স্লিপ হাতে নিয়ে স্যালাইনের জন্য প্রায় দুই ঘণ্টা ঘুরেছেন পিরোজপুরের স্বরূপকাঠি উপজেলার বাসিন্দা সাফিয়া বেগম। রাত ১১টার পরে ডেঙ্গু আক্রান্ত মাকে ভর্তি করেন শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ (শেবাচিম) হাসপাতালে। সাথে সাথেই এক হাজার সিসির আইভি স্যালাইন কিনে আনতে হাতে শর্ট স্লিপ ধরিয়ে দেন চিকিৎসক।
রাতে বেশিরভাগ ফার্মেসি বন্ধ থাকায় কোথাও না পেয়ে সবশেষ সদর রোডের একটি ফার্মেসিতে খোঁজ মেলে দুটি স্যালাইনের। ঘড়ির কাঁটায় তখন রাত প্রায় একটা। তখন ৭৮ টাকার স্যালাইন ২০০ টাকা করে দুটি কিনে হাসপাতালে অসুস্থ মায়ের কাছে ফেরেন তিনি।
শুধু সাফিয়াই নন, বর্তমানে এমন ঘটনা নিত্যদিনের। কারণ ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে স্বাভাবিক স্যালাইনের সংকট সৃষ্টি হয়। সংকট এখন চরম আকার ধারণ করেছে। আর এ চিত্র বরিশাল নগরী থেকে শুরু করে দক্ষিণাঞ্চলের সর্বত্র।
সরকারি হাসপাতাল থেকে শুরু করে ফার্মেসি, সব খানেই চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ মিলছে না আইভি স্যালাইনের। ফার্মেসিগুলোতে যা সরবরাহ পাচ্ছেন, তা দিয়ে চলছে সর্বোচ্চ ১-২দিন। এমন পরিস্থিতিতে ফুরিয়ে আসছে সরকারি হাসপাতালের স্যালাইনও। কর্মকর্তারা বলছেন, যে স্যালাইন মজুত আছে, তা দিয়ে সর্বোচ্চ ৪-৫ দিন যাবে।
ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিরা বলছেন, কাঁচামাল সংকটে কোম্পানিতে স্যালাইন উৎপাদন কমে গেছে। এর ফলে চাহিদা অনুযায়ী ফার্মেসিতে সরবরাহ দিতে পারছে না কোম্পানি।
তবে ওষুধ ব্যবসায়ীদের দাবি ভিন্ন। তাদের অভিযোগ, চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় স্যালাইনের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করেছে কোম্পানিগুলো। তাই ওপর ফার্মেসিগুলোতে স্যালাইন সরবরাহের ক্ষেত্রে স্বজনপ্রীতি রয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন বাংলাদেশ কেমিস্ট এন্ড ড্রাগিস্ট সমিতি বরিশালের সভাপতি কাজী মফিজুল ইসলাম কামাল।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ‘শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রতিদিন গড়ে দুই থেকে আড়াই হাজার রোগী ভর্তি হয়ে চিকিৎসা গ্রহণ করছেন। তাদের বেশিরভাগ রোগীর প্রয়োজন হচ্ছে স্যালাইনের।
হাসপাতালটিতে দায়িত্বরত কয়েকজন চিকিৎসক জানিয়েছেন, ‘একজন রোগী হাসপাতালে ভর্তির সাথে সাথে প্রাথমিক চিকিৎসায় তাকে নরমাল স্যালাইন দেয়া হয়। এজন্য নরমাল স্যালাইনের চাহিদা সবসময়ের জন্যই বেশি। তবে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী বৃদ্ধির সাথে সাথে বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এ চাহিদা আরও বেড়ে গেছে।
হাসপাতালের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ১৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত শেবাচিম হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত ৪ হাজার ৪৭০ জন রোগী ভর্তি হয়ে চিকিৎসা গ্রহণ করেছেন। এর মধ্যে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন ৪ হাজার ১৮৯ জন। মৃত্যুবরণ করেছেন ৪৮ জন। বর্তমানে ভর্তি থেকে চিকিৎসা গ্রহণ করছেন এক হাজার ২২৫ জন রোগী। সবশেষ গত ২৪ ঘণ্টায় এ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আরও একজন রোগীর মৃত্যু হয়েছে। একই সময় বরিশাল বিভাগে মোট ৩ জনের মৃত্যু হয়। এ নিয়ে বিভাগে মৃতর সংখ্যা ৭৫ জনে দাঁড়িয়েছে। তাছাড়া মোট আক্রান্তের সংখ্যা ১৯ হাজার ৬৩৪ জন।
চিকিৎসকদের মতে, ‘ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসায় স্যালাইন বাধ্যতামূলক। নিয়ম অনুযায়ী ভর্তি রোগীদের স্যালাইন সরবরাহ করবে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। প্রতিটি ভর্তি রোগীর জন্য চাহিদা অনুযায়ী স্যালাইন বরাদ্দও থাকে। তবে বাস্তবে বরাদ্দ অনুযায়ী স্যালাইন না পাওয়ার অভিযোগ অধিকাংশ রোগীর। সরকারি বরাদ্দের পরেও বাহির থেকে স্যালাইন কিনে আনতে হয় অনেকের।
তাছাড়া দুপুরের পরে ভর্তি হওয়া রোগীরা সরকারি স্যালাইন পাচ্ছেন না। ভর্তির পরদিন স্যালাইন থেকে সরকারি স্যালাইন পান তারা। যে কারণে ভর্তির পর পরই বাইরে থেকে স্যালাইন কিনতে হয় রোগী বা তাদের স্বজনদের। কিন্তু বর্তমানে স্যালাইনের মজুদ ফুরিয়ে আসায় অনেকটা কিছুটা চিন্তার ভাঁজ পড়েছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কপালে।
শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল পরিচালক ডা. এইচএম সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘বর্তমানে সারা দেশেই স্যালাইনের সংকট। বরিশাল মেডিকেলেও একই অবস্থা। প্রতিদিন যে সংখ্যক রোগী আসছে, এতে স্যালাইনের চাহিদাও বাড়ছে। আমাদের যা মজুদ আছে তা দিয়ে সর্বোচ্চ ৫-৬ পর্যন্ত চালিয়ে নেয়া যাবে। বিষয়টি নিয়ে রোববার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ভার্চুয়াল মিটিং হয়েছে। দুই-একদিনের আমরা স্যালাইন পেয়ে যাবো।
এদিকে ওষুধ ফার্মেসি থেকে জানা গেছে, বর্তমানে বাজারে দুই লিটার থেকে সর্বনিম্ন ১০০ মিলি লিটারের সাধারণ স্যালাইন পাওয়া যাচ্ছে। এর মধ্যে এক লিটার, আধা লিটারের স্যালাইনের চাহিদা বেশি। এক লিটার বা এক হাজার সিসির স্যালাইনের খুচরা বিক্রয় মূল্য ৮৭ টাকা, দুই হাজার সিসি ১১৭ টাকা, ৫০০ সিসি ৬৭ টাকা ও আড়াইশ সিসি ৪৭ টাকায়। তবে চাহিদা বেশি এবং সরবরাহ কম থাকায় শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এলাকায় হাজার বা পাঁচশত সিসির স্যালাইনে সর্বনিম্ন ৫০ থেকে সর্বোচ্চ দেড়শত টাকা পর্যন্ত বাড়তি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে কিছু অসাধু ব্যবসায়ীরা।
সম্প্রতি বিষয়টি নিয়ে ব্যবসায়ীদের শতর্ক করে চিঠি দিয়ে বরিশাল কেমিস্ট এন্ড ড্রাগিস্ট সমিতি। তারা ফার্মেসি মালিকদের জানিয়ে দিয়েছে, বাড়তি দামে ওষুধ বিক্রি করে আইনি ঝামেলা পোহালে তার দায়ভার সমিতি গ্রহণ করবে না।
শেবাচিম হাসপাতালের সামনের ওষুধ ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান হাওলাদার মেডিকেলের সত্ত্বাধিকারী খলিলুর রহমান জানিয়েছেন, ‘বর্তমানে স্যালাইনের সরবরাহ কম। সবশেষ আমি গত প্রায় মাসখানেক আগে কোম্পানি থেকে স্যালাইন পেয়েছি। স্যালাইনের জন্য কোম্পানির লোকেদের চাপ সৃষ্টি করা হয়েছে। কিন্তু কোনভাবেই তারা স্যালাইন দিতে পারছে না। কোম্পানি উৎপাদন কমে যাওয়ায় তারা স্যালাইন সরবরাহ করতে পারছে না বলে জানান এই ব্যবসায়ী।
অপরদিকে, বান্দ রোডের ওষুধ ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান আরিশফা ফার্মেসির সত্ত্বাধিকারী শালিক বলেন, ‘বর্তমানে স্যালাইনের চরম সংকট চলছে। কিছুদিন আগে একটি কোম্পানি ৪-৫টি স্যালাইন দিয়েছে। যা মুহূর্তেই শেষ। গত তিন-চারদিন হলো আমার ফার্মেসিতে স্যালাইন নেই। কোম্পানিকে বহুবার বলেছি, কিন্তু কোন লাভ হচ্ছে না।
বাংলাদেশ কেমিস্ট এন্ড ড্রাগিস্ট সমিতি বরিশালের সভাপতি কাজী মফিজুল ইসলাম বলেন, ‘বর্তমানে স্যালাইনের চাহিদা বেশি। কিন্তু সে অনুযায়ী কোম্পানি সরবরাহ দিচ্ছে না। তার মতে কোম্পানিগুলো স্যালাইনের কৃত্রিম সংকট তৈরি করে রেখেছে।
তিনি বলেন, ‘কোম্পানি সব ব্যবসায়ীকে সমানভাবে স্যালাইন সরবরাহ করছে না। এ ক্ষেত্রে তারা স্বজনপ্রীতি করছে। যেই ব্যবসায়ীর সাথে ভালো সম্পর্ক তাকে বেশি বেশি স্যালাইন সরবরাহ দিচ্ছে। এতে অন্য ব্যবসায়ীরা স্যালাইন সরবরাহ পাচ্ছে না। কোম্পানিগুলো যদি সমানভাবে ফার্মেসিগুলোতে স্যালাইন সরবরাহ করতো তবে এতোটা সংকট সৃষ্টি হতো না। এমনকি চাইলেই কেউ বেশি দামেও বিক্রি করতে পারতো না।
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর বরিশাল বিভাগীয় কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক ইন্দ্রানি দাস বলেন, ‘স্যালাইনের সংকট শুধু বরিশালে নয়, এটা এখন সারা দেশের সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ সংকট দূর করার কাজ আমাদের নয়। আমরা দেখছি সংকটের মধ্যে কেউ বাড়তি দামে ওষুধ বিক্রি করছে কিনা। এ নিয়ে গত প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে আমাদের মনিটরিং চলছে। এখন পর্যন্ত বেশি দামে স্যালাইন বিক্রির প্রমাণ মেলেনি। আমরা আমাদের মতো করে নিজেদের লোক পাঠিয়ে দেখেছি। তবে ভুক্তভোগী কেউ অভিযোগ করে আমরা তাৎক্ষণিকভাবে ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।
সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী আবু জাফর
যোগাযোগ: । [email protected] । বিজ্ঞাপন ও বার্তা সম্পাদক: 01894944220
ঠিকানা: বার্তা ও বাণিজ্যিক যোগাযোগ : বাড়ি নম্বর-২৩৪, খাইরুন্নেসা ম্যানশন, কাঁটাবন, নিউ এলিফ্যান্ট রোড, ঢাকা-১২০৫।
© 2025 Sangbad Sarabela All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh