কিছুটা শান্তির প্রত্যাশা পেল। মাসের শেষে পর্যটন ও শিল্পখাতে নতুন প্রাণ আনতে ‘কক্সবাজার ও সুন্দরবনের নিরাপত্তা নীতিমালা’ এবং ‘বিদ্যুতের পিক-আওয়ার ভিত্তিক মূল্য কাঠামো’ চালু হলো। দেশের অর্থনৈতিক প্রবাহ যেন নতুন ছন্দ খুঁজে নেওয়ার চেষ্টা করল। এভাবে জানুয়ারি ২০২৫—কখনো আশার রোদ, কখনো সংশয়ের ছায়া—একটি জাতির সংগ্রাম, স্থিতি ও পুনর্জাগরণের প্রথম অধ্যায় হিসেবে ইতিহাসে লিপিবদ্ধ হয়ে রইল।
ফেব্রুয়ারির ধাক্কা ও সম্ভাবনা: মুদ্রাস্ফীতি, পরিবেশ সংকট ও সংস্কার অভিযাত্রায় বাংলাদেশের টালমাটাল পথচলা
ফেব্রুয়ারি আসতেই সেই অর্থনৈতিক চাপ আরও বাড়লো। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (BBS) এর তথ্য (ফেব্রুয়ারি, ২০২৫) অনুযায়ী, খাদ্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে দেশের সামগ্রিক মুদ্রাস্ফীতি ১০.৫ শতাংশ অতিক্রম করে গেল, যা ছিল গত ১২ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। এই পরিস্থিতি একজন সীমিত আয়ের পরিবার প্রধানের কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ ফেললো। এই সময়ই পরিবেশ অধিদপ্তর ইটভাটা ও নির্মাণ কাজ নিয়ন্ত্রণে কঠোরতা আনলো, কারণ ফেব্রুয়ারি ১০ তারিখে ঢাকায় বায়ুর গুণগত মান (AQI) ১৮০-২০০ এর মধ্যে ঘোরাফেরা করছিল—আমরা যেন নিঃশ্বাস নেওয়ার অধিকারও হারাতে বসেছিলাম। কিন্তু আশার কথা ছিল, ফেব্রুয়ারি ১৫ তারিখে সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (BRTA) ড্রাইভিং লাইসেন্স এবং গাড়ির রেজিস্ট্রেশনের জন্য ১০০ শতাংশ অনলাইন পরিষেবা চালু করলো, যা দুর্নীতি ২০ শতাংশ কমানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল এবং তরুণ উদ্যোক্তাদের কাজ সহজ করলো।
অন্যদিকে, ফেব্রুয়ারি ২০ তারিখে ইউনেস্কো (UNESCO) যখন সুন্দরবন সংলগ্ন শিল্পাঞ্চলের বর্জ্য নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করলো, তখন আমাদের পরিবেশ রক্ষার দায়িত্বহীনতা আবারও প্রকট হলো। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (ADB) বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সংস্কারের জন্য $৫০০ মিলিয়ন ঋণ অনুমোদন করলো, তবে শর্ত ছিল আর্থিক খাতে সংস্কারের গতি বাড়াতে হবে।
ফেব্রুয়ারি ২৫ তারিখে কৃষি জমি সুরক্ষা নিশ্চিত করতে সরকার উচ্চ ফলনশীল জমিতে সৌর বিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করলো, উদ্দেশ্য ছিল খাদ্য নিরাপত্তা বজায় রাখা। ফেব্রুয়ারি ৯ তারিখে ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলায় (DITF) রেকর্ড পরিমাণ ৫০০০ কোটি টাকার বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষরিত হলো, যা দেশীয় ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (SME)-কে উৎসাহিত করলো। সরকার ফেব্রুয়ারি ১৫ তারিখে মিরপুর ও কল্যাণপুরের বস্তিবাসীদের জন্য সাশ্রয়ী মূল্যে বহুতল আবাসন প্রকল্পের প্রথম পর্ব উদ্বোধন করলো, যা বস্তিবাসীদের জীবনকে মানবিক করার একটি পদক্ষেপ। ফেব্রুয়ারি ২২ তারিখে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে রেল ও স্থলবন্দর ব্যবহার করে বাণিজ্য সহজ করার জন্য নতুন চুক্তি স্বাক্ষরিত হলো, যার লক্ষ্য ছিল দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ২০ শতাংশ বৃদ্ধি করা। এই মাসে ৫০০ কোটি টাকার উপরে ঋণ খেলাপিদের তালিকা প্রকাশ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এছাড়াও, খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ৫০টি নতুন সাইলো তৈরির প্রকল্প, প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগে ডিজিটাল মনিটরিং, পর্যটন শিল্পে বিদেশী বিনিয়োগ বৃদ্ধি, ফেব্রুয়ারি ২৮ তারিখে ই-পাসপোর্টের আবেদনের প্রক্রিয়া সরলীকরণ এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পদোন্নতি নীতিমালায় দক্ষতা ও সততাকে অগ্রাধিকার দেওয়া হলো।
মার্চের জলবায়ু সংকট, জ্বালানি বিপর্যয় ও পুনরুত্থানের স্বপ্নে বাংলাদেশের সংগ্রামী অধ্যায়
মার্চ —যে মাসে ঋতুর পরিবর্তন শুধু গাছের পাতায় নয়, দেশের নাড়ীতেও অনুভূত হলো। প্রকৃতি যেন এক কঠোর শিক্ষক, ১ মার্চেই আমাদের সামনে তুলে ধরল বাস্তবতার নির্মম পাঠ। পরিবেশ মন্ত্রণালয় ও আন্তর্জাতিক জলবায়ু গবেষণা সংস্থা (IPCC)–এর সম্মিলিত রিপোর্ট বলল—গত দশকে উপকূলীয় অঞ্চলের তাপমাত্রা বেড়েছে ১.৫° সেলসিয়াস। এই সংখ্যা কোন ঠান্ডা পরিসংখ্যান নয়—এ যেন সুন্দরবনের প্রাচীন গাছের গায়ে ফাটল ধরা, জেলের নৌকায় খরা বাতাসের কষ্ট, কৃষকের মাটিতে নোনাজলের দীর্ঘশ্বাস।এমন সময় বিদ্যুৎ খাতে কয়লা আমদানির জটিলতা দেশজুড়ে নামিয়ে আনল ৩–৪ ঘণ্টার লোডশেডিং—’অন্ধকার যেন শুধু শহরের রাস্তায় নয়, মানুষের মনের ভেতরেও নেমে এল।’
এই তাপমাত্রা বৃদ্ধি কেবল পরিসংখ্যান ছিল না, এটি সুন্দরবনের জেলে ও কৃষকদের জীবন-জীবিকার প্রতি এক চরম আঘাত। এর মাঝে কয়লা আমদানিতে জটিলতার কারণে সারা দেশে বিদ্যুৎ সরবরাহ বিঘ্নিত হলো, দৈনিক ৩-৪ ঘণ্টা লোডশেডিং শুরু হলো, যার ফলে শিল্প উৎপাদন ১০ শতাংশ কমে যায়। এই বিদ্যুৎ বিভ্রাট যেন আমাদের স্বপ্নের গতি থামিয়ে দিতে চাইল। তবে সরকারও বসে থাকেনি; তারা সৌর ও বায়ু বিদ্যুতের মতো নবায়নযোগ্য শক্তি খাতে $১ বিলিয়ন বিদেশী বিনিয়োগের ঘোষণা দিল, ২০৩০ সালের মধ্যে মোট বিদ্যুতের ৪০ শতাংশ নবায়নযোগ্য উৎস থেকে উৎপাদনের লক্ষ্য নিয়ে।
শিল্প উৎপাদন ১০ শতাংশ কমে যাওয়া ছিল সেই অন্ধকারের প্রতিচ্ছবি। যেন জাতির যাত্রা-মুখী ট্রেনটি হঠাৎ ধাতব শব্দে থেমে গেল, সামনের লাইনেই পড়ে রইল অদৃশ্য কুয়াশার স্তর।তবুও আশার আলোর রেখা ফুটে ওঠে ঠিক সেই অন্ধকারের মধ্যেই। সরকার ঘোষণা করল—সৌর ও বায়ুশক্তি খাতে ১ বিলিয়ন ডলার বিদেশি বিনিয়োগ, এবং ২০৩০ সালের মধ্যে দেশের মোট বিদ্যুতের ৪০ শতাংশ নবায়নযোগ্য উৎস থেকে উৎপাদনের উচ্চাকাঙ্ক্ষী লক্ষ্য।এ যেন মরুভূমির বুকে অঙ্কুরিত এক টিকে থাকার প্রতিশ্রুতি।
১০ মার্চ IMF অর্থনৈতিক সংস্কারের অগ্রগতি দেখে প্রশংসা করলেও ব্যাংকিং খাতে সুশাসনের দুর্বলতা নিয়ে শাণিত সতর্কবার্তা দিল। পরিকল্পনা কমিশন LDC উত্তরণের পর আন্তর্জাতিক বাজারে সুবিধা ধরে রাখার জন্য নতুন কৌশলপত্র প্রকাশ করল—জাতীয় অর্থনীতির ভবিষ্যৎ যেন এক দীর্ঘ দৌড়, যার আগে ভালো করে জুতোর ফিতা বাঁধা জরুরি।২০ মার্চ বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (BARI) উদ্ভাবন করল জলবায়ু-সহনশীল দুই ধানের জাত ও তিনটি সবজির জাত—এই ভূমির কৃষকরা যেন আবারও প্রমাণ করল, মাটির শক্তিই এই দেশের ভিত্তি।
এদিকে রাজশাহী ও খুলনার ৫০০ গ্রামে আর্সেনিকমুক্ত গভীর নলকূপ স্থাপনের উদ্যোগ জানাল যে—নিরাপদ পানিই উন্নয়নের প্রথম ধাপ। ২৮ মার্চ দুদক ও BFIU একসঙ্গে আন্তর্জাতিক সহযোগিতার নতুন চুক্তি করল অর্থপাচার রোধে। আর JICA–র সহায়তায় ঢাকা শহরে জলাবদ্ধতা নিরসনে নতুন ৫ বছরের মাস্টারপ্ল্যান—এ যেন বৃষ্টির ঋতুর আগেই নগরবাসীর হাঁটু জলে দাঁড়িয়ে থাকা স্মৃতিগুলোকে মুছে ফেলার চেষ্টা।
এদিকে শিক্ষা খাতেও মার্চ মাসটি এলো পরিবর্তনের মশাল হাতে। মাধ্যমিক কারিকুলামে বাধ্যতামূলক করা হলো কোডিং ও রোবোটিক্স—ভবিষ্যতের শ্রমবাজারের চাবিকাঠি এখনই তুলে দেওয়া হলো তরুণদের হাতে।
১৫ মার্চ BGMEA ও ILO যৌথভাবে তৈরি পোশাক শিল্পে নিরাপত্তা নীতিমালা আরও কঠোর করল—হাজারো শ্রমিকের ঘাম যেন আর কোনও দুর্যোগের সামনে অনিশ্চিত না হয়ে দাঁড়ায়।মাসের শেষদিকে দেখা গেল অন্য সব উদ্যোগের পরিধি—ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ জোরদার, সেন্টমার্টিন দ্বীপে পরিবেশবান্ধব নিয়ম প্রয়োগ, স্বাস্থ্যখাতে বেসরকারি বিনিয়োগে নতুন প্রণোদনা।মার্চ ২০২৫—এক অনিশ্চিত পৃথিবীর ভিতরে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ যেন নতুন করে শিখল, সংকট যত গভীরই হোক, পুনর্জাগরণের পথ কখনোই বন্ধ হয় না।
এপ্রিলের আগুনঝরা আকাশ, পরিবর্তনের পদচিহ্ন
প্রথম পর্ব: এপ্রিল মাসটি বাংলাদেশের জন্য যেন প্রকৃতির চরম পরীক্ষা হয়ে নেমে এলো। ১৫ এপ্রিল আবহাওয়া অধিদপ্তর ঘোষণা করল—দেশের ৭৫ শতাংশ অঞ্চল তীব্র তাপপ্রবাহে বিপর্যস্ত, তাপমাত্রা ছাড়িয়ে গেল রেকর্ড ৪২°C। এই তাপমাত্রা শুধু গরম নয়, ছিল এক নীরব দুর্ভিক্ষ—হিট স্ট্রোক, পানিবাহিত রোগ, ডায়রিয়া ও ডিহাইড্রেশনে দেশজুড়ে জনস্বাস্থ্য পরিস্থিতি হুমকির মুখে পড়ল। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জরুরি ভিত্তিতে ৩ দিনের বিশেষ সতর্কতা জারি করল, যেন গৃহে, কর্মস্থলে, হাসপাতালগুলোতে প্রস্তুতি নেওয়া যায়। এপ্রিলের এই আগুনঝরা আকাশের নিচে মানুষের প্রতিটি শ্বাস যেন হয়ে উঠল বাঁচা-মরার সংগ্রাম।
দ্বিতীয় পর্ব: প্রকৃতির এই চাপের কাছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ২০ এপ্রিল বাধ্য হলো গ্রীষ্মকালীন ছুটি আগাম ঘোষণা করতে—ক্লাসরুম খালি হলো, আর স্কুলের মাঠে নেমে এলো নিস্তব্ধতা। তবে একই সময়েই দেশের ডিজিটাল অগ্রযাত্রা যেন প্রকৃতির রুদ্ররূপকে চ্যালেঞ্জ জানাল। বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল (BCC) ঘোষণা করল—সরকারি সহায়তা ও তরুণদের দক্ষতার ফলে আইটি, সফটওয়্যার ও আউটসোর্সিং খাতে ২০ শতাংশ রপ্তানি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে। বিদেশগামী শ্রমিকদের দক্ষতা যাচাই প্রক্রিয়া কঠোর করার মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যের শ্রমবাজারে দক্ষ কর্মীর চাহিদা পূরণের প্রস্তুতি নেওয়া হলো। আগুনের মতো উত্তপ্ত এপ্রিলের মাঝেও এই ডিজিটাল অগ্রগতি ছিল দেশের জন্য শীতল বাতাসের মতো।
তৃতীয় পর্ব: প্রকৃতির আঘাতে যখন মানুষ বিপর্যস্ত, তখন কৃষিক্ষেত্রে ভবিষ্যতের পানির সংকট মোকাবিলায় সরকার ঘোষণা করল ৫০০টি পুকুর খনন ও সংস্কার প্রকল্প—যা সেচব্যবস্থার উন্নতি ও জলসংরক্ষণে দীর্ঘমেয়াদে গুরুত্বপূর্ণ হবে। একইসঙ্গে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের দীর্ঘদিনের যানজট কমাতে স্বয়ংক্রিয় টোল ব্যবস্থা এবং ৬ লেন সম্প্রসারণ কাজ শুরু হলো, যা দেশের বাণিজ্যচক্রে নতুন গতি সঞ্চার করল। পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্প (PERP) এর ৮৫ শতাংশ কাজ সম্পন্ন হওয়ার ঘোষণা জাতীয় অবকাঠামোর শক্তিকে আরও সুদৃঢ় করল।
চতুর্থ পর্ব: আর্থিক খাতের দুর্বলতা কাটাতে বাংলাদেশ ব্যাংক উদ্যোগ নিল—সংকটাপন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করার প্রক্রিয়া শুরু হলো। রাজস্ব ফাঁকি কমাতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (NBR) নতুনভাবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) ব্যবহারের ঘোষণা দিল। বিদেশি বিনিয়োগকারী ও পর্যটকদের জন্য অন-অ্যারাইভাল ভিসা সুবিধা সম্প্রসারণ করা হলো, যাতে দেশ আরও উন্মুক্ত ও বিনিয়োগবান্ধব হয়ে ওঠে।
পঞ্চম পর্ব: শ্রমিক অধিকারের প্রশ্নে এপ্রিলের শুরুতেই সরকার গঠন করল একটি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি, যাতে পোশাকশিল্পে মজুরি ও শ্রম-অধিকার সুরক্ষিত হয়। ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন (DSCC) গণপরিবহনের বিশৃঙ্খলা কমাতে ৫টি রুটে নতুন বাস ফ্র্যাঞ্চাইজি মডেল চালু করল। একই সঙ্গে পরিবেশ অধিদপ্তর পরিবেশ কমপ্লায়েন্স না মানা ৫০টি শিল্পকারখানার বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করল। আর মাসের শেষে সরকার ঘোষণা করল ৩ বছরের কৃষি রোডম্যাপ—খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা রক্ষার প্রতিশ্রুতি।
মে মাসের ঘূর্ণিঝড়, শিক্ষা ও অর্থনীতি—মে মাসের বহুমাত্রিক সংকট ও পুনরুত্থান
মে মাসের শুরুতেই দেশ যেন বহুমাত্রিক সংকটের মধ্য দিয়ে হাঁটতে শুরু করলো। মে ১০ তারিখ রাত ১০টায় তীব্র ঘূর্ণিঝড় ‘রেমাল’ সাতক্ষীরা–খুলনা উপকূলে আছড়ে পড়ে, রেখে যায় বিধ্বস্ত ঘরবাড়ি, ভেঙে যাওয়া বাঁধ, লবণাক্ত জলে ডুবে যাওয়া ফসল আর অন্তত ৫০০ কোটি টাকার ক্ষতি। প্রাণ হারালেন ৫০ জনেরও বেশি মানুষ, যাদের মৃত্যু ছিল শুধু প্রকৃতির আঘাত নয়—দেশের দুর্বল প্রস্তুতি, ভঙ্গুর অবকাঠামো এবং ধীর ত্রাণ-ব্যবস্থাপনার এক বেদনাদায়ক স্মারক।
ঠিক এই দুর্যোগের মধ্যেই মে ৩০ তারিখে এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হলো, যেখানে পাসের হার ছাড়িয়ে গেল ৯৩ শতাংশ—পাঁচ বছরের সর্বোচ্চ। এক মুহূর্তের জন্য হলেও শিক্ষার্থীদের এই সাফল্য জাতিকে স্বস্তির নিঃশ্বাস দিল; কিন্তু পরপরই আবার কঠোর হয়ে উঠলো বাস্তবতা—বিশ্ববাজারের সমন্বয়ে সরকার অকটেন, পেট্রোল ও ডিজেলের মূল্য গড়ে ১০ শতাংশ বাড়ালো। গণপরিবহন, কৃষি সরবরাহ, নিত্যপণ্যের দাম—সব কিছুতেই এই প্রভাব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। ঘূর্ণিঝড়ের পর বিশ্বব্যাংক (World Bank) ও এডিবি (ADB) জরুরি সহায়তা দিলেও সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনে চাপ আরও বাড়তে থাকে। একই সময়ে নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য সরকারি হাসপাতালগুলোতে স্বাস্থ্য বীমার একটি পাইলট প্রকল্প চালু করে সরকার, যা ভবিষ্যতে স্বাস্থ্য সুরক্ষায় পথ খুলে দিতে পারে।
মে ১৫ তারিখে বাংলাদেশের মহিলা ক্রিকেট দল এশিয়ান ক্রিকেট কাউন্সিল (ACC) টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হলো, যা দেশের সম্মান বৃদ্ধি করলো এবং তরুণ ক্রীড়াবিদদের অনুপ্রাণিত করলো। এই বিপর্যয় ও অর্থনৈতিক চাপের মাঝেও আশার আলো খুঁজে পাওয়া গেল দেশের খেলাধুলা ও উন্নয়ন উদ্যোগে। মে ১৫ তারিখে বাংলাদেশ মহিলা ক্রিকেট দল এশিয়ান ক্রিকেট কাউন্সিল (ACC) টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হয়ে জাতিকে গর্বিত করলো।
একই সঙ্গে নদীভাঙন মোকাবিলায় সরকার দেশের পাঁচটি প্রধান নদীতীরে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণে ২০০০ কোটি টাকার প্রকল্প অনুমোদন করে। কৃষকদের জন্য ভর্তুকি সরাসরি তাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে পৌঁছে দিতে চালু হলো ডিজিটাল পদ্ধতি—যা স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বাড়াবে। মে ২৮ তারিখে আগামী অর্থবছরের প্রস্তুতি হিসেবে শুরু হলো প্রাক-বাজেট আলোচনা, আর তারল্য সংকট মোকাবিলায় বাংলাদেশ ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে অতিরিক্ত ১০০ মিলিয়ন ডলার সহায়তা দেয়। পল্লী উন্নয়ন একাডেমি (RDA) গ্রামীণ অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে ৫০ হাজার কর্মসংস্থানের লক্ষ্যমাত্রা ঘোষণা করে।
সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে কঠোরভাবে সড়ক নিরাপত্তা আইন প্রয়োগের নির্দেশ দিলে মাত্র এক মাসে দুর্ঘটনা ১৫ শতাংশ হ্রাস পায়—যা রাস্তা–নিরাপত্তায় নতুন সম্ভাবনার ইঙ্গিত দেয়। বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের অবস্থান শক্তিশালী করতে কূটনৈতিক তৎপরতা বাড়ানো হয়, পাশাপাশি শিশুশ্রম সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মানোন্নয়নে চালু হয় নতুন মূল্যায়ন পদ্ধতি, যা উচ্চশিক্ষায় স্বচ্ছতা ও প্রতিযোগিতা বাড়াতে পারে। সব মিলিয়ে, মে মাস ছিল ঘূর্ণিঝড়, অর্থনৈতিক চাপ, প্রশাসনিক পরীক্ষার পাশাপাশি জয়ের গল্প, পুনর্গঠনের প্রচেষ্টা এবং ভবিষ্যতের উন্নয়ন কাঠামো গঠনের এক জটিল, বহুমাত্রিক অধ্যায়—যেখানে সংকট ও সম্ভাবনা পাশাপাশি দাঁড়িয়ে রইলো বাংলাদেশের সামনে।
জুনের অর্থনীতি—বাজেট, অবকাঠামো ও সংকটের জটিল সমীকরণ
জুন মাস অর্থনৈতিক ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাস। জুন ৫ তারিখে অর্থমন্ত্রী ২০২৫-২০২৬ অর্থবছরের জাতীয় বাজেট ঘোষণা করলেন, যেখানে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি এবং রাজস্ব আদায়ে নতুন কর আরোপ ছিল প্রধান দিক। জুন ২৫ তারিখে প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পের (PERP) প্রথম পর্ব আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হলো, ঢাকা থেকে ভাঙ্গা পর্যন্ত রেল চলাচল শুরু হলো—এটি ছিল আমাদের অবকাঠামোগত সাফল্যের এক উজ্জ্বল স্বাক্ষর। কিন্তু একই মাসে বাংলাদেশ ব্যাংক অর্থনীতিতে টাকার প্রবাহ কমাতে নীতি সুদ হার (Repo Rate) আরও ৫০ বেসিস পয়েন্ট বৃদ্ধি করায় ব্যবসায়ীদের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়লো।
সবচেয়ে উদ্বেগের ছিল, জুন মাসে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ $২৮ বিলিয়ন এর নিচে নেমে আসে (বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য)। অন্যদিকে, দেশীয় শিল্পকে সুরক্ষা দিতে সরকার কিছু বিলাসবহুল পণ্য এবং তৈরি পোশাকের কাঁচামালের ওপর আমদানি শুল্ক বৃদ্ধি করে। জুন ২০ তারিখে জানা গেল, অর্থনৈতিক মন্দা ও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে ঢাকা ও চট্টগ্রামের উপশহর এলাকায় ডাকাতি ও ছিনতাইয়ের ঘটনা ৩০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে, যা সামাজিক অস্থিরতার চরম চিত্র। সরকারি হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসকদের জন্য বিশেষ প্রণোদনা ঘোষণা করা হলো।
জুন ৩০ তারিখে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের জন্য সরকার ন্যূনতম মজুরি ২৫ শতাংশ বৃদ্ধি করার সিদ্ধান্ত নেয়। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সাইবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কঠোর নির্দেশনা জারি করলো। যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর বেকারত্ব কমাতে যুবকদের জন্য ১ লাখ প্রশিক্ষণ এবং ক্ষুদ্র ঋণ প্রকল্প হাতে নেয়, যা যুবশক্তির ব্যবহারে একটি বড় পদক্ষেপ। সরকারি কেনাকাটায় দুর্নীতি কমাতে সরকার ই-টেন্ডারিং প্রক্রিয়াকে বাধ্যতামূলক করলো। জুন ১৫ তারিখে আশ্রয়ণ-৩ প্রকল্পের আওতায় গৃহহীনদের জন্য ৫০ হাজার নতুন ঘর হস্তান্তর করা হয়। পানি উন্নয়ন বোর্ড উত্তর ও পূর্বাঞ্চলে আসন্ন বন্যা মোকাবেলার জন্য নতুন আগাম সতর্কীকরণ ব্যবস্থা চালু করলো। এছাড়াও, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (NBR) কর ফাঁকি রোধে ডিজিটাল পদ্ধতির ব্যবহার বাড়ালো, কৃষি প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ বাড়ানো হলো।
অন্যরকম জুলাই —বন্যা, বিদ্রোহ ও পুনর্গঠনের সংগ্রামী মাস
জুলাই মাসটি শুরু হলো বন্যার তাণ্ডব নিয়ে। জুলাই ১০ তারিখে বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে (সিলেট, সুনামগঞ্জ) স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যা দেখা দিল। ৩০ লক্ষাধিক মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হলো, ১০০০ কোটি টাকার বেশি কৃষি ক্ষতি দেশের খাদ্য নিরাপত্তাকে নড়বড়ে করে দিল।নদী-হাওরের উপচে পড়া জল যেন ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের কান্না নিয়েই বইছিল। আন্তর্জাতিক সহায়তা দ্রুত সক্রিয় হলো—বিশ্বব্যাংক (World Bank) বন্যা মোকাবেলা ও পুনর্বাসনের জন্য ৩০০ মিলিয়ন ডলার জরুরি তহবিল অনুমোদন করল। এই প্রাকৃতিক দুর্যোগে অসহায় মানুষের চোখের জল যেন নদী-হাওরের জলকে আরও বাড়িয়ে তুলল।
তবে আন্তর্জাতিক সাহায্যও এলো: বিশ্বব্যাংক (World Bank) বন্যা মোকাবেলায় এবং দুর্যোগ পরবর্তী পুনর্বাসনের জন্য বাংলাদেশকে $৩০০ মিলিয়ন জরুরি ঋণ সহায়তা অনুমোদন করলো।জুলাই ১ তারিখে এইচএসসি পরীক্ষা শুরু হলেও বন্যার কারণে এবং অর্থনৈতিক সংকটের জেরে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার হার ৮ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। সরকার জলবায়ু সহনশীল বীজ ও সারে ভর্তুকি বাড়িয়ে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের দ্রুত স্বাভাবিক উৎপাদনে ফেরানোর চেষ্টা করলো।
এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক রেমিট্যান্স প্রবাহে ৫ শতাংশ উন্নতির খবর জানাল। মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ (DMTCL) MRT লাইন–১ দ্রুততর করতে বিদেশি ঠিকাদারদের সঙ্গে নতুন চুক্তি স্বাক্ষর করে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর গ্রামীণ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে টেলিমেডিসিন ও ডিজিটাল স্বাস্থ্য রেকর্ড চালু করে, যা চিকিৎসাসেবার আধুনিকায়নে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন। জুলাই ২০ তারিখে CTTC ঢাকা ও চট্টগ্রামে একাধিক সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান পরিচালনা করে, যা নিরাপত্তা জোরদার করে। বিদেশি বিনিয়োগকারী ও পর্যটকদের আকর্ষণে অর্থনৈতিক অঞ্চলে ভূমি লিজের হার ১০ শতাংশ কমানো হয়।একাধিক সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান পরিচালিত হয়, যা সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার একটি পদক্ষেপ। বিদেশী বিনিয়োগকারী এবং পর্যটকদের জন্য সরকার অর্থনৈতিক অঞ্চলে ভূমি লিজের হার ১০ শতাংশ কমিয়ে দিল।
এর ঠিক মধ্যভাগে, জুলাই ২১–২৫, দেশ সাক্ষী হলো “জুলাই বিপ্লব ২০২৫ (July Revolution 2025)”–এর, যেখানে তরুণ শিক্ষার্থী, নাগরিক সমাজ ও মধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠীর শক্তিশালী আন্দোলন দেশের রাজনৈতিক–সামাজিক বাস্তবতাকে নতুন প্রশ্নে দাঁড় করায়। দুর্নীতি, অসমতা, শিক্ষাব্যবস্থার বৈষম্য, যুবকের বেকারত্ব এবং নীতির জবাবদিহিতাহীনতার বিরুদ্ধে এই বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে রাজধানী ঢাকা থেকে রাজশাহী, খুলনা, চট্টগ্রাম এবং সিলেট পর্যন্ত। ২৩ জুলাই রাতের দিকে শাহবাগ, টিএসসি, কারওয়ান বাজারে লক্ষাধিক মানুষের উপস্থিতি দেশকে স্মরণ করিয়ে দেয় আমাদের স্বাধীনতা ও গণতান্ত্রিক চেতনার শেকড়ের কথা। আন্দোলনের মুখ্য দাবি ছিল—স্বচ্ছ প্রশাসন, যুবকদের কর্মসংস্থান, এবং সামাজিক বৈষম্যহীন রাষ্ট্র পরিচালনা। এই আন্দোলনের প্রভাবে সরকার তাৎক্ষণিকভাবে রাষ্ট্রায়ত্ত খাতে দুর্নীতি তদন্তে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল, বৃত্তি-বঞ্চনার পুনর্মূল্যায়ন এবং চাকরি পরীক্ষায় ডিজিটাল স্বচ্ছতা নিশ্চিতের অঙ্গীকার করে। জুলাই বিপ্লবের ঢেউ রাজপথ ছাড়িয়ে প্রশাসনিক সিদ্ধান্তেও প্রতিফলিত হতে থাকে।
বন্যার প্রভাবে কক্সবাজার ও সিলেট অঞ্চলের পর্যটন শিল্পে ৪০ শতাংশের বেশি ধস নামে। সরকারি চাকরির নতুন নিয়োগ নীতিতে দুর্নীতি কমাতে ডিজিটাল যাচাই বাধ্যতামূলক করা হয়। এই সময়ে BEZA জানায় যে নতুন অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোতে এই বছর ৫০ হাজার নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকের ভোক্তা ঋণে কড়াকড়ি আরোপ করে। পাশাপাশি শিক্ষা মন্ত্রণালয় বন্যা ও আর্থিক সংকটে ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষার্থীদের জন্য দুই বছরের বিশেষ বৃত্তি ঘোষণা করে। জুলাই মাসের রাজনৈতিক স্পন্দন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, এবং তরুণদের অধিকার আন্দোলন মিলেমিশে একটি সংগ্রামী, পরিবর্তনমুখী ও ঐতিহাসিক মাসের প্রতিকৃতি এঁকে যায়।
বন্যার কারণে কক্সবাজার ও সিলেট অঞ্চলের পর্যটন শিল্পে ৪০ শতাংশ এর বেশি ধস নামে। সরকারি চাকরিতে নতুন নিয়োগ নীতিমালায় দুর্নীতি কমাতে ডিজিটাল যাচাই প্রক্রিয়া বাধ্যতামূলক করা হলো। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (BEZA) এর তথ্যমতে, এই বছরে নতুন অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোতে ৫০ হাজার নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংক মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর জন্য ভোক্তা ঋণ (Consumer Loan) বিতরণে কড়াকড়ি আরোপ করে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় বন্যা এবং অর্থনৈতিক সংকটে ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষার্থীদের জন্য ২ বছরের জন্য বিশেষ বৃত্তি চালু করলো।
আগস্টের অস্থিরতার ভিতর পুনর্গঠনের সংগ্রাম
আগস্ট মাসে অর্থনৈতিক অস্থিরতা আরও প্রকট হয়ে উঠল। আগস্ট ১৫ নাগাদ রাজধানীসহ বড় শহরগুলোতে হঠাৎ দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে সাধারণ মানুষের মধ্যে চাপা ক্ষোভ দেখা দেয়—বিশেষ করে পেঁয়াজ, ডাল, আটা, ভোজ্যতেল ও সবজির বাজারে অনিয়ন্ত্রিত মূল্যবৃদ্ধি নিম্ন ও মধ্যবিত্তকে সংকটে ফেলে। এই মুদ্রাস্ফীতির চাপ মোকাবেলায় বাংলাদেশ ব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ রক্ষা করতে টাকার মান আরও ৫ টাকা অবমূল্যায়ন করে, যার ফলে আমদানি ব্যয় আরও বেড়ে যায় এবং পরিবহন খরচও বৃদ্ধি পায়। বাজারের এই উত্তাপের মাঝে একটি আশার আলো দেখা যায়—আইসিটি মন্ত্রণালয় জানায়, মোবাইল ব্যাংকিং, ই-কমার্স, ফিনটেক ও ডিজিটাল উদ্যোক্তা খাতে ২৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে, যা তরুণদের উদ্ভাবনশক্তি ও প্রযুক্তিনির্ভর অর্থনীতিতে তাদের শক্ত অবস্থানকেই প্রমাণ করে।
কিন্তু অর্থনৈতিক কাঠামোগত দুর্বলতা প্রকট থেকে প্রকটতর হলো। কঠোর নীতিমালা, শোধ আদায়ে চাপ, এবং ব্যাংকগুলোর ওপর কঠোর তদারকি থাকা সত্ত্বেও মোট খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়ায় ১ লক্ষ ৭০ হাজার কোটি টাকা, যা দেশের অর্থনীতির জন্য এক গভীর ও দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতের সমান। ব্যাংক খাতে এই অনিশ্চয়তা দেশের বিনিয়োগ পরিবেশকেও প্রভাবিত করে। পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে ওঠায় নির্বাচন কমিশন স্থানীয় সরকার নির্বাচনের স্বচ্ছতা বজায় রাখতে নতুন আচরণবিধি প্রকাশ করে, যাতে রাজনৈতিক প্রভাব খাটানো, অর্থের অপব্যবহার এবং জাল ভোট রোধে কড়া নির্দেশনা অন্তর্ভুক্ত থাকে। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ সরকারি ওয়েবসাইট, জাতীয় ডেটা সেন্টার এবং গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোর সাইবার নিরাপত্তা বাড়াতে বিদেশী বিশেষজ্ঞ নিয়োগ করে—কারণ আগস্ট মাসেই তিনটি গুরুত্বপূর্ণ সরকারি সার্ভারে DDoS আক্রমণের চেষ্টা ধরা পড়েছিল।
অবকাঠামো উন্নয়নে আগস্ট ছিল ব্যস্ততম মাস। পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পের দ্বিতীয় ধাপ—ভাঙ্গা থেকে যশোর—দ্রুত শেষ করার লক্ষ্যে নতুন ঠিকাদার ও পরামর্শকদের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। রাজউক ঢাকার যানজট কমাতে দুটি নতুন ফ্লাইওভার প্রকল্প অনুমোদন করে, যা উত্তর–দক্ষিণ ও পূর্ব–পশ্চিম গতিপথকে সহজ করবে। একই মাসে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় রেকর্ড ১ লাখ ২০ হাজার শ্রমিক বিদেশে প্রেরণ করে, যা রেমিট্যান্স প্রবাহে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের জন্য সরকার ৫০০ কোটি টাকার ক্ষতিপূরণ প্যাকেজ ঘোষণা করে, যার মধ্যে বীজ, সেচ, সার ও পুনর্বাসন সহায়তা অন্তর্ভুক্ত ছিল।
আগস্ট ২০ তারিখে বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখতে সরকার চাল, ডাল, ভোজ্যতেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহ বাড়ায় এবং মজুতদারদের বিরুদ্ধে কঠোর অভিযান শুরু করে। এই অভিযানেই ১৫০টির বেশি গুদামে অবৈধ মজুত ধরা পড়ে। উচ্চশিক্ষায় সুবিধাবঞ্চিত শিক্ষার্থীদের জন্য সরকার ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে সহজ শর্তে শিক্ষাঋণ চালু করে, যা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া সত্ত্বেও আর্থিক সংকটে পড়া হাজারো শিক্ষার্থীর জন্য স্বস্তি বয়ে আনে। গ্রামীণ জনপদের উন্নয়ন নিশ্চিত করতে স্থানীয় সরকার কাঠামো সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়—যেখানে ইউনিয়ন পরিষদের আর্থিক ক্ষমতা বাড়ানো, ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে সেবার স্বচ্ছতা এবং নারী প্রতিনিধিদের ক্ষমতায়নের ওপর জোর দেওয়া হয়। মাসের শেষদিকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পুলিশ প্রশাসনে সংস্কার ও জবাবদিহিতা বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দেন, যার মধ্যে ছিল থানায় হয়রানি কমানো, ডিজিটাল অভিযোগ ব্যবস্থা সম্প্রসারণ এবং জেলা পর্যায়ে নজরদারি বাড়ানো।অগাস্টের এই অস্থিরতার মধ্যেও দেশের বিভিন্ন খাতে সংস্কার, উন্নয়ন ও প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপগুলো ভবিষ্যতের জন্য একটি নতুন দিকনির্দেশনা তৈরি করে—সংকট থেকে শিখে এগিয়ে যাওয়ার এক দৃঢ় প্রত্যয়ের মাস হিসেবে আগস্ট ২০২৫ ইতিহাসে স্থান করে নেয়।
সেপ্টেম্বরের উন্নয়ন, সংকট-পরবর্তী পুনরুদ্ধার, ও পরিবর্তনের নতুন অধ্যায়
সেপ্টেম্বর ২০২৫ বাংলাদেশে এক বহুমাত্রিক রূপান্তরের মাস হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে—এমন একটি সময় যখন বিদ্যুৎ, কৃষি, মানবসম্পদ, শিক্ষাব্যবস্থা, প্রযুক্তি, পরিবেশ ও প্রশাসনিক সুশাসনে দৃশ্যমান অগ্রগতি একই স্রোতে মিলিত হয়। সেপ্টেম্বর মাসে বিদ্যুৎ উৎপাদনে নতুন রেকর্ড হলো।মাসের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা ছিল ১৫ সেপ্টেম্বর, যখন কয়লা সরবরাহ স্বাভাবিক হওয়ায় প্রায় ১৬,০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের নতুন রেকর্ড তৈরি হয়, যা দীর্ঘ কয়েক মাসের লোডশেডিং-জনিত জনদুর্ভোগকে উল্লেখযোগ্যভাবে লাঘব করে।
শিল্পাঞ্চলগুলো, বিশেষ করে গার্মেন্টস সেক্টর, আবার দ্রুত গতিতে স্বাভাবিক ছন্দ ফিরে পায়। একই সময়ে, পোশাক শিল্পে নারী শ্রমিকদের নিরাপত্তা, মাতৃত্বকালীন সুবিধা ও কর্মক্ষেত্রের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করতে বিজিএমইএ কঠোর নীতিমালা জারি করে—যা দেশের শ্রমনীতি ও নারীর ক্ষমতায়নকে আরও এগিয়ে নেয়।
১৫ সেপ্টেম্বর রেলমন্ত্রী দেশের রেলসেবাকে আধুনিক, স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক করতে ২০ দফা কর্মপরিকল্পনা ঘোষণা করেন, যা দীর্ঘদিনের দুর্নীতি, বিলম্ব ও সেবাহীনতার অভিযোগ থেকে বেরিয়ে আসার এক চেষ্টা। একই সঙ্গে সরকার বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের জন্য আংশিক কৃষিঋণ মওকুফ ঘোষণা করে, যা হাজারো ছোট কৃষকের জন্য পুনরুজ্জীবনের শ্বাস এনে দেয়। বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশের শ্রমিকদের কল্যাণ নিশ্চিত করতে গঠিত ৫০০ কোটি টাকার তহবিল প্রবাসী আয়ের নিরাপত্তা, দক্ষতা উন্নয়ন এবং সংকটকালীন সহায়তায় নতুন সম্ভাবনা তৈরি করে।
এদিকে শিক্ষাব্যবস্থায় একটি বড় পরিবর্তন আসে মাধ্যমিক স্তরে ‘জলবায়ু শিক্ষা’ বাধ্যতামূলক করার মাধ্যমে, যা আগামী প্রজন্মকে পরিবেশ-সচেতন, বৈশ্বিক দায়িত্ব সম্পর্কে সম্পৃক্ত এবং টেকসই উন্নয়নমুখী করে তুলতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। পাশাপাশি এইচএসসি পরীক্ষায় ৮৯ শতাংশ পাসের হার শিক্ষাব্যবস্থায় কিছু ইতিবাচক দিকের প্রতিফলন ঘটায়, যদিও শিক্ষার মান, শৃঙ্খলা, ভাষা ও গণিতের দক্ষতা নিয়ে সমালোচনা ও ভবিষ্যৎ উদ্বেগ থেকেই যায়।অর্থনৈতিক সুশাসন নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ ব্যাংক ঋণ বিতরণে অনিয়মের বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপ নেয়, আর ভূমি মন্ত্রণালয় অনলাইন ভূমি রেকর্ডিং সিস্টেম চালু করে নাগরিক ভোগান্তি কমাতে। গ্রামাঞ্চলে ৫০০০ গ্রামে উচ্চগতির ইন্টারনেট সম্প্রসারণ প্রকল্প ডিজিটাল অসমতা কমিয়ে তথ্য-প্রযুক্তিভিত্তিক অর্থনীতির ভিত আরও দৃঢ় করে। পরিবেশ অধিদপ্তর শিল্পদূষণ নিয়ন্ত্রণে অত্যাধুনিক মনিটরিং সিস্টেম চালু করে এবং ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ নতুন ট্রাফিক আইন কঠোরভাবে প্রয়োগ শুরু করে যানজট কমানোর উদ্দেশ্যে।
সেপ্টেম্বরের শেষভাগে, ২৫ তারিখে সরকার সুন্দরবন ও কক্সবাজারকেন্দ্রিক নতুন অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিদেশি পর্যটন বিনিয়োগ আকর্ষণের উদ্যোগ নেয়, যা পরিচ্ছন্ন পর্যটন ও পরিবেশবান্ধব অর্থনীতি গঠনে বড় ভূমিকা রাখতে পারে। ৩০ সেপ্টেম্বর দেশের ৫০টি পৌরসভা ও সিটি কর্পোরেশনের উন্নয়ন প্রকল্প অনুমোদিত হয়, যা নগর সেবা, অবকাঠামো, পরিবেশ ও স্থানীয় শাসনের উন্নয়নে দীর্ঘমেয়াদী পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়।সব মিলিয়ে সেপ্টেম্বর ২০২৫ ছিল পুনরুদ্ধার, সংস্কার এবং ভবিষ্যৎ-অভিমুখী নীতি-অর্জনের এক ব্যতিক্রমী মাস—যেখানে উন্নয়ন, দক্ষ ব্যবস্থাপনা এবং গণমানুষের প্রত্যাশার প্রতিধ্বনি একসঙ্গে মিলেমিশে বাংলাদেশের আগামীর পথরেখা আরও পরিষ্কার করে দেয়।
ভূমি মন্ত্রণালয় ভূমি সেবা গ্রহণে মানুষের ভোগান্তি কমাতে অনলাইন ভূমি রেকর্ডিং ব্যবস্থা চালু করে। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (DMP) যানজট নিয়ন্ত্রণে নতুন ও কঠোর ট্রাফিক আইন প্রয়োগ করে। সেপ্টেম্বর ২৫ তারিখে সরকার সুন্দরবন ও কক্সবাজারকে ঘিরে তৈরি হওয়া নতুন অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিদেশী পর্যটন কোম্পানিগুলোর বিনিয়োগের আহ্বান জানায়। সেপ্টেম্বর ৩০ তারিখে এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ হয়, পাসের হার ছিল ৮৯ শতাংশ। সবশেষে, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় দেশের ৫০টি পৌরসভা ও সিটি কর্পোরেশনের উন্নয়নের জন্য নতুন প্রকল্প অনুমোদন করে।
অক্টোবর অর্থনীতি, অবকাঠামো ও সামাজিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি
অক্টোবর মাসে অর্থনীতিতে কিছুটা সুবাতাস এলো। পোশাক, চামড়া এবং কৃষিপণ্যের রপ্তানি বৃদ্ধির ফলে রপ্তানি আয়ে ১৮ শতাংশ রেকর্ড প্রবৃদ্ধি অর্জিত হলো। অক্টোবর ২০ তারিখে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র কর্তৃক চট্টগ্রাম এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের একটি বড় অংশ আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হলো। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় গ্রামীণ হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসকদের ধরে রাখতে বিশেষ বেতন বৃদ্ধি ও প্রণোদনা ঘোষণা করে। কঠোর আমদানি নিয়ন্ত্রণ এবং রেমিট্যান্সের উন্নতির ফলে বাংলাদেশ ব্যাংক ঘোষণা করে যে ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্য কিছুটা স্থিতিশীল হয়েছে। আইসিটি মন্ত্রণালয় দেশের প্রযুক্তিখাতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহারের জন্য একটি প্রাথমিক নীতি (AI Policy) প্রকাশ করে, যা তরুণ উদ্ভাবকদের জন্য নতুন দিগন্ত উন্মোচন করলো।
অক্টোবর ২৫ তারিখে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (BGB) এবং মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর যৌথভাবে সীমান্তে মাদক চোরাচালান রোধে কঠোর অভিযান শুরু করে, যা যুব সমাজকে রক্ষা করার একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের তথ্যমতে, শিক্ষক-ছাত্র অনুপাত (Teacher-Student Ratio) উন্নত হয়ে ১:৩৫ এ পৌঁছায়। অক্টোবর শেষে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সামান্য বৃদ্ধি পেয়ে $২৯ বিলিয়ন অতিক্রম করে। সরকার কক্সবাজারের পর্যটন শিল্পের উন্নয়নে ২০০০ কোটি টাকার নতুন মাস্টার প্ল্যান অনুমোদন করে। বেসরকারি সংস্থা এবং সিটি কর্পোরেশন বস্তিবাসীদের শিশুদের জন্য বিশেষ শিক্ষা সহায়তা কর্মসূচি চালু করে। জ্বালানি মন্ত্রণালয় বঙ্গোপসাগরে নতুন গ্যাস ব্লক অনুসন্ধানের জন্য বিদেশী কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করে। প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় বিদেশে চাকরির জন্য যাওয়া শ্রমিকদের হয়রানি রোধে আইনি সহায়তা কেন্দ্র চালু করে। সরকার শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার সহজ করতে শ্রম অধিকার আইন সংশোধন করে। পরিবেশ অধিদপ্তর শিল্প কারখানা থেকে নদীতে বর্জ্য ফেলা নিয়ন্ত্রণে নতুন ও কঠোর বিধিমালা জারি করে। সবশেষে, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বর্ষা পরবর্তী সময়ে ডায়রিয়া ও ডেঙ্গু রোগের প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণে রাখতে বিশেষ পদক্ষেপ নেয়।
অক্টোবর ২০২৫–এ Bangladesh Purchasing Managers' Index (PMI) ৬১.৮‑তে গিয়ে পৌঁছেছে — যা নির্দেশ করে যে কৃষি, উৎপাদন, নির্মাণ ও সেবা খাতে সামগ্রিক অর্থনৈতিক সম্প্রসারণ গতিশীল ছিল। অর্থাৎ, শুধু রপ্তানি‑রেমিট্যান্স নয়, অভ্যন্তরীণ উৎপাদন‑বাজারও বিশেষ উন্নয়নের মুখ দেখেছে, যা অর্থনীতির বিভিন্ন স্তরের অবস্থানকে মোটামুটি শিথিল ও প্রাণবন্ত রাখতে সহায়তা করছে।
নভেম্বর অর্জন, স্থিতিশীলতা ও জাতীয় আত্মবিশ্বাসের মাস
নভেম্বরের ছিল প্রাপ্তি ও আশার মাস। নভেম্বর ১৫ তারিখে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন ঘোষণা করেন, জাতিসংঘে বাংলাদেশের উন্নয়ন মডেল 'বাংলাদেশ মডেল' হিসেবে স্বীকৃতি পায়। এই স্বীকৃতি যেন আমাদের দীর্ঘ সংগ্রামের ফল এবং বৈশ্বিক মঞ্চে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করলো। কৃষি মন্ত্রণালয় জানালো, ধান, মাছ ও সবজি উৎপাদনে বাংলাদেশ এশিয়ায় শীর্ষ ৩টি দেশের মধ্যে স্থান করে নেয়, যা খাদ্য নিরাপত্তা শক্তিশালী করলো। এই মাসে সামাজিক ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরে আসে। সরকার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের জন্য আন্তর্জাতিক মানের প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তিগত দক্ষতা উন্নয়নের প্রকল্প হাতে নেয়। নভেম্বর ১ তারিখে শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রায় ৫০ হাজার নতুন শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক সংকট নিরসনে পদক্ষেপ নেয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যাংকিং খাতে সাইবার আক্রমণের ঝুঁকি মোকাবিলায় বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা চালু করে।
নভেম্বর ১০ তারিখে পরিবেশ দূষণের অপরাধে সর্বোচ্চ ১০ বছরের শাস্তির বিধান রেখে সরকার নতুন কঠোর পরিবেশ আইন পাশ করে। কয়লা সরবরাহ স্বাভাবিক হওয়ায় বিদ্যুৎকেন্দ্রেগুলোতে উৎপাদন বাড়ে, ফলে লোডশেডিং পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়। সরকার ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে নারী উদ্যোক্তাদের জন্য সহজ শর্তে ঋণ সুবিধা চালু করে।
এই মাসে সরাসরি বিদেশী বিনিয়োগ (FDI) গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ১৫ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। শিক্ষা মন্ত্রণালয় আগামী অর্থবছরে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ ২০ শতাংশ বৃদ্ধি করার জন্য পরিকল্পনা কমিশনে প্রস্তাব জমা দেয়। নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয় দেশের প্রধান ১০টি নদীর নাব্যতা রক্ষার জন্য বড় আকারের খনন প্রকল্প শুরু করে। বাংলাদেশ বিমসটেক (BIMSTEC) এবং ডি-8 (D-8) এর মতো আঞ্চলিক সংস্থাগুলোতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। পাসপোর্ট এবং জাতীয় পরিচয়পত্রের (NID) পরিষেবা আরও দ্রুত ও সহজলভ্য করার জন্য নতুন কেন্দ্র চালু করা হয়। সবশেষে, সরকার স্বাস্থ্যখাতে গবেষণা ও উন্নয়নের জন্য বিশেষ ৫ বছরের রোডম্যাপ প্রকাশ করে।
২০২৫ সালের এই জটিল বছরটি আমাদের অর্থনৈতিক যাত্রার একটি সন্ধিক্ষণ। ২০১৫ সাল থেকে আমাদের যাত্রা শুরু হয়েছিল উন্নয়নের স্বপ্ন নিয়ে, কিন্তু ২০২৫ সাল আমাদের সামনে এনে দাঁড় করিয়েছে চ্যালেঞ্জের পর্বত। এই যাত্রার প্রতিটি ধাপ এখন আমাদের বিবেচনার বিষয়।চলুন, সেই পরিসংখ্যানের দিকে চোখ রাখা যাক, যা আমাদের অর্থনৈতিক ইতিহাসের কঠিন সত্যকে তুলে ধরে। ২০১৫ সালে যখন বাংলাদেশ উন্নয়নের সিঁড়িতে পা রেখেছিল, তখন বার্ষিক জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৬.৫ শতাংশ। সেই সময় মূল্যস্ফীতি ছিল ৬.০ শতাংশ এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ২৫ বিলিয়ন ডলার। এই আপাত স্থিতিশীলতার নিচে লুকিয়ে ছিল ব্যাংকিং খাতের দুর্বলতা, যেখানে মোট ঋণের ১০.৫ শতাংশই ছিল খেলাপি ঋণ। বৈশ্বিক মানদণ্ডেও আমাদের মানব উন্নয়ন সূচক (HDI Ranking) ছিল ১৩৯তম—যা এক সম্ভাবনাময় জাতির জন্য মোটেও সন্তোষজনক ছিল না।
এরপর ২০২০ সালে এসে প্রবৃদ্ধির গতি কমে যায়, জিডিপি দাঁড়ায় মাত্র ৩.৪ শতাংশে, কিন্তু রিজার্ভ বেড়ে ৩২ বিলিয়ন ডলার হয়। কিন্তু এই আপাত সাফল্যের আড়ালে খেলাপি ঋণের অনুপাত বেড়ে ১২.৫ শতাংশ হয়, যা ইঙ্গিত দেয় আর্থিক খাতে রোগের প্রকোপ বাড়ছে। কিন্তু ২০২৫ সালে এসে চিত্রটি আরও ভয়াবহ হয়। এই বছর জিডিপি প্রবৃদ্ধি কিছুটা বেড়ে ৫.০ শতাংশ হলেও, মূল্যস্ফীতি প্রায় দ্বিগুণ হয়ে ৯.৫ শতাংশে পৌঁছে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা দুর্বিষহ করে তোলে। এই উচ্চ মূল্যস্ফীতি যেন দরিদ্র মানুষের পকেটে আগুন ধরিয়ে দেয়। সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো, ঋণ খেলাপি অনুপাত আরও বেড়ে ১৪.৫ শতাংশে পৌঁছায় এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে ২৯ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে। এই পরিসংখ্যান কেবল সংখ্যা নয়, এটি আমাদের ব্যাংক ব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থার সংকট এবং সুশাসনের অভাবের করুণ দলিল। এই চরম বাস্তবতার মধ্যেও, আমাদের মানব উন্নয়ন সূচক কিছুটা উন্নত হয়ে ১৩০তম স্থানে পৌঁছায়—যা প্রমাণ করে সামাজিক সূচকে আমরা এগোচ্ছি, কিন্তু অর্থনৈতিক অস্থিরতা সেই অর্জনকে ম্লান করে দিচ্ছে।
যদি এই কঠিন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা যায়, তবে ২০৩০ সালের দিকে আমাদের লক্ষ্য হলো জিডিপি প্রবৃদ্ধিকে ৭.৫ শতাংশে নিয়ে যাওয়া এবং মূল্যস্ফীতিকে ৬.০ শতাংশে নামিয়ে আনা। কিন্তু এটি তখনই সম্ভব হবে যখন খেলাপি ঋণের অনুপাতকে ৮.০ শতাংশে নামিয়ে আনা যাবে এবং রিজার্ভকে ৪০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করা যাবে। এর পরবর্তী ধাপ, ২০৩৫ সাল নাগাদ, আমরা ৮.০ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি এবং ৫.০ শতাংশ মূল্যস্ফীতির স্বপ্ন দেখি, যেখানে খেলাপি ঋণ কমিয়ে ৫.০ শতাংশে নামিয়ে আনতে হবে।
আমাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো ২০৪০ সাল। এই সময়ের মধ্যে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হবে ৮.৫ শতাংশ, মূল্যস্ফীতি ৪.৫ শতাংশে স্থিতিশীল থাকবে। সবচেয়ে বড় কথা, যদি খেলাপি ঋণের অনুপাত ৩.০ শতাংশে নামিয়ে আনা যায়, তবে রিজার্ভ ৬০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে এবং মানব উন্নয়ন সূচক আমাদের ১১০তম স্থানে পৌঁছে দেবে। এই পরিসংখ্যানের দিকে তাকালে একটি কঠিন সত্য স্পষ্ট হয়: আমাদের অর্থনৈতিক মুক্তি কেবল প্রবৃদ্ধির হার নয়, এটি সুশাসনেরও প্রতিচ্ছবি। ২০২৫ সালের শিক্ষা হলো, কেবল স্বপ্ন দেখলেই হবে না; সেই স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করার জন্য দুর্নীতির শিকল ভাঙতে হবে, না হলে ২০৪০ সালের সোনালী লক্ষ্য কেবল কাগজে-কলমেই থেকে যাবে।
অনিশ্চয়তা, অর্থনৈতিক চাপ ও কৌশলগত রূপান্তরের সন্ধিক্ষণ
ডিসেম্বরের ২০২৫ বাংলাদেশের জন্য ছিল অনিশ্চয়তা ও আশা একসাথে বয়ে আনা মাস। Asian Development Bank (ADB) এই মাসে পূর্বাভাস কমিয়ে জানায়, দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৫.০ থেকে ৪.৭ শতাংশে নেমে এসেছে। রপ্তানি‑রেমিট্যান্স ও অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগের ঘাটতির প্রভাব ইতিমধ্যেই স্পষ্ট; তবে এই চ্যালেঞ্জের মাঝেও সরকার কাঠামোগত সংস্কার, মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, বৈদেশিক রিজার্ভ স্থিতিশীলতা ও ব্যাংকিং খাতে নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধির মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতার পথ প্রস্তুত করছে।বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা যায়, অর্থনীতি কিছুটা পুনরুদ্ধারশীল হলেও বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান ও ব্যাংকিং খাতে এখনও বাকি চ্যালেঞ্জগুলো বিদ্যমান। তবে এই চ্যালেঞ্জগুলোই আমাদের জাতীয় শক্তি ও দৃঢ়তাকে প্রমাণ করে—যেমন কঠিন বাতাসে গাছের শিকড় আরও শক্ত হয়।
একদিকে অর্থনৈতিক চাপ থাকলেও, নারী উদ্যোক্তাদের জন্য বিশেষ বিনিয়োগ উদ্যোগ ও বাধা দূর করার আলোচনায় দেশের সমাজ ও অর্থনীতির সাম্য ও অন্তর্ভুক্তির নতুন দিগন্ত খুলছে। এটি যেন এক ধরনের শান্ত আভাস, যে দেখায় দেশের অর্থনৈতিক নক্ষত্র কেবল বৃদ্ধি নয়, সমানভাবে নৈতিক ও সামাজিক স্বীকৃতির দিকে এগোচ্ছে।ডিসেম্বরের এই কঠিন ও প্রতিশ্রুতিময় প্রেক্ষাপটে স্পষ্ট—২০২৫ সালের শেষ মুহূর্তগুলো আমাদের মনে করিয়ে দিচ্ছে, উন্নয়ন কোনো রূপকথা নয়। এটি দীর্ঘ ও জটিল যুদ্ধ, যেখানে অর্থনীতি, নীতি সংস্কার এবং সামাজিক ন্যায় একসঙ্গে এগিয়ে চলে। আর এই যাত্রায় প্রতিটি পদক্ষেপই আমাদের ভবিষ্যতের জন্য দিশারী।
২০২৫ সালের প্রতিটি ঘটনা আমাদের শেখালো—উন্নয়ন কেবল ইটের পর ইট দিয়ে অবকাঠামো তৈরি করা নয়, এটি হলো মানুষের জীবনকে নিরাপদ, স্থিতিশীল এবং মানবিক করা। আমরা দেখেছি, কীভাবে সামান্য লোডশেডিং শিল্প উৎপাদন কমিয়ে দেয়, কীভাবে 1টি সাইক্লোন মুহূর্তের মধ্যে হাজারো স্বপ্ন ভাসিয়ে নিয়ে যায়, আর কীভাবে সামাজিক অস্থিরতা সাধারণ মানুষের শান্তি কেড়ে নেয়। আমরা দেখেছি, একজন কৃষক তার ফসলের ক্ষতিপূরণ না পেলে তার চোখে জল আসে; আমরা দেখেছি, একজন তরুণ ডিজিটাল অর্থনীতিতে সাফল্য খুঁজে নিলেও তার পরিবার মূল্যস্ফীতির শিকার। আজকের এই বাংলাদেশ, যেখানে অর্থনীতি আর মানবতা হাত ধরাধরি করে চলতে পারে, সেই দেশ গড়ার দায়িত্ব আমাদের সবার। ২০২৫ সালের এই শিক্ষা আমাদের মনে রাখতে হবে। সংকট যখন শিকল পরায়, জাগো তবে সৈনিক, আর কতকাল রবে অন্ধ? ভয় নয়, এবার জিততে শেখো!
সংক্ষিপ্ত জীবনী :
ডঃ তারনিমা ওয়ারদা আন্দালিব, বর্তমানে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে সহকারী অধ্যাপক এবং যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড ইমপ্যাক্ট গ্রুপে গ্লোবাল কনসালট্যান্ট ডিরেক্টর হিসেবে কর্মরত আছেন।
দাউদ ইব্রাহিম হাসান, বর্তমানে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার্স-এর অর্থনীতি বিভাগে অধ্যয়নরত থাকার পাশাপাশি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় একজন রিসার্চ এসিস্ট্যান্ট এবং সেই সাথে আইডিএলসি ফাইন্যান্স পিএলসি-এর মার্কেটিং বিভাগের একজন সদস্য হিসেবে নিয়োজিত আছেন।
সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী আবু জাফর
যোগাযোগ: । [email protected] । বিজ্ঞাপন ও বার্তা সম্পাদক: 01894944220
ঠিকানা: বার্তা ও বাণিজ্যিক যোগাযোগ : বাড়ি নম্বর-২৩৪, খাইরুন্নেসা ম্যানশন, কাঁটাবন, নিউ এলিফ্যান্ট রোড, ঢাকা-১২০৫।
© 2025 Sangbad Sarabela All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh
