আজ ৮ মার্চ, বিশ্বনারী দিবস। পৃথিবীর সকল নারীর জন্য অত্যন্ত সম্মানের দিন, নারীর সাফল্যের স্বীকৃতির দিন। প্রশ্ন জাগতে পারে, বছরের একটি দিন কেন নারীকে উৎসর্গ করা হয়েছে, নরকে নয় কেন! নরকে বাদ দিয়ে তো নারী নয়, নারীকে বাদ দিয়েও নর নয়। পৃথিবীর সকল সৃষ্টির পেছনে আছে নর এবং নারীর সমান অবদান।
একটি নতুন প্রাণ সৃষ্টি থেকে শুরু করে, প্রতিটি সৃষ্টিশীল কাজে নর এবং নারীকে সমানভাবে অংশগ্রহণ করতে হয়। জন্মদাতা পিতা যেমন সত্যি, গর্ভধারীণি মাতাও তেমনই সত্যি। একটি শিশুর বৃদ্ধিতে যেমন স্নেহময় পিতাকে পাশে থাকতে হয়, শিশু ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর থেকে নিজ পায়ে দাঁড়াতে শেখা পর্যন্ত মা'কে পাশে থাকতে হয়। এভাবেই ঈশ্বর এই পৃথিবীর সকল কল্যাণময় কর্মে নর ও নারীর ভূমিকা নির্ধারণ করে দিয়েছেন।
সৃষ্টিকর্তা সৃষ্টি করেছেন এই পৃথিবী, সৃষ্টি করেছেন মানুষ, গাছপালা, পশু-পাখি, ধূলিকণা, সাগর-নদী, পাহাড়-পর্বত। মহান সৃষ্টিকর্তা পৃথিবীর চালিকাশক্তির প্রধান ভূমিকায় রেখেছেন মানুষকে। মানুষ এসেছে নর এবং নারী হয়ে, 'আদম এবং ঈভ' এর রূপ ধরে। আদম এবং ঈভ আমাদের পিতা ও মাতা। পৃথিবীর কোটি কোটি ছেলে-মেয়ে তাঁদের সন্তান। সৃষ্টির আদি থেকেই পৃথিবী নামক গাড়ির চাকা ঘুরছে নর ও নারীর যৌথ প্রচেষ্টায়। আর তাই 'নারী' কবিতায় কবি গেয়েছেন,
“বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি, চির কল্যাণকর
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।”
তবে কেন শুধু নারীদের জন্যই আলাদা করে ‘নারী দিবস’ পালন করা হয়, তার পেছনের ইতিহাস জানতে খুব বেশিদূর যেতে হয় না।
সৃষ্টির কাঠামোতে নর আর নারীকে সমান দক্ষতায় আঁকা হলেও পুরুষশাসিত সমাজ ব্যবস্থায় নারীকে তার প্রাপ্য সম্মান দেয়া হয়নি। সর্ব যুগে পরিবার সমাজ শিক্ষা সংস্কৃতি রাষ্ট্রের সকল কর্মকাণ্ডে বহু নারীর অংশগ্রহণ থাকলেও নারী তার কর্মের যথাযথ স্বীকৃতি পায়নি। নারীর বুদ্ধি বিবেচনা চিন্তা চেতনা ক্ষমতা শক্তির পরিমাপও কেউ করেনি।
পুরুষশাসিত সমাজে ধরে নেয়া হতো, নারীর ভূমিকা শুধুমাত্র সন্তান উৎপাদনে অংশগ্রহণ, সন্তান লালন-পালন এবং সংসার প্রতিপালনেই সীমাবদ্ধ থাকা উচিত। অধিকাংশ নারীর জন্য অনুকূল শিক্ষা ব্যবস্থা ছিলো না, বাইরের পৃথিবীকে জানার কোনো সুযোগ ছিল না।
নারীকে রামায়নের 'লক্ষ্মণ গণ্ডির ভেতর রাখা হয়েছিল। 'লক্ষ্মণ গন্ডী'র ভেতরে থেকেও যে সকল নারী সৃজনশীল কাজ করেছেন, বহু কাল তার কোনো স্বীকৃতি মেলেনি। পুরুষ শাসিত সমাজে শক্তি এবং দক্ষতা বিকাশের পথে এভাবেই নারীকে কোণঠাসা করে রাখা হয়েছিল।
দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে যেমনি আর পেছানোর জায়গা থাকে না, নতুন পথের সন্ধান করতে সামনের দিকে হাঁটতে হয়। ঠিক তেমনিই সমাজে কোণঠাসা নারীদের মধ্যে থেকেই একজন, দু'জন করে নারী সমাজের সকল বাধা অতিক্রম করার চেষ্টা করেছে। নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করায় উদ্যোগী হয়েছে এবং নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করার সংগ্রামে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখার চেষ্টা করেছে।
সেই এক দুজনের একটু একটু চেষ্টা দিনে দিনে নারী অধিকার আদায়ের সংগ্রামে সমগ্র নারী জাতিকে উৎসাহিত করেছে। এভাবেই নারী ‘লক্ষ্মণ গণ্ডি থেকে বের হওয়ার সাহস পেয়েছে, সাহস সঞ্চয় করে নারী ঘর থেকে বেরিয়ে বাইরের দুনিয়ায় পা রেখেছে। সংসারের উন্নয়নের পাশাপাশি সমাজের উন্নয়ণ দেশের উন্নয়নেও নারীর অংশগ্রহণ দিনে দিনে বেড়েছে।
এভাবেই নারীর মনে নিজের অধিকার সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি হয়েছে, সচেতনতা থেকে তৈরি হয়েছে অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন। এই আন্দোলনই নারীকে আজ এতদূর নিয়ে এসেছে। পুরুষ শাসিত সমাজ ব্যবস্থায় নারীর নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে উল্লেখযোগ্য সাফল্য না পেলেও সচেতন নারীর প্রাপ্তির ঝোলায় অর্জন একেবারে কম নয়। সেই অর্জনেরই একটি হচ্ছে, আজকের এই ‘বিশ্ব নারী দিবস’।
দেশের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক উন্নয়নে নারীর অবদানকে স্বীকৃতি দেয়ার জন্য জাতীয়ভাবে নারী দিবস প্রথম উদযাপিত হয়েছিল ১৯০৯ সালের ২৮শে ফেব্রুয়ারি মার্কিন যুক্তরাস্ট্রে। তৎকালীন সোশ্যালিস্ট পার্টি অব আমেরিকা নারীকে তার কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের জন্য সম্মাননা জানাতে দিনটি নির্বাচিত করে। ১৯১০ সালে কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠিতব্য আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলনে ১৭টি দেশ থেকে সম্মেলনে আগত ১০০ জনেরও অধিক ডেলিগেট আন্তর্জাতিক নারী দিবসের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে তাঁদের ইতিবাচক মতামত ব্যক্ত করেন। তাঁদের সকলেই মনে করেছেন, এই দিবসটি উদযাপনের মাধ্যমে নারীর শ্রমের মর্যাদা, পরিবারে এবং পরিবারের বাইরে নারীর ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে।
১৯১১ সালের ১৮ মার্চ অস্ট্রিয়া, ডেনমার্ক, জার্মানী, সুইজারল্যান্ডের এক মিলিয়নের অধিক জনগণ প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালনের পক্ষে মত দেয়। নারীর ভোটাধিকার, কর্মক্ষেত্রে পুরুষ ও নারী শ্রমিকের সমান মজুরি, পুরুষ নারী পেশাজীবিদের মধ্যে সকল প্রকার বৈষম্য দূরীকরণ, কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে লিঙ্গবৈষ্যমের অবসান চাওয়া হয়। মূল দাবি ছিলো, ‘নারী’কে নারী হিসেবে নয়, মানুষ হিসেবে সম্মান দিতে হবে।
কমিউনিস্ট দেশগুলোতে আনতর্জাতিক নারী দিবস যথাযোগ্য মর্যাদায় উদযাপিত হলেও, পৃথিবীর অন্য দেশগুলোতে এর ব্যাপ্তি ছিল না। আমেরিকায় তখনও ২৮শে ফেব্রুয়ারী জাতীয়ভাবে নারী দিবস পালিত হতো। ১৯১৩ সালে রাশিয়ায় আন্তর্জাতিক নারী দিবস উদযাপন কমিটি লক্ষ্য করেন, যে দিনটি জুলিয়ান ক্যালেন্ডারে ২৮ ফেব্রুয়ারি, সেই দিনটিই গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারে ৮ মার্চ হিসেবে চিহ্নিত আছে। সেই বছর থেকেই গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের তারিখ অনুযায়ী বিভিন্ন দেশে ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারীদিবস হিসেবে পালিত হয়ে থাকে।
খুব বেশি দিন আগের কথা নয়। ১৯৭৭ সালে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে সকল সদস্যকে আমন্ত্রণ জানানো হয়, জাতিসংঘের পক্ষ থেকে ৮ মার্চ নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং বিশ্ব শান্তি দিবস হিসেবে স্বীকৃতিদানের জন্য। সেই থেকে ৮ মার্চ বিশ্ব নারী দিবস হিসেবে স্বীকৃতি পায়।
প্রতি বছর ৮ মার্চ পৃথিবীব্যাপী ‘বিশ্ব নারী দিবস’ উদযাপিত হয় ঠিকই, নারী কি সত্যিই সর্বক্ষেত্রে তার অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে? নারী কি সর্ব ক্ষেত্রে তার কাজের স্বীকৃতি পায়? শ্রমের মর্যাদা অথবা শ্রমের মূল্য পায়?
ভারতীয় উপমহাদেশে তো অধিকাংশ চাকরিজীবী নারীকে সংসার সামলে চাকরি করতে হয় এবং মাস শেষে বেতনের টাকা স্বামীর হাতে তুলে দিতে হয়। নিজের উপার্জনের পয়সা নিজের ইচ্ছেছমতো খরচ করার স্বাধীনতা খুব কম নারীর ভাগ্যে জোটে। আর যে নারী বাইরে কাজ করে না, সকাল থেকে রাত অবধি সংসারে শ্রম দেয়, তার শ্রমের কোনো মূল্যায়নই হয় না। তাহলে নারীর সম্মানই থাকলো কই, নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠাই হলো কতটুকু!
নারী পুরুষের সম অধিকার আন্দোলনের উতপত্তি ইউরোপ-আমেরিকায়, বিশ্ব নারীদিবস উদযাপনের স্বীকৃতি আমেরিকা ইউরোপ থেকে পাওয়া গেলেও পশ্চিমা দেশগুলোতে আজও নার্রীা তাদের কর্মের শতভাগ স্বীকৃতি পায় না। পশ্চিমা বিশ্বে সাধারণ পরিবারে বাবা মায়েরা কন্যা সন্তানের চেয়ে পুত্র সন্তান লাভে বেশি খুশি হয়। কর্মক্ষেত্রে নারী পুরুষ একই কাজ করলেও পুরুষ কর্মী মজুরী বেশী পায়। এছাড়াও সমাজে দৃশ্যমান অদৃশ্যমান অনেক ছোটো ছোটো বৈষম্য রয়ে গেছে নারী-পুরুষের চাওয়া আর প্রাপ্তিতে।
খোদ আমেরিকায় আজ পর্যন্ত কোনো নারী যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও দেশের প্রেসিডেন্ট হওয়ার ম্যান্ডেট পান নাই।
অবশ্য আমেরিকা ইউরোপের তুলনায় এশিয়া মহাদেশে রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে নারীরা অনেক এগিয়ে আছে। প্রিয়দর্শিনী ইন্দিরা গান্ধী, মাভৈ শ্রীমতি বন্দরনায়েকে, বেনজীর ভুট্টো থেকে শুরু করে অং সান সুচীর নাম ইতিহাসে লিপিবদ্ধ হয়ে থাকবে। ইতিহাসে নাম থাকবে সোনিয়া গান্ধী, মমতা ব্যানার্জির।
এশিয়ায় নারী নেতৃত্বের এই বিজয় মিছিলে বাংলাদেশ সবার উপরে। আমাদের দেশে গ্রাম থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় কাঠামো পর্যন্ত নারী পেয়েছে সর্বময় ক্ষমতা। ’৯০ সালের গণ অভ্যুত্থান ঘটেছিলো শেখ হাসিনা এবং বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে। এরপর থেকে আজ পর্যন্ত দেশ শাসন করেছেন দুই নারী নেত্রী। তাঁদের একজন যখন প্রধান মন্ত্রীত্ব করেছেন, অপরজন করেছেন বিরোধী দলের নেতৃত্ব। তৃতীয় নারী নেত্রী বেগম রওশন এরশাদ। বাংলাদেশে সংসদ নেতার চেয়ারেও আছেন নারী।
বাংলাদেশের পোশাক শিল্প বৈশ্বিক পোশাক বাজারে শক্ত অবস্থান তৈরি করে নিয়েছে। দেশের পোশাক শিল্পের এই উত্থানে নারী শ্রমিকদের অবদান আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতামূলক শিল্প বাজারে বাংলাদেশকে শক্ত অবস্থান এনে দিয়েছে।
গ্রামের সরল, সহজ গৃহবধূটি যখন ব্যাংক ঋণ নিয়ে হাঁস-মুরগির খামার, মৎস খামার গড়ে তোলেন, নিজের সংসারের আয়-বৃদ্ধিতে প্রত্যক্ষ অবদান রাখেন, সময়মত ব্যাংক ঋণ পরিশোধ করে ঋণদাতাদের আস্থা অর্জন করেন, এর প্রতিটি সাফল্য সামগ্রিকভাবে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের চাকাকে গতিময় করে তোলে।
উজ্জ্বল তারকা নারীর ইতিহাসে আছেন মহান জোতির্বিদ খনা, আছেন বাংলার নারী মুক্তি আন্দোলনের দূত বেগম রোকেয়া, আছেন ব্রিটিশবিরোধী বিপ্লবী প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, আছেন একাত্তরের হাজার হাজার নারী মুক্তিযোদ্ধা, আছেন শহীদ জননী জাহানারা ইমাম, আর আছেন বিশ্বের সফল মহিলা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
এমন সব কৃতী নারীর সন্তান আমরা সবাই। নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার রিলে রেস শুরু করেছিলেন আমাদের পূর্বসূরি কৃতিময়ী নারীরা, তাঁদের অধিকাংশই সামাজিক স্বীকৃতি পাননি। তাতে কি, আমরা তাঁদের দেখানো রিলে রেস ট্র্যাক আজও দৌড়ো”িছ। আমরা পৌঁছুতে না পারলে আমাদের কন্যারা পৌঁছে যাবে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে।
তখন আলাদা করে ‘নারী দিবস’ উদযাপিত হবে না। নর নারীর একত্র সমন্বয়ে হবে তৈরি হবে নতুন সমাজ।
আমাদের পূর্বসুরী নারীদের প্রতি আমাদের আজন্মের শ্রদ্ধা ভালোবাসা কৃতজ্ঞতা। ৮ই মার্চ যথাযোগ্য মর্যাদায় উদযাপিত হোক বিশ্ব নারীদিবস। এবং অদূর ভবিষ্যতে বিশ্ব নারীদিবস নয়, নর-নারী দুয়ে মিলেই উদযাপন করবে 'বিশ্ব নর-নারী দিবস' ।
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী আবু জাফর
যোগাযোগ: । 01894-944220 । [email protected], বিজ্ঞাপন: 01894-944204
ঠিকানা: বার্তা ও বাণিজ্যিক যোগাযোগ : বাড়ি নম্বর-২৩৪, খাইরুন্নেসা ম্যানশন, কাঁটাবন, নিউ এলিফ্যান্ট রোড, ঢাকা-১২০৫।
© 2024 Sangbad Sarabela All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh