পাকিস্তানের স্রষ্টা ছিলেন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ। কিন্তু জনগণ তার ছায়াও মারাতেন না। লিয়াকত আলী, নূরুল আমীন, খাজা নাজিমুদ্দিন, ইস্কান্দার মির্জা এরা সবাই ছিল প্রাসাদ রাজনীতির ভক্ত, জনসাধারণের মধ্যে তাদের কোন ইমেজ ছিল না। অন্যদিকে শেখ মুজিব সাধারণ মানুষের দাবি নিয়ে প্রতিনিয়তই মাঠে নামেন আর গ্রেপ্তার হন। তিনি প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচিত নেতা হয়েও ১৯৫৬ সালের ৪ আগস্ট ভুখা মিছিলের নেতৃত্ব দিতে মাঠে নামলেন। ওই বছরের ৬ ডিসেম্বর আতাউর রহমান খানের শিল্প, বাণিজ্য ও দুর্নীতি দমন মন্ত্রী হন তিনি। শেখ মুজিবুর রহমান রাজনীতি করেছেন অতি সাধারণ মানুষের। যা পাকিস্তানের কোন মুসলিম লীগ নেতার আদর্শে ছিল না।
শেখ মুজিবুর রহমান উনসত্তর-সত্তর সালে এসে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্য থ্রেট হয়ে ওঠেননি, ১৯৫৬ সাল থেকেই পার্লামেন্টে প্রতিবাদী জোরালো কণ্ঠস্বর পাকিস্তানি ভূস্বামী শাসকদের যন্ত্রণার কারণ হয়ে ওঠেন। ১৯৬৬ সালে শেখ মুজিবুর রহমান আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। সভাপতির পদ গ্রহণ করেই তিনি পূর্ব বাংলাকে শোষণ-শাসনের যাঁতাকল থেকে রক্ষা করার জন্য ৬ দফা দাবি পেশ করেন। এই ছয় দফা দাবির মূল ছিল পূর্ব বাংলার স্বায়ত্ত শাসন প্রতিষ্ঠা করা। তিনি পাকিস্তানের লাহোরে সাংবাদিক সম্মেলনে পূর্ব বাংলার ৬ দফা দাবি পেশ করেন।
পাকিস্তান সামরিক শাসক শেখ মুজিবের ৬ দফা দাবিকে বিচ্ছিন্নতাবাদী দাবি হিসেবে উল্লেখ করে, শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগ কর্মী ও নেতাদের উপর দমন-পীড়ন চালায়। রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা দায়ের করে তাকেসহ ৩৫ জনকে জেল হাজতে পুরে। বঙ্গবন্ধু আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার এক নম্বর আসামি। এ সময় দেশে প্রবল উত্তাপ ছড়িয়ে পড়েছে। এ সময় সমগ্র পূর্ব বাংলার জনগণ শেখ মুজিবুর রহমানের পাশে এসে দাঁড়ায়। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় থেকে ছাত্ররা দুর্বার আন্দোলন শুরু করে। ফলে ছাত্র জনতা এক হয়ে শেখ মুজিবের মুক্তির দাবিতে গণ-আন্দোলন শুরু করে। এত ছাত্রনেতা আসাদ, নবকুমার স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্র কিশোর মতিউর রহমান মল্লিকসহ সারাদেশে অসংখ্য মানুষ আত্মহুতি দেয়। এ সময় শেখ মুজিবুর রহমানের সহ-ধর্মিনী শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিব সব সময় শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে তাকে পাকিস্তানি সরকারের কাছে নতজানু না হবার পরামর্শ দিতেন।
বঙ্গমাতাও দেশের মানুষের পালস বুঝতেন। তাই তিনি শেখ মুজিবকে আপসের ব্যাপারে দৃঢ় হতে বলেছিলেন। তিনি পাকিস্তানি সামরিক শাসকের সাজানো গোল টেবিল বৈঠকে যোগ দিতে নিষেধ করেন। বঙ্গমাতার নির্দেশ ছিল তাৎপর্যপূর্ণ।
সেই দিনের ছাত্র-জনতার উত্তাল দাবির মুখে পাকিস্তান সামরিক শাসক ৬৯-এর ২২ মার্চ তাকে নিঃশর্ত মুক্তি দিতে বাধ্য হন। জেল থেকে ছাড়া পেয়ে তিনি হন বঙ্গবন্ধু। রেসকোর্স ময়দানে দশ লাখ লোকের সমাবেশে ছাত্র-জনতা তাঁকে বঙ্গবন্ধু উপাধিতে অভিসিক্ত করেন।
সত্তরের নির্বাচনোত্তর বেশ কিছু ভাষণে আমরা দেখতে পাই, বঙ্গবন্ধু এদেশের জনগণকে সম্ভাব্য এক যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থাকতে বলছেন। ৩০ অক্টোবর ১৯৭০, জয়দেবপুরের জনসভায় বঙ্গবন্ধু বলেন, নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ ৬ দফা কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে চায়। বাংলার মানুষের কল্যাণ এবং মুক্তির জন্যে এটা আমাদের শেষ সংগ্রাম। যদি নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে ছিনিমিনি খেলা হয়-তবে গণ-আন্দোলনের পরিকল্পনা আছে। মূলত সত্তরের নির্বাচনি প্রচারণার সময় থেকেই জনগণকে চূড়ান্ত মুক্তি সংগ্রামের ইঙ্গিত দিতে থাকেন তিনি। সাধারণ নির্বাচন প্রাক্কালে বঙ্গবন্ধুর রেডিও টেলিভিশনের ভাষণটি (২৮ অক্টোবর, ১৯৭০) খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন, সমাজে ক্যানসারের মতো যে দুর্নীতি বিদ্যমান তাকে নির্মূল করতে আমরা দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ। ৯০ লাখ শ্রমিক বেকার। ২৩ বছরে সরকারি চাকরিতে বাঙালির সংখ্যা ১৫ শতাংশ। দেশরক্ষা বাহিনীতে বাঙালির সংখ্যা দশ শতাংশের কম। অত্যাবশ্যকীয় দ্রব্যের মূল্য ৫ থেকে ১০০ ভাগ বেশি। দেশের ৯০ ভাগ মানুষ সামান্যতম চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত। ৬ দফার আলোকে ফেডারেলের মাধ্যমে দেশ পরিচালিত হবে। আমি ক্ষমতার প্রত্যাশী নই, ক্ষমতার চেয়ে জনতার দাবি আদায়ের সংগ্রাম অনেক বড়।
নির্বাচনে জয়লাভের পর ৯ ডিসেম্বর ১৯৭০ বঙ্গবন্ধু ভাষণে বলেন, উপকূলীয় অঞ্চলে ঘূর্ণিঝড়ে ১০ লাখ লোক মারা গেছে এবং বর্তমানে এ অঞ্চলগুলোতে ৩০ লাখ লোক শুধুমাত্র বেঁচে থাকার জন্য মরণপণ সংগ্রামে লিপ্ত রয়েছে। উপকূলীয় অঞ্চলের জনসাধারণের এই অবস্থা আমাদের অতীতের শোষণ ও অবহেলার নিষ্ঠুরতাই স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। আর সেই সঙ্গে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে আমাদের পাহাড় প্রমাণ কর্তব্যকে। ১১ ডিসেম্বর সন্দ্বীপ হাই স্কুল মাঠে ভাষণে বলেন, রিলিফ কর্মকাণ্ডে সংশ্লিষ্টদের স্মরণ রাখা উচিত যে, আইয়ুব খানের দিন শেষ হয়ে গেছে আমরা প্রতিটি পয়সার হিসাব নেব। ১৪ ডিসেম্বর তিনি ইয়াহিয়া খানকে তারবার্তা প্রেরণ করেন, একমাত্র ৬-দফা কর্মসূচির ভিত্তিতেই প্রণীত শাসনতন্ত্রই অঞ্চলে অঞ্চলে ও মানুষে মানুষে সুবিচারের নিশ্চয়তা বিধান করতে পারে। বঙ্গবন্ধুর নির্বাচন উত্তর ও নির্বাচন-পরবর্তী ভাষণগুলো পাঠ করলে সেই সময়কার উত্তপ্ত পরিস্থিতি সম্পর্কে অবগত হওয়া যায়। বঙ্গবন্ধু শাসনতন্ত্র প্রণয়নের ব্যাপারে কোন প্রকার ছাড় দেওয়া বা আপস রফায় রাজি নন এই বিষয়টি পাকিস্তান সামরিক সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোকে পরিষ্কার করেন।
যেমন : ২৮ ফেব্রয়ারি ১৯৭১ তেজগাঁও অঞ্চলে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ, সেখানে তিনি বলেন, ৬ দফার ভিত্তিতেই শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করা হবে। ৬ দফা কর্মসূচি শুধু বাংলার মানুষের জন্য নয়। আমরা সিন্ধু, পাঞ্জাব এবং পশ্চিম পাকিস্তানের অন্য প্রদেশগুলোকেও বাংলাদেশের সমান প্রাদেশিক স্বায়ত্ত শাসন দেওয়ার পক্ষপাতী। তাই পাকিস্তানও থাকবে, বাংলাদেশ, পাঞ্জাব, সিন্ধু, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ আর বেলুচিস্তান থাকবে। যা থাকবে না তা হ”েছ মানুষে মানুষে শোষণ। পাকিস্তান আন্দোলন কেন করেছিলাম -এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি সেদিন বলেছিলেন, উন্নত জীবনের আশাতেই জনগণ সংগ্রাম ও ত্যাগ স্বীকার করেছিল। কিন্তু সব জায়গায় তারা এমনভাবে শোষিত হয়েছে যে, তাদের মেরুদ-ই ভেঙে গেছে। বাংলার মানুষের উদারতার সুযোগ নিয়ে সারা বাংলাদেশকে লুট করা হয়েছে। যাদের ৫ লাখ টাকা ছিল তারা এখন ৫ কোটি টাকার মালিক হয়েছে। এই টাকা আসমান থেকে আসেনি। পাকিস্তানের নামে দরিদ্র জনসাধারণকে সর্বস্বান্ত করে এই পুঁজি সৃষ্টি হয়েছে। ২২ পরিবার টেলিফোনে কোটি কোটি টাকার এলসি খুলে ফেলে আর ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা শতকরা ৪৫ ভাগ টাকা জমা দিয়েও এলসি খোলার জন্য হয়রান হয়।
মূলত পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনের পর সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের কাছে রাষ্ট্রের ক্ষমতা হস্তান্তর এবং সকল দলের সমন্বয়ে একটি সংবিধান রচনা করা ছিলো মূল কাজ। এই কাজ সমাধানের জন্য সময় ছিলো তিন মাস। কিন্তু নির্বাচনের ফলাফলে দেখা যায় আওয়ামী লীগ জাতীয় পরিষদে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা এবং প্রাদেশিক পরিষদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। ফলে পাকিস্তানি সামরিক ও বেসামরিক শাসকগোষ্ঠীর হাতে ক্ষমতা আর থাকছে না, এই বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যায়। তাই স্বাভাবিকভাবেই পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী ও পাকিস্তান পিপলস পার্টির প্রধান পাকিস্তানের শাসন ক্ষমতায় বাঙালির আধিপত্য ঘটবে-এই সহজ সত্যটি মেনে নিতে পারেনি।
বঙ্গবন্ধু বিষয়টি সম্পর্কে সম্পন্ন অবগত ছিলেন। দেশে সংঘাত ঘটতে পারে-এই বদ্ধমূল ধারণা নির্বাচন প্রাক্কাল থেকেই জনগণের মনে গ্রথিত করতে পেরেছিলেন। তাই তিনি ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে পরোক্ষভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন।
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের রাজনৈতিক তাৎপর্র্য হলো ঃ পাকিস্তান অর্থাৎ যে রাষ্ট্রের জন্ম বাঙালির হাত ধরে, সে রাষ্ট্রে বাঙালি হয় শোষিত, নির্যাতিত ও নিপীড়িত। ১৯৪৬-এর নির্বাচনে বাঙালিরা মুসলীম লীগকে ভোট না দিলে পাকিস্তান হতো কিনা সন্দেহ, ক্ষমতা হাতে আসার পর পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকরা শুরু থেকেই বাংলাকে উপনিবেশ বানাতে উঠে পড়ে লেগে গেল, যা শেখ মুজিবুর রহমানকে পাকিস্তান আমলের শুরু থেকেই ক্ষেপিয়ে তোলে। পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী কখনোই গণতন্ত্রমনা ছিলো না। গণতান্ত্রিক শাসন কি তা বুঝতে বা জানতে চায়নি। অবৈধ সামরিক শাসনের মধ্যদিয়ে শ্রেণিস্বার্থ সংরক্ষণে সচেষ্ট হয় তারা। দলন, নিপীড়ন, শোষণ ও নির্যাতনের মধ্য দিয়ে পূর্ব বাংলা শাসন করা তাদের নীতিতে পরিণত হয়েছিলো। শেখ মুজিবুর রহমান, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সাথে কলকাতায় রাজনীতি করেছেন, তাই শোষণের প্রতিটি পর্যায় সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। তিনি পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে কোন ধরনের আপস রফায় যাননি।
শেখ মুজিবুর রহমানের সংগ্রাম ছিল পূর্ব বাংলার মানুষের অর্থনৈতিক উন্নয়ন। যে উন্নয়নের জন্য ১৯৪৬ সালে তিনি নির্বাচনে সাংগঠনিক দায়িত্ব পালন করেছিলেন। ৭ মার্চের ভাষণ ছিলো পাকিস্তান আমলের ২৩ বছরের শাসন শোষণের বিরুদ্ধে সরাসরি পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা ঘোষণা। রাজনীতির নির্যাসই ছিলো বঙ্গবন্ধুর শেষ দুটি লাইন “এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম”।
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী আবু জাফর
যোগাযোগ: । 01894-944220 । [email protected], বিজ্ঞাপন: 01894-944204
ঠিকানা: বার্তা ও বাণিজ্যিক যোগাযোগ : বাড়ি নম্বর-২৩৪, খাইরুন্নেসা ম্যানশন, কাঁটাবন, নিউ এলিফ্যান্ট রোড, ঢাকা-১২০৫।
© 2024 Sangbad Sarabela All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh