জয়ের বাবা পলাশ তালুকদার পেশায় একজন কাঠমিস্ত্রি। দুই ছেলে ও এক মেয়ের মধ্যে জয় মেজ। দালালের মাধ্যমে বিদেশ যাওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমরা গরীব মানুষ। যে কাম-কাজ করি, তা দিয়া সংসার চলানো খুবই কষ্ট হয়। আমাগো এলাকার ছেলে জামাল। জামালই ইতালিতে নেওয়ার প্রস্তাব দেয়। পরে ওরে বিশ্বাস কইরা ধার দেনা আর জমি বেইচা সাত লাখ টাকা জোগাড় করি। প্রথমে দালালরে ৫০ হাজার দিছি। পরে লিবিয়ায় পৌঁছানোর পরে সাড়ে ছয় লাখ দিছি। এতগুলা টাকা গেল, তবু যদি পোলাডা বাঁইচা থাকত, তাহলে দুঃখ থাকত না। আমাগো সব শ্যাষ হইয়া গেল। এহন আমি কী যে করমু, কিছুই বুঝতে পারতেছি না। আমার পোলার লাশটা যেন পাই। আর কোন আবদার নাই।’
লিবিয়া থেকে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপ যাওয়ার পথে ঠান্ডায় প্রাণ হারিয়েছেন ৭ বাংলাদেশি। তাদের মধ্যে ৫ জনের বাড়ি মাদারীপুরে। বাকি দুজনের বাড়ি কিশোরগঞ্জ ও সুনামগঞ্জে। এর আগেও মাদারীপুরের কমপক্ষে শতাধিক যুবক নিহত ও নিখোঁজ হয়।মাদারীপুরের ৫ জন হলেন- সদর উপজেলার পশ্চিম পিয়ারপুর গ্রামের ইমরান হোসেন, পিয়ারপুর গ্রামের রতন জয় তালুকদার, ঘটকচর গ্রামের সাফায়েত, মোস্তফাপুর গ্রামের জহিরুল এবং সদর উপজেলার বাপ্পী। তাদের পরিবারে চলছে আহাজারি।
সরেজমিন মাদারীপুর সদর উপজেলার পশ্চিম পেয়ারপুর গ্রামের ইমরানের বাড়িতে গিয়ে জানা যায়, গত বছর অক্টোবরে ধার দেনা করে দালাল সামাদের কাছে প্রথম কিস্তিতে ৪ লাখ টাকা দেওয়া হয়। লিবিয়া পৌঁছানোর পর আরও সাড়ে তিন লাখ টাকা দেওয়া হয়। ইমরানের বাবা ভ্যানচালক। বিভিন্ন মানুষের কাছ থেকে সুদে এবং এনজিও থেকে ঋণ করে ছেলেকে ইউরোপের পাঠাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ভাগ্য সহায় হলো না। লিবিয়া থেকে ইতালি যাওয়ার পথে প্রচণ্ড ঠান্ডায় মারা যায় ইমরান।
রতন তালুকদার জয়। স্বপ্ন ছিল বিদেশে গিয়ে চাকরি করে সংসারে সচ্ছ্বলতা আনবেন। সেই উদ্দেশ্যে দালালের মাধ্যমে ইউরোপে যাচ্ছিলেন। নৌকায় করে লিবিয়া থেকে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিচ্ছিলেন। কিন্তু লাশ হতে হলো। জয়ের মৃত্যুর খবরে মাদারীপুরে তার বাড়িতে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। জয় তালুকদারের বাড়ি সদর উপজেলার পেয়ারপুর ইউনিয়নের বড়াইলবাড়ি গ্রামে। বাবা পলাশ তালুকদার জয়ের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছেন।
জয়ের স্বজনরা জানান, দালালের প্রলোভনে পড়ে গত ২৮ নভেম্বর জয় তালুকদার ও তার চাচাতো ভাই প্রদীপ তালুকদার, মিঠু তালুকদার, তন্ময় তালুকদারসহ ছয় তরুণ ইতালিতে যাওয়ার উদ্দেশ্যে মাদারীপুর ছাড়েন। তারা দুবাই হয়ে লিবিয়ায় পৌঁছান। পরে লিবিয়ার একটি বন্দিশালায় প্রায় দেড় মাস থাকেন। গত ২২ জানুয়ারি তাদের সাগরপথে যাত্রা শুরু হয়। গন্তব্য ইতালি। ওই রাতে নৌকা থেকে সাত বাংলাদেশির লাশ উদ্ধার করা হয়। যার মধ্যে মাদারীপুরের জয়ও ছিলেন।
ইমরান হোসেন ও জয় তালুকদার (ডানে)
বড়াইল বাড়ি এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, জয়ের বাড়িতে নীরবতা। ছেলের মৃত্যুর খবর শোনার পর থেকে আহাজারি করছেন মা লক্ষ্মী তালুকদার। ছেলের মুখ দেখার জন্য সবার কাছে আকুতি জানাচ্ছেন। সাগরপথে যাত্রা হওয়ার আগে ২২ জানুয়ারি সকালে জয়ের সঙ্গে তার মায়ের মুঠোফোনে কথা হয়েছিল। ছেলের সঙ্গে সবশেষ বলা কথা স্মরণ করে কেঁদে উঠছেন তিনি। বলছেন, ‘আমার বাজানে মরে নাই। ও কইছে, ইতালি গিয়া ফোন দিব। ওরে একবার ফোন দিতে কও। আমি বাজানের মুখটা একটু দেখতে চাই।’
জয়ের কাকা গোবিন্দ তালুকদার বলেন, ‘আমার ছেলে প্রদীপ, ভাতিজা জয়সহ আমাগো বাড়ির চার ছেলে এই পথে ইতালিতে যায়। ওরা তিনজন কোনোমতে কষ্টে ইতালিতে পৌঁছালেও জয় পথেই মারা গেল। আমরা ছেলে প্রদীপ জয়ের মৃত্যুর সংবাদ আমাগো জানাইছে।’
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, জামাল খান বড়াইলবাড়ি এলাকার সোনা মিয়া খানের ছেলে। ইতালিতে যাওয়ার আশ্বাস দিয়ে প্রতিটি পরিবারের কাছ থেকে জামাল সাত লাখ টাকা করে নেন। জয়ের মৃত্যুর খবরের পর থেকে তিনি এলাকায় নেই। দীর্ঘদিন ধরে জামাল মানবপাচারের সঙ্গে জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে। তার বিরুদ্ধে মাদারীপুর সদর থানায় মানবপাচার আইনে একটি মামলা রয়েছে। এই মামলায় তিনি দীর্ঘদিন জেলে ছিলেন। প্রায় এক বছর আগে তিনি জামিনে মুক্ত হয়ে বের হন। আবার শুরু করেন দালালি পেশা।
মাদারীপুর সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কামরুল ইসলাম মিঞা বলেন, ‘থানায় দালালদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দিতে বলা হয়েছে। অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাইফুদ্দিন গিয়াস বলেন, দূতাবাস থেকে আমাদের সাথে যোগাযোগ করেছে। মৃতদের পরিবারের পক্ষ থেকে তাদের পরিচয় শনাক্ত করতে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র পাঠাতে বলা হয়েছে। মৃতদের পরিবারের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করছি। তারা প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দিলে মরদেহ দেশে আনার ব্যবস্থা করবে সরকার।
সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী আবু জাফর
যোগাযোগ: । [email protected] । বিজ্ঞাপন ও বার্তা সম্পাদক: 01894944220
ঠিকানা: বার্তা ও বাণিজ্যিক যোগাযোগ : বাড়ি নম্বর-২৩৪, খাইরুন্নেসা ম্যানশন, কাঁটাবন, নিউ এলিফ্যান্ট রোড, ঢাকা-১২০৫।
© 2025 Sangbad Sarabela All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh