ছবিঃ সংগৃহীত
স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় ইউনিয়ন পরিষদ সবচেয়ে বৃহত্তর অনুসঙ্গ। গ্রাম্য পর্যায়ে সরকারের সকল পরিকল্পনার বাস্তবায়নের বড় অংশীদারই হচ্ছে ইউনিয়ন পরিষদ। তবে, সরকারি সম্পদ বিলি বণ্ঠন নিয়ে এদের বিরুদ্ধে রয়েছে এন্তার অভিযোগ। সরকার প্রদত্ব বিভিন্ন ধরনের অনুদান এখানে অবাধে লুটপাট করার অভিযোগও রয়েছে। একথায় ইউনিয়ন পরিষদের দুর্নীতি ওপেন সিক্রেট হলেও সরকারের পক্ষে তার লাগাম টেনে ধরা অনেকটাই কষ্টকর। বিশেষ করে স্থানীয় সরকার আইনের কাঠামোগত ত্রুটিই এক্ষেত্রে ইউপি চেয়ারম্যান মেম্বারদের রক্ষা কবচ। সেখানটিতে সংস্কার করতে যেয়ে বহুবিধ সমস্যার মুখোমুখি হতে হচ্ছে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে।
এদিকে সারাদেশে ৪ হাজার ৫৭১ জন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান অপসারণ নিয়ে দ্বিধায় পড়েছে সরকার। কারন হিসেবে অভিজ্ঞমহল বলেছেন, এক জন চেয়ারম্যানের অধিনে রয়েছেন ৯ জন করে ইউনিয়ন পরিষদের সদস্যসহ সংরক্ষিত আসনের আরো তিনজন। মোট সদস্য সংখ্যা ১২। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনায় এদের সকলেই প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত। সব মিলিয়ে যাদের সংখ্যা ১৮ হাজার ২৮৪জন। আর চেয়ারম্যানের সংখ্যা ৪হাজার ৫৭১ জন। যাদের অপসারণ করা হলে প্রশাসনে একটি শূন্যতার সৃষ্টি হবে। কারণ, সরাসরি জনগনের সেবা দেয়ার মত কোন জনপ্রতিনিধি থাকবে না। তাদের অভাবে থমকে পড়বে গ্রামীন সেবা আর সেই সঙ্গে গ্রামীন অর্থনীতি অনেকটাই ব্যহত হবে। আবার জনসেবা সচল রাখতে গেলে নতুন আইনে লোক নিয়োগ দিতে হবে। যা কেবল সময় সাপেক্ষই নয় যা সাংবিধানিক সঙ্কট সৃষ্টি করবে। এমন অচলাবস্থা সামাল দিতে গেলে সরকারের অনেক পরিকল্পনা অনিশ্চিত হয়ে পড়ার স্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এবিষয়ে স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এই স্থানে সংস্কার করতে গেলে অনেক ঝুঁকি রয়েছে। সেসব ঝুঁকি মোকাবিলা করেই ইউনিয়ন পরিষদ সরকারের হাত দিতে হবে। কিন্তু বর্তমান সরকার সেই স্তরে পৌছতে পারেননি। তাই বিষয়টি নিয়ে ভাবনার অনেক ক্ষেত্র রয়েছে।
সবমিলিয়ে গ্রামীন জনসেবা ব্যাহত হবে। এদিকে এই শূণ্যস্থানে কাদের নিয়োগ দেওয়া হবে তাদের বিষয়েও স্পষ্ট কোন রূপরেখা নেই। তারা বলেছেন, আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর সারা দেশের জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের পাশাপাশি উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানসহ সব পৌরসভার মেয়রকেও অপসারণ করা যতটা সহজ হয়েছে, ততটা সহজ নয় ইউনিয়ন পরিষদ বাতিল করা। এসব বিবেচনায় রেখে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের অপসারণ নিয়ে দ্বিধায় রয়েছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। কারণ স্থানীয় পর্যায়ে জনগণের সেবার কার্যক্রমে সরাসরি ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানরা জড়িত। সেজন্য একসঙ্গে ৪ হাজার ৫৭১ জন চেয়ারম্যানকে অপসারণ করলে জনদুর্ভোগে বাড়বে সে আশঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যায় না। সেই বিবেচনায় ইউপি চেয়ারম্যানদের অপসারণ বিষয়টি নিয়ে সরকার অনেকটাই দোটানায়। গত রোববার সচিবালয়ে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বরত কয়েকজন কর্মকর্তা জানান, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার রাষ্ট্রের বিভিন্ন সেক্টর সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে। সংস্কারের কার্যক্রম বাস্তবায়নে আগামী দুই থেকে তিন বছর সময় লাগতে পারে। সেক্ষেত্রে এই মুহূর্তে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানদের অপসারণ করলে মানুষ চরম ভোগান্তিতে পড়বেন। সুতরাং ইউনিয়ন চেয়ারম্যান অপসারণের ক্ষেত্রে বাস্তবমুখী সিদ্ধান্ত নেবে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়।
জানা গেছে, ইউনিয়ন পরিষদের গুরুত্বপূর্ণ কাজের ক্ষেত্রে রয়েছে- গ্রাম অঞ্চলে সালিশি ব্যবস্থা, স্থানীয়পর্যায়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় প্রশাসনকে সহায়তা,জন্মমৃত্যু, অন্ধ, ভিক্ষুক, প্রতিবন্ধী ও দুঃস্থদের নিবন্ধন করা, সব ধরনের শুমারি পরিচালনা করা, জনপথ ও রাজপথের ব্যবস্থা ও রক্ষাণাবেক্ষণ, অগ্নি, বন্যা, শিলাবৃষ্টিসহ ঝড়, ভ‚মিকম্প বা অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের তড়িৎ ব্যবস্থাসহ বিধবা,এতিম, গরিব ও দুঃস্থদের সাহায্যের মতো কাজগুলো করে থাকে ইউনিয়ন পরিষদ।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, দলীয় প্রতীকের বাইরে ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। সুতরাং আওয়ামীলীগ ছাড়াও ভিন্ন মতের মানুষ চেয়ারম্যান পদে নির্বাচিত হয়েছেন। সুতরাং অসৎ ও দলীয় চেয়ারম্যানের কারণে একজন সৎ, নিষ্ঠাবান চেয়ারম্যান তার দায়িত্ব থেকে বঞ্চিত হবেন, সেটা কাম্য নয়। সুতরাং স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় সবকিছু বিবেচনায় নিয়ে এরইমধ্যে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নিয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ওই সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে- ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানদের অনুপস্থিতিতে দায়িত্ব পাবেন প্যানেল চেয়ারম্যানরা।
গত ১৯ আগস্ট স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে একটি পরিপত্র জারি করা হয়েছে। ওইপরিপত্রে বলা হয়েছে, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানদের অনুপস্থিতিতে প্যানেল চেয়ারম্যানদের আর্থিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতা দেয়া যাবে। আর প্যানেল চেয়ারম্যান অনুপস্থিত থাকলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এবং সহকারীকমিশনারদের (ভ‚মি) এই দায়িত্ব দেয়া যাবে। বিভাগীয় কমিশনার বা জেলাপ্রশাসকরা এই দায়িত্ব দিতে পারবেন। ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানদের বিষয়ে পরিপত্রে আরো বলা হয়, দেখা যাচ্ছে দেশেবিভিন্ন ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান বর্তমানে ধারাবাহিকভাবে কর্মস্থলে অনুপস্থিত আছেন। ফলে ইউনিয়ন পরিষদের জনসেবাসহ সাধারণ কার্যক্রম বিঘিœত হচ্ছে। এ অবস্থায় অনুপস্থিত চেয়ারম্যানদের কাজ পরিচালনা এবং জনসেবা অব্যাহত রাখার জন্যস্থানীয় সরকার (ইউনিয়ন পরিষদ) আইন অনুযায়ীবিভাগীয় কমিশনার বা জেলা প্রশাসক নিজ নিজ অধিক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ইউনিয়নপরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যানকে আর্থিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতা দিতে পারবেন। আরপ্যানেল চেয়ারম্যানের অনুপস্থিতিতে অথবা যে কোনো জটিলতা দেখা দিলেইউএনও বা সহকারী কমিশনারকে (ভ‚মি) আর্থিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতা অর্পণ করা যাবে।সচিবালয়ে নিজ দফতরে ১৯ আগস্ট স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় উপদেষ্টাএএফ হাসান আরিফ সাংবাদিকদের বলেন, ইউনিয়ন পরিষদে এখন হাত দিচ্ছি না।যাচাই-বাছাই করে দেখা যাক সেখানে কার্যক্রম কী রকম আছে, যদি পরবর্তীকালেপ্রয়োজন হয় বা প্রয়োজনের তাগিদে কোনো পদক্ষেপ নিতে হয়, সেটি নেয়াহবে।
প্রসঙ্গত, ছাত্র-জনতার গণ-আন্দোলনের মুখে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীরপদ থেকে পদত্যাগের পর স্থানীয় সরকারের জনপ্রতিনিধিদের অধিকাংশইআত্মগোপনে চলে গেছেন। জেলা ও উপজেলা পরিষদ থেকে শুরু করে সিটি কর্পোরেশন ও পৌরসভার প্রায় সব শীর্ষ পদই আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের দখলেছিল। এমন পরিস্থিতিতে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছিল।পরে বিকল্প ব্যবস্থার পথে হাটে সরকার। যেমন উপজেলা চেয়ারম্যান অনুপস্থিত থাকলে দায়িত্বপালন করবেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও)। এখন অধ্যাদেশের মাধ্যমেআইন সংশোধন করে মেয়র-চেয়ারম্যানদের অপসারণ করে প্রশাসক নিয়োগ দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার।
সাবেক স্থানীয় সরকার সচিব আবু আলম শহীদ খান বলেন, কয়েক বছর ধরে এমন সবনির্বাচন হয়েছে যে নির্বাচন নিয়ে মানুষের মনে অনেক প্রশ্ন রয়েছে। সরকার পরিবর্তনের ফলে মানুষ এখন ক্ষোভ প্রকাশ করছে। তাদের অপসারণ চাইছে। তবে,যেসব ইউনিয়নে চেয়ারম্যান পদে স্বতন্ত্র বা অন্য রাজনৈতিক দলের নেতারা নির্বাচিত হয়েছেন সেসব জায়গায় চেয়ারম্যানদের খুব একটা সমস্যা হচ্ছে না।
২০১৮ সালের পর স্থানীয় সরকারের সব ধরনের নির্বাচন বয়টক করে বিএনপি ওসমমনা রাজনৈতিক দলগুলো। যে কারণে গত ৬ বছরে হাত গোনা কিছু ইউনিয়ন,উপজেলা বাদে বেশিরভাগেই জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হয় আওয়ামী লীগেরপ্রার্থীরা। বিএনপিসহ বিরোধী রাজনৈতিক জোটের উপস্থিতি ছাড়াও এসবনির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও এসবের অনেকগুলো নির্বাচন নিয়ে রয়েছে অনিয়ম কারচুপির অভিযোগ।
স্থানীয় সরকারের ইউনিয়ন পরিষদের আইন অনুযায়ী, পদত্যাগ করলে ইউনিয়ন পরিষদেরচেয়ারম্যান ও সদস্যপদ শূন্য হবে। এছাড়া পদত্যাগ, মৃত্যু বা অন্য কারণে চেয়ারম্যানপদ শূন্য হলে নতুন চেয়ারম্যান দায়িত্ব না নেয়া পর্যন্ত প্যানেল চেয়ারম্যান দায়িত্বপালন করবে। তবে শূন্য হওয়া ছাড়াও আইন অনুযায়ী ফৌজদারি মামলায়চার্জশিটভুক্ত আসামী বা দন্ডিত হলে, পরিষদের স্বার্থ পরিপন্থী করলে চেয়ারম্যানদের সাময়িকভাবে বরখাস্ত করিতে পারবে সরকার। এছাড়াও দুর্নীতি, অসদাচরণ বানৈতিক স্খলনজনিত কোনো অপরাধ কিংবা বিনা অনুমতিতে দেশত্যাগের কারণে ইউনিয়ন পরিষদ আইন অনুযায়ী তাদের অপসারণ করতে পারে সরকার। ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান অপসারণের বিষয়ে গতকাল সরকার, পল্লী উন্নয়ন ওসমবায় উপদেষ্টা এএফ হাসান আরিফের ফোনে কয়েকবার ফোন করলেও তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী আবু জাফর
যোগাযোগ: । [email protected] । বিজ্ঞাপন ও বার্তা সম্পাদক: 01894944220
ঠিকানা: বার্তা ও বাণিজ্যিক যোগাযোগ : বাড়ি নম্বর-২৩৪, খাইরুন্নেসা ম্যানশন, কাঁটাবন, নিউ এলিফ্যান্ট রোড, ঢাকা-১২০৫।
© 2024 Sangbad Sarabela All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh