× প্রচ্ছদ বাংলাদেশ বিশ্ব রাজনীতি খেলা বিনোদন বাণিজ্য লাইফ স্টাইল ভিডিও সকল বিভাগ
ছবি ভিডিও লাইভ লেখক আর্কাইভ

দখল-দুষণে হারিয়ে গেছে ঢাকার ৫ নদী

শাহনাজ পারভীন এলিস

১৪ মার্চ ২০২২, ১০:২২ এএম । আপডেটঃ ১৫ মার্চ ২০২২, ০০:২১ এএম

দখল ও দূষণে হারিয়ে গেছে ঢাকাকে ঘিরে রাখা বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু ও টঙ্গী নদীর মধ্যে সংযোগ স্থাপনকারী ১৭টি খাল। অথচ মহানগরী এলাকায় এক সময় খাল ছিল ৭৫টি। গবেষণা সংস্থা রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টার-আরডিআরসি’র গত বছরের গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, স্বাধীনতাকালেও ঢাকা জেলায় নদীর সংখ্যা ছিল ১৫টি। এর মধ্যে আঁটি, কনাই, দোলাই, পান্ডো ও নড়াই- এ পাঁচ নদীর কোনো হদিস এখন নেই।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গত কয়েক দশকে দখল-দূষণে নদী ভরাট হয়ে একের পর এক গড়ে উঠেছে শহর ও সুরম্য অট্টালিকা, তৈরি হয়েছে বিনোদনকেন্দ্র, মার্কেটসহ নানা স্থাপনা। এভাবে গত অর্ধশত বছরে নদীর তীর মাটি ভরাট করে দখলে নেয়ায় প্রায় অস্তিত্বহীন হয়ে পড়েছে এসব নদী। এছাড়া ঢাকার আশপাশে ১০টি নদী বহমান থাকলেও দখল-দূষণে তাও মৃতপ্রায়। শুষ্ক মৌসুমে অনেক নদী চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়ে। কোথাও কোথাও নদীর অস্তিত্বই বিলীন। এর বাইরে কল-কারখানার রাসায়নিক বর্জ্য, পয়োনিষ্কাশন বর্জ্যসহ নানা কারণেই দূষিত হচ্ছে নদী, সংকুচিত হচ্ছে নদীর গতিপথ।

গবেষণা সংস্থাটির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এজাজ জানান, ব্রিটিশ আমলে ঢাকার সীমানা ছিল অনেক ছোট। মানচিত্র অনুসারে তখন ঢাকা বলতে উত্তরে শাহবাগ, দক্ষিণে চর ইউসুফ ও চরকামরাঙ্গী, পশ্চিমে ধানমন্ডি এবং পূর্বে মতিঝিল ও ইংলিশ রোডের মধ্যবর্তী এলাকাকে বোঝানো হতো। এই ছোট এলাকার মধ্যেই পুকুর ছিল ১২০টি; অথচ সেই সংখ্যাটা এখন মাত্র ২৪ এ এসে দাঁড়িয়েছে। পুরনো ও নতুন ঢাকা মিলিয়ে বর্তমানে পুকুর রয়েছে মাত্র ২৪১টি। ধর্মীয় উপাসনালয়ের সঙ্গেই আছে ৪৩টি। এর বাইরে ৮৬টি বিল ও লেক রয়েছে। আর পুকুর, বিল ও লেক মিলিয়ে জলাশয়ের সংখ্যা ৩২৭টি।

তিনি অভিযোগ করেন, নদী ও খালগুলো দখলের জন্য দায়ী অপরিকল্পিত নগরায়ণ। উত্তরা, বনানী, বনশ্রী, নিকুঞ্জসহ বড় বড় প্রোজেক্টগুলো তৈরিতে কোনো পরিকল্পনা ছিল না। এতে বন্ধ হয়ে গেছে পানি নিষ্কাশনের গতিপথ। ব্যবস্থা রাখা হয়নি বৃষ্টির পানি পুন:ব্যবহারের। শহরে মাইলের পর মাইল হাঁটলেও এখন মাটি পাওয়া যায় না। গত ৫০ বছরে ঢাকা ও তার আশপাশের পাঁচটি নদী বিলীন হয়েছে। শহরের পাশে বেড়িবাঁধ তৈরি করেও নদীর প্রবাহ নষ্ট করা হয়েছে। এরপর আবার বেড়িবাঁধের দুপাশেও দলছে দখল বাণিজ্য। এছাড়া ঢাকা শহরের পার্শ্ববর্তী নদীগুলোর অনেক শাখা নদীও দখলদারদের কবলে পড়ে বিলীন হয়েছে। আর হারিয়ে যাওয়া নদী পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে তৎপরতা নেই প্রশাসনের।

এদিকে ২০০৯ সালে হাইকোর্টের রায়ে ঢাকার চার নদী থেকে দখলদার উচ্ছেদের নির্দেশ দেয়া হয়।

রায়ের ৯নং আদেশে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনকে একটি কার্যকরী স্বাধীন প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে প্রয়োজনীয় সব ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণের নির্দেশ দেয়া হয়। আর রায় কার্যকর করতে টেকসইভাবে নদীগুলোকে দখলমুক্ত করার উদ্দেশ্য সীমানা পিলার নির্মাণের উদ্যোগ নেয় বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষ-বিআইডব্লিউটিএ। সেসময় গাজীপুর, ঢাকা, নারায়ণগঞ্জের জেলা প্রশাসক বুড়িগঙ্গা ও তুরাগ নদীতে প্রায় ছয় হাজার পিলার স্থাপন করেন। যেগুলোর অধিকাংশই নদীতে বা তীরেই স্থাপন করা হয়।

এ বিষয়ে রিভার এন্ড ডেলটা রিসার্চ সেন্টার-আরডিআরসির অপর একটি গবেষণা প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, বুড়িগঙ্গা ও তুরাগ নদী দখলমুক্ত করতে ওই দুই নদের সীমানায় স্থাপন করা ৩ হাজার ৮৪টি পিলারের মধ্যে ১ হাজার ৪২৩টিই নদীর মধ্যে স্থাপন করা। এতে নদীগুলো সরু করে উল্টো দখলদারের সুবিধা করে দেয়া হয়েছে। বুড়িগঙ্গা নদীর পশ্চিম প্রান্তে ২২৮টি এবং পূর্ব প্রান্তে ৮৪টি মিলিয়ে ৩১২টি পিলারের অবস্থান ভুল। তুরাগ নদের এক হাজার ১১১টি ভুল পিলারের মধ্যে পূর্ব প্রান্তে ৪০৯টি আর পশ্চিমের বন্যাপ্রবণ এলাকায় রয়েছে আরো ৭০২টি।

সংস্থাটি আরো জানায়, ওই ঘটনায় তোলপাড় শুরু হলে ২০১৪ সালে একজন ডেপুটি সেক্রেটারির নেতৃত্বে গঠিত কমিটি একটি রিপোর্ট পেশ করে। এতে পিলার স্থাপনার ভুলের দিকটি উঠে আসে। পরবর্তীতে নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয় থেকে বিআইডব্লিওটিএকে নদী দখল মুক্ত করে নতুন করে সীমানা পিলার স্থাপনের দায়িত্ব দেয়া হয়। গবেষণায় আরো ৩৯০টি পিলার বিতর্কিত রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়। এমনকি কোথাও কোথাও পোর্ট আইন ১৯৬৬ ও বাংলাদেশ পানি আইন ২০১৩ না মেনে পিলার নির্মাণের অভিযোগও করা হয়।

এ বিষয়ে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান মুজিবর রহমান হাওলাদার জানান, বিআইডব্লিউটিএ নদীর সীমানা নির্ধারণের সময় নদী কমিশন, পানি উন্নয়ন বোর্ডের সহায়তা না নিয়ে করায় এই প্রকল্পে সরকারি অর্থ অপচয় হয়েছে এবং তৈরি হয়েছে নদী দখলের সুযোগ। দখল-দূষণে জর্জরিত নদী রক্ষা এবং পানির স্বাভাবিক প্রবাহ ফিরিয়ে আনতে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি নানা উদ্যোগ নিয়েছে বিআইডব্লিউটিএ। উচ্ছেদ অভিযান, ভূমি উদ্ধার, ওয়াকওয়ে ও ইকোপার্কসহ বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণ এসব প্রকল্পের মধ্যে আনা হয়েছে।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের- বাপা’র সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিলের মতে, নদীর ঢাল, পার ও প্লাবন অঞ্চল সব দখলদারদের কবলে। এতে নদীর তলদেশ গভীর করে নৌ চলাচল ও বর্জ্য নিষ্কাশনের রাস্তা তৈরি করা হয়েছে। তবে নদীগুলোকে রক্ষা করতে হলে নদী ব্যবস্থাপনা নিয়ে সরকারের যে পরিকল্পনা তা জনসম্পৃক্ত করতে হবে; একই সঙ্গে পরিকল্পনাগুলো স্বচ্ছতা ও বিজ্ঞানসম্মত করাসহ অতীত অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাতে হবে।

জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের গবেষণা ও পরিবীক্ষণ বিভাগের উপ-পরিচালক আখতারুজ্জামান তালুকদার জানিয়েছেন, নদী ও সম্পদ রক্ষার্থে জনসচেতনতা বৃদ্ধিকরণে দেশের সকল বিভাগীয় জেলা ও উপজেলা নদী রক্ষা কমিটির মাধ্যমে জনসচেতনতা সৃষ্টি করার কার্যক্রম চলমান রয়েছে। এ বিষয়ে ফোকাস পয়েন্টস সভা, সেমিনার, মতবিনিময় সভা অগ্রগতি র‌্যালি ও পথসভা দিবস উদযাপন প্রিন্ট ও ই-মিডিয়া, ফেইসবুক ও ইউটিউবের মাধ্যমে সচেতনতা বৃদ্ধির কাজ চলছে। বিভিন্ন স্থানীয় সরকার পরিষদ/পৌরসভা/সিটি কর্পোরেশনকেও এ লক্ষ্যে পর্যাপ্ত পরামর্শ প্রদান করা হয়েছে।

এছাড়া চাঁপাইনবাবগঞ্জে মহানন্দার অবৈধভাবে লিজ দেওয়ার দলিল বাতিল করা হয়েছে; কুষ্টিয়ার গড়াই নদীর জমি দখল করে জেলা পরিষদ কর্তৃক পার্ক নির্মাণ বন্ধ করা হচ্ছে। শেখ রাসেল ব্রিজের পাশের ভবন/স্থাপনা ভেঙে দেওয়া হয়েছে; রাঙ্গামাটি লেক দখলের প্রচেষ্টা বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গৃহীত হয়েছে; কুড়িগ্রামের চাকের পাশা নদীকে জলমহালে বিভক্ত করে লিজ দেওয়া বন্ধে আইনি ব্যবস্থা গৃহীত হয়েছে। আনলিমা পেট্রোলিয়াম লিমিটেড কর্তৃক মুন্সীগঞ্জেরে গজারিয়ায় মেঘনা নদীর তীরভূমিতে বিদ্যুত প্লান্ট তৈরির জন্য অবৈধভাবে দখলকৃত ১২.০৮ একর জমি উদ্ধার করা হয়েছে এবং প্লান্ট বন্ধ করা হয়েছে। মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ, বসুন্ধরা গ্রুপ, অরিয়নসহ বেশ ক’টি ব্যবসায়িক/শিল্প ইউনিট মেঘনা নদীর জমি দখল করে গড়ে উঠেছে; এ বিষয়ে প্রতিবেদন তৈরি হয়েছে; গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জে তিস্তা নদীর তীরভূমি, ফোরশোর নদীর প্লাবনভূমি নদীর জমি দখল করে, গৃহীতব্য সোলার প্লান্ট কমিশন বন্ধ করে দিয়েছে।

আখতারুজ্জামান তালুকদার জানান, ২০১৮ সালে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের ৪৮ নদী সমীক্ষা প্রকল্পের কাজও সফলভাবে এগুচ্ছে। সমীক্ষা শেষে পাঁচ বছর মেয়াদি এই প্রকল্পের প্রতিবেদন ডিসেম্বরে প্রকাশ করা হবে। আর মহামারি করোনার প্রভাবে কাজ ধীরগতিতে চলায় ২০২০ ও ২০২২ সালের এনআরসিসিবি’র প্রতিবেদন এপ্রিল মাসের শুরুতে প্রকাশ করার প্রস্তুতি চলছে।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের- বাপা’র সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল জানান, ঢাকার আশপাশে থাকা বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু ও শীতলক্ষ্যা’র চার নদীর দূষণ, অবৈধ দখল ও নদীগুলোর ভেতরে বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণের বৈধতা নিয়ে মানবাধিকার ও পরিবেশবাদী সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের (এইচআরপিবি) পক্ষে ২০০৯ সালে হাইকোর্টে একটি রিট করা হয়। চূড়ান্ত শুনানি শেষে হাইকোর্ট কয়েক দফা নির্দেশনাসহ রায় দেন। রায়ে সময়সীমা বেঁধে দিয়ে সিএস ও আরএস ম্যাপ অনুসারে নদীগুলোর সীমানা জরিপ করা, প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন ঘোষণা, নদীগুলো রক্ষায় প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রণয়ন, সীমানা পিলার স্থাপন, নদী সীমানায় ওয়াকওয়ে নির্মাণ বা বৃক্ষরোপণ করতে বলা হয়।

এর ধারাবাহিকতায় হাজারীবাগ ও কামরাঙ্গীরচর বুড়িগঙ্গা এলাকায় আদি চ্যানেলের নদীর জায়গা উদ্ধার ও অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদে নির্দেশনা চেয়ে গত বছরের ৬ অক্টোবর এইচআরপিবি হাইকোর্টে আবেদন করে। এর শুনানি নিয়ে গত বছরের ১২ অক্টোবর হাইকোর্ট হাজারীবাগ ও কামরাঙ্গীরচর এলাকায় বুড়িগঙ্গা নদীর অংশে আদি চ্যানেলে’ নদীর জায়গা সিএস/আরএস ম্যাপ অনুসারে তিন মাসের মধ্যে চিহ্নিত করতে নির্দেশ দেন। একই সঙ্গে দখলকারীদের নাম–ঠিকানাসহ প্রতিবেদন হলফনামা আকারে ওই সময়ের মধ্যে আদালতে দাখিল করতে বলা হয়। কিন্তু নদীর দকল উচ্ছেদ প্রকল্পে সেসবে নির্দেশনা মানা হয়নি; বরং অনেক ক্ষেত্রে দখলদারদের উৎসাহিত করা হয়েছে।

আইনজীবী মনজিল মোরসেদ জানিয়েছেন, আদালতের নির্দেশ অনুসারে প্রতিবেদন জমা পড়ে। আদি চ্যানেল এলাকায় নদীর জায়গায় টিনশেড বাড়ি, চারতলা ভবন, একতলা ভবন, জায়গা দখল করে মাটি ভরাট, মসজিদের আংশিক স্থাপনাসহ ব্যক্তিমালিকানাধীন বাড়ি, হাসপাতাল, কারখানা ও সুপারমার্কেট রয়েছে। স্থাপনাসহ এসব তিন মাসের মধ্যে উচ্ছেদ করতে হাইকোর্ট নির্দেশ দিয়েছেন। নির্দেশনা অনুসারে পদক্ষেপ নিয়ে ঢাকার জেলা প্রশাসক ও বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যানকে আদালতে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।

সরকারের উদাসীনতা, প্রভাবশালীদের দখলে হারিয়ে গেছে ঢাকার অধিকাংশ খাল। যে কটি টিকে আছে সেগুলোতে নিরবচ্ছিন্ন প্রবাহ নেই। নদীর সঙ্গে সংযোগও কাটা পড়ছে। জলাবদ্ধ হয়ে পরিণতি ভোগ করছে ঢাকার পৌনে দুই কোটি মানুষ। এ অবস্থা থেকে ঢাকাকে বাঁচাতে নদী-খাল উদ্ধারে নেয়া সরকারি উদ্যোগগুলো দ্রুত বাস্তবায়নের বিকল্প নেই- মনে করছেন সংশিষ্টরা।

Sangbad Sarabela

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী আবু জাফর

যোগাযোগ: । 01894-944220 । [email protected], বিজ্ঞাপন: 01894-944204

ঠিকানা: বার্তা ও বাণিজ্যিক যোগাযোগ : বাড়ি নম্বর-২৩৪, খাইরুন্নেসা ম্যানশন, কাঁটাবন, নিউ এলিফ্যান্ট রোড, ঢাকা-১২০৫।

আমাদের সঙ্গে থাকুন

© 2024 Sangbad Sarabela All Rights Reserved.