অবশেষে স্বাধীনতার দীর্ঘ ৫১ বছর পরে হলেও ‘বীরাঙ্গনা’দের ন্যায় এবার যুদ্ধশিশুদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পাওয়ার ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। এ জন্য ইতোমধ্যে সরকারের কাছে সুপারিশের সিদ্ধান্ত নিয়েছে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা)। পত্রিকান্তে প্রকাশিত খবরের তথ্যমতে, গত ২৪ অক্টোবর পিতার নাম না থাকায় দেশে বসবাসকারী উত্তরাঞ্চলের এক যুদ্ধশিশু নির্বাচন কমিশন (ইসি) থেকে পূর্ণ নাগরিক মর্যাদা তথা জাতীয় পরিচয়পত্র না পাওয়ায় তার আবেদনের প্রেক্ষিতে জামুকার ৮১তম সভায় ওই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
এতে কেবল ওই যুদ্ধশিশু নন, দেশে-বিদেশে বাংলাদেশের যেসব যুদ্ধশিশু রয়েছেন তারা সবাই যাতে জাতীয় পরিচয়পত্রসহ সব ধরণের নাগরিক সুবিধা ভোগ করতে পারেন, সেজন্য সুপারিশ করতেই ঐক্যমত পোষণ করেছেন জামুকার চেয়ারম্যান মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকসহ উপস্থিত সংশ্লিষ্ট সকলেই। অন্যদিকে শিগগিরই মন্ত্রিপরিষদ সচিবসহ সংশ্লিষ্টদের কাছে ওই সুপারিশ পাঠানো হচ্ছে। আর এটির বাস্তবায়ন হলে যুদ্ধশিশুদের জাতীয় পরিচয়পত্র প্রদানসহ অন্য সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হবে।
খবরটি নি:সন্দেহে যুদ্ধশিশুসহ বীরাঙ্গনা ও সংশ্লিষ্ট সকলের জন্য সুখবরই বটে। এটি হতে পারে মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারক-বাহক আওয়ামী লীগ তথা শেখ হাসিনা সরকারের আরও এক যুগান্তকারী রেকর্ডের সূচনাও।
যুদ্ধশিশু; ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নির্যাতনের শিকার হয়ে জন্ম নেওয়া শিশুরাই আমাদের সেই যুদ্ধশিশু। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক গবেষণা সূত্রের তথ্যমতে, ১৯৭২ সালের ১৯ জুলাই ১৫ যুদ্ধশিশুর একটি দল প্রথম কানাডার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ ছেড়ে যায়। আর বর্তমানে প্রায় ১০ হাজার যুদ্ধশিশু প্রবাসে বসবাস করছেন।
এ কথা বলার অবকাশ রাখে না যে, দেশ স্বাধীন করতে গিয়ে অনেকে অনেক ভূমিকা রেখেছেন। তবে সবচেয়ে বেশি কষ্টের মধ্য দিয়ে গেছেন নির্যাতিত মা-বোনেরা। পাকিস্তানি বাহিনীর নির্যাতনের শিকার হয়ে সেই মা-বোনের গর্ভ জন্মে নেওয়া শিশুরা এখনও মুক্তিযুদ্ধের দুঃসহ যন্ত্রণা বয়ে বেড়াচ্ছেন। তাই বাবার নাম না থাকায় সেসব যুদ্ধশিশু জাতীয় পরিচয়পত্র পাননি।
কেবল তাই নয়, ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে ৯ মাসে অর্জিত স্বাধীনতা সংগ্রামের পেছনে আমাদের লাখো বীরাঙ্গনার যে অবদান রয়েছে, সেই বীরাঙ্গনাদেরও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ছিল না নিকট অতীতে। ইতিহাস বলে, যুদ্ধশেষে বিভিন্ন ক্যাম্প থেকে উদ্ধার হন অসংখ্য নির্যাতিত নারী। তাদের একটা বড় অংশ অন্ত:সত্ত্বা হয়ে পড়েন। পরিস্থিতি এমনও হয় যে, রক্ষণশীল পরিবারের অনেকেই বীরাঙ্গনা বা তাদের সন্তানদের গ্রহণ করতে চায়নি। তাদের সন্তানের পিতৃপরিচয়, ভরণ-পোষণ নিয়ে দেখা দেয় জটিলতা। কলংকের বোঝা আর সামাজিক অপবাদ সইতে না পেরে অনেক নারী আত্মহত্যা করেন। আবার অনেকে মানসিকভাবে বিকারগ্রস্ত হয়ে যান। এমন পরিস্থিতিতে স্বাধীনতার পর বীরাঙ্গনাদের পুনর্বাসনে এগিয়ে আসেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি ১৯৭২ সালে প্রতিটি জনসভায় বীরাঙ্গনাদের উদ্দেশ্যে বলেছেন, ‘কেউ যদি বীরাঙ্গনাদের পিতার নাম জিজ্ঞেস করে, তবে বলে দিও- তাদের পিতা শেখ মুজিবুর রহমান। আর তাদের ঠিকানার পাশে লিখে দিও ধানমন্ডি ৩২ নম্বর।’ মুক্তিযুদ্ধের সময় লাঞ্ছিত-নির্যাতিত নারীদের ‘বীরাঙ্গনা’ খেতাব দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুই। তাদের ভরণ-পোষণসহ পুনর্বাসনের ভার রাষ্ট্র নেবে-এ ধরনের প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিলেন তিনি। বঙ্গবন্ধুর উদ্যোগেই তখন কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ডস, সুইডেন ও অস্ট্রেলিয়াসহ কয়েকটি দেশের সামাজিক সংগঠন যুদ্ধশিশুদের পুনর্বাসনে এগিয়ে আসে। কিন্তু এত দিনেও দেশে সেই যুদ্ধশিশুদের হয়নি নাগরিক স্বীকৃতি। ফলে অক্টোপাসের মতো দু:সহ দহন যন্ত্রণাই বয়ে বেড়াচ্ছিলেন সেই যুদ্ধশিশুরা।
তবে আশার কথা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দেওয়া খেতাব বীরাঙ্গনাদের বীর মুক্তিযোদ্ধার মর্যাদায় স্বীকৃতি মিলে তারই সুযোগ্য তনয়া রাষ্ট্রনায়ক দেশরতœ শেখ হাসিনার মেয়াদেই। ১৯৯৬ ও ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন শেখ হাসিনা সরকার কয়েকজন বীরাঙ্গনাকে আর্থিকভাবে সহায়তা দিলেও পরবর্তী মেয়াদে তাদের আর কোন খোঁজ নেওয়া হয়নি। পরবর্তীতে ২০১৫ সালের ২৯ জানুয়ারি সংসদে বীরাঙ্গনাদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। ফলে সেই সব বীরাঙ্গনা রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতিমূলে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ন্যায় পাচ্ছেন সকল সুযোগ-সুবিধা। কিন্তু এতদিনেও যুদ্ধশিশুদের স্বীকৃতির দাবিটি বেমালুম ঝুলেই ছিলো। সেই সাথে ছিলো চরম উপেক্ষিতও। তাই অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণেই এমনটি হয়েছে। নয়তো কি ? দেশ স্বাধীন হয়েছে : কিন্তু আমরা আমলাতন্ত্র থেকে বের হতে পারিনি। যদি তাই না হবে, তবে কেন যুদ্ধশিশুদের জাতীয় পরিচয়পত্র পেতে অপেক্ষা করতে হবে ? যুদ্ধশিশু বা বাবার নাম অজ্ঞাত উল্লেখ করে ওই দীর্ঘ প্রতীক্ষিত সমস্যার কি সমাধান করা যেত না?
যাই হোক, যুগপৎ আমাদের সুখের কথা আর আশার কথা হচ্ছে, স্বাধীনতার দীর্ঘ ৫১ বছর পরে হলেও যেহেতু যুদ্ধশিশুদের নাগরিক স্বীকৃতি ও জাতীয় পরিচয়পত্র প্রদানে জামুকা সরকারের কাছে সুপারিশ করছে, সেহেতু সেই সুপারিশ যেন দ্রুত বাস্তবায়ন হয়, আইনি জটিলতা দেখিয়ে যেন ফের ঝুলে না থাকে সেই সুপারিশ-বীরাঙ্গনাদের মতো যুদ্ধশিশুরাও নাগরিক স্বীকৃতিমূলে যেন পায় সকল সুযোগ-সুবিধা- এমন প্রত্যাশা আমাদের। জয়তু: যুদ্ধশিশু, জয়তু: জামুকা, জয়তু: সরকার প্রধান শেখ হাসিনা।
লেখক: সাংবাদিক, রাজনীতিক ও আইনজীবী, শেরপুর
সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী আবু জাফর
যোগাযোগ: । [email protected] । বিজ্ঞাপন ও বার্তা সম্পাদক: 01894944220
ঠিকানা: বার্তা ও বাণিজ্যিক যোগাযোগ : বাড়ি নম্বর-২৩৪, খাইরুন্নেসা ম্যানশন, কাঁটাবন, নিউ এলিফ্যান্ট রোড, ঢাকা-১২০৫।
© 2025 Sangbad Sarabela All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh