কার্যালয়ের সর্বোচ্চ কর্মকর্তা থেকে শুরু করে প্রশাসনিক কর্মকর্তাসহ অন্যরাও এই অভিযোগের বিপরীতে যৌতিক কোন উত্তর দেয়নি। দিতেও চাননি তারা। বিষয়টি নিয়ে কর্তৃপক্ষের নেই বিন্দু পরিমাণও মাথা ব্যথা।
ভাইরাল হওয়া মানিরিসিভে দেখা গেছে, একটি ইট ভাটার কাছ থেকে আশি হাজার টাকা নেয়া হয়েছে অনুদানের নামে। কার্যালয়ের নামযুক্ত প্রাপ্তি স্বীকার স্লিপে (মানিরিসিভ) স্বাক্ষর রয়েছে উক্ত কার্যালয়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তার। বেশ কয়েকটি অনলাইন পোর্টালে, টাকা নেয়ার স্বপক্ষে প্রশাসনিক কর্মকর্তার স্বীকারোক্তিমূলক জবাববন্দির কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। উর্দ্ধতন কর্মকর্তার নির্দেশেই অনুদানের নামে টাকা সংগ্রহ করা হয়েছে বলেই তিনি (প্রশাসনিক কর্মকর্তা) স্বীকারোক্তি দেন বলেই প্রতিবেদনগুলোতে বলা হয়েছে।

গত ৬ নভেম্বর বিভিন্ন ইট ভাটার মালিক/প্রতিনিধি উপজেলা কার্যালয়ে এসে প্রশাসনিক কর্মকর্তার কক্ষে ও বাইরে এসে ভাটার পরিধি ও পরিসর অনুযায়ী অনুদান/চাঁদা দিয়ে গেছেন বলে জানায় সূত্র। আবার কেউবা বলছেন, ভাটার যাচাই বাছাই এর নামে ব্যবসার ধরণ বুঝে টাকা নেয়া হয়েছে। এমনই এক প্রাপ্তি স্বীকার বা মানিরিসিভের কপি নিয়ে তোলপার শুরু হয় উপজেলা কার্যালয় সহ গণ্যমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। মুহুর্তেই ভাইরাল হয়ে যায় বিষয়টি। আশি হাজার টাকা গ্রহণের সেই মানিরিসিভে প্রশাসনিক কর্মকর্তার স্বাক্ষর থাকার কারণে সন্দেহের তীড় প্রথমেই গিয়ে পরে প্রশাসিনক কর্মকর্তা কায়সার আলমের উপর।
প্রশাসনিক কর্মকর্তার কক্ষে প্রবেশ করতেই চোঁখে পড়ে দেশের প্রথমশ্রেণির দুটো স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেলের প্রতিনিধিকে। একই বিষয় জানার জন্য সেখানে আগে থেকেই তারা অপেক্ষা করছিলেন কায়সার আলমের জন্য। বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর প্রশাসনিক কর্মকর্তা এলেন নিজের অফিস কক্ষে। জানতে চাওয়া হয়েছিল, অনুদানের নামে ভাটা মালিকদের কাছ থেকে যে অর্থ গ্রহণ করা হয়েছে সেটি কেনো ও কিধরণের অনুদান। প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বিষয়টি কিছু অনলাইন ও স্থানীয় পত্রিকায় প্রকাশ হয়েছে বলে শুনেছি। তবে এখনো দেখিনি। প্রাপ্তি স্বীকার স্লিপে (মানিরিসিভ) স্বাক্ষরটি কি আপনার?
জানতে চাইলে তিনি বলেন না। ওটা আমার না। দাপ্তরিকভাবে কোন সমস্যা না থাকলে এবং ততসহ আপনি কিছু মনে না করলে, আপনার দাপ্তরিক স্বাক্ষরটি আমরা একটু দেখতে চাচ্ছি। বলার পর তিনি প্রায় মিনিট দেড়েক চুপ থাকার পর উত্তর দেন; আমি কি আপনাদের সামনে আমার স্বাক্ষর করে দেখাবো। জবাবের বিপরীতে আমরা উনার টেবিলে থাকা প্রায় পনে-বিশটি ফাইলের দিকে তাকিয়ে প্রতুত্ত্বরে বলি, না সেটা দরকার নেই। আপনি যদি এই ফাইলগুলোর মধ্য থেকে কোন একটি ফাইলে থাকা আপনার স্বাক্ষরটি আমাদেরকে দেখান তাতেই হবে। আমরা আপনার ফাইলের পেপারস কিংবা স্বাক্ষরের ছবি তুলবোনা। ঐ মানিরিসিভের সাথে আপনার স্বাক্ষরের কোন সাদৃশ্য আছে কিনা সেটি নিশ্চিত হবার জন্য শুধু একবার দেখবো।
প্রশাসনিক কর্মকর্তা কায়সার আলম এবার প্রায় মিনিট পাঁচেক চুপ থেকে বলে উঠেন, আপনারা কি চা খাবেন। জানিয়ে দেয়া হয়, নো থ্যাংকস। শুধু পানি দিলেই চলবে। বলা মাত্রই তিনটি মিনারেল ওয়াটারের বোতল এসে হাজির টেবিলে। অতঃপর তিনি একের পর এক ফাইল হাতাতে থাকেন। নিজ টেবিলেরগুলো শেষ করে ডান পাশে থাকা কেবিনেট ও অন্য একটি টেবিলে থাকা আরো দশ-বারোটি ফাইল হাতাতে থাকেন। সেখানেও কিছু না পেয়ে তিনি নিজ কক্ষ থেকে কিছুক্ষণের জন্য বাইরে চলে যান। প্রায় মিনিট দশেক পর হাতে একটি ফাইল নিয়ে ফিরে আসে নিজ কক্ষে। ফাইল থেকে একটি কাগজ বের করে দেখান একটি স্বাক্ষর। স্বাক্ষরটি নিজের বলে দাবি করেন।
কিন্তু ফাইলে থাকা একটি সরকারি ডকুমেন্টে স্বাক্ষর থাকা প্রশাসনিক কর্মকর্তা নাম-পদপদবী ও সীল না থাকার কারণ জানতে চাইলে তিনি নানা অযৌতিক প্রসঙ্গ তুলে ধরেন প্রতিবেদকের সামনে। অতঃপর বলে উঠেন, ইউএনও (উপজেলা নির্বাহী অফিসার) স্যার আপনাদেরকে এবিষয়ে বলবেন। স্যারের অনুমতি ছাড়া আমি কোন মন্তব্য করতে পারবোনা। পবা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সোহরাব হোসেন’র কাছ থেকে প্রতিবেদক অনুমতি নিয়ে আসার পরেও প্রশাসনিক কর্মকর্তা অনুদানগ্রহণ ও স্বাক্ষরের বিষয়ে মন্তব্য করতে অনিহা প্রকাশ করেন।
অনুমতি নিয়ে (ইউএনও) সোহরাব হোসেন’র কক্ষে প্রবেশ করতেই দেখা মেলে রাজশাহীর একটি স্থানীয় পত্রিকার সম্পাদক সহ আরো তিনজন সাংবাদিক বসে আছেন সেখানে। ইউএনও’র কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিষয়টি আমি শুনেছি। তবে এখনো চোখে পড়েনি। পরক্ষণেই তিনি বলেন, প্রতিবেদনে মিথ্যাচার করা হয়েছে।
কি ধরণের মিথ্যাচার করা হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রতিবেদনে উল্লেখ্য করা হয়েছে মোট ৫০টি ইট ভাটার কথা। কিন্তু পবা উপজেলায় রয়েছে ৩৯টি ইট ভাটা। এরমধ্যে, দু-তিনটা ইতোমধ্যেই তাদের উৎপাদন বন্ধ রেখেছে। জানতে চাওয়া হয়েছিল, আপনার দপ্তর থেকে এপর্যন্ত কতগুলো ইট ভাটায় অভিযান পরিচালিত হয়েছে। কতগুলো ইট ভাটার লাইসেন্স আছে, আর কতগুলো ইট ভাটা পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে ছাড়পত্র নিয়ে ইট প্রস্তুত করছে?
উত্তরে তিনি বলেন, তিন মাসের মতো হলো আমি এখানে যোগদান করেছি। তাছাড়া, এরইমধ্যে আমার অন্যত্র বদলীর আদেশ চলে এসেছে। ডিসি স্যার বলেছেন, ডিসেম্বর মাস শেষ করে যেতে। তাই আমি এখনো এখানে কর্মরত আছি।
আপনি বলছেন, প্রতিবেদনগুলো বানোয়াট ও মিথ্যা। তাহলে এতোদিন (প্রায় দশদিন) অতিবাহিত হলেও আপনি/আপনারা দাপ্তরিকভাবে কেনো কোন ব্যবস্থা নেননি। জানতে চাইলে ইউএনও সোহরাব হোসেন বলেন, দেখি কি করা যায়। ইট ভাটার মালিকদেরকে আমি দেখা করতে বলেছি। বিষয়টি নিয়ে তাদের সাথে আলোচনা করবো। পরেরদিন ইউএনও’র দপ্তরে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হলেও; সেখানে সাধারণ ইট ভাটার ব্যবসায়ীরা না থাকলেও উপস্থিত ছিলে, ইট ভাটা মালিক সমিতির সভাপতি সালাম সহ আরো বেশ কয়েকজন নেতা বলে জানায় সূত্র।
বিষয়টির সত্যতাও স্বীকার করেন সভাপতি সালাম। মোবাইল করে জানতে চাইলে সভাপতি সালাম বলেন, অনুদান বা চাঁদা দেবার বিষয়টি মিথ্যা। মানিরিসিভ ও স্বীকারোক্তিমূলক রেকর্ডিং এর বিষয়ে বলা মাত্রই তিনি সঙ্গে সঙ্গে গলার সুর পাল্টে বলে উঠেন, এবিষয়ে আমি কিছু জানিনা। শুধু এতটুকু বলতে পারবো, আমার কাঁটাখালি বেল্টের কোন ইট ভাটার মালিক অনুদান কিংবা চাঁদা দেয়নি। পবার বিভিন্ন এলাকার ভাটা সম্পর্কে আমি কিছু জানিনা।
কে বা কারা সরকারি দপ্তরের নাম ভাঙ্গিয়ে নকল ‘মানিসিরিভ’ ব্যবহারে অর্থ গ্রহণ করেছে; সেটি জানেন না উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও প্রশাসনিক কর্মকর্তা। বিষয়টি সম্পর্কে যেনো কেউ কোন মন্তব্য না করেন, সেটিও বলে দেয়া হয় ভাটা মালিকদের বলে জানায় সূত্র।
উল্লেখ্য, একই কার্যালয়ের পূর্ববর্তী সময়ের একজন ইউএনও’র বিরুদ্ধেও উঠেছিল আশ্রয়ণ প্রকল্প-২ এর ঘর নির্মাণ নানা প্রশ্ন। দেশের বেশ কয়েকটি জাতীয় ও স্থানীয় পত্রিকা ও অনলাইন পোর্টালে ‘ঘুষের ইটে আশ্রয়ণ প্রকল্পর নির্মাণ করছে পবা ইউএনও'র ভাই” শিরোনাম সহ সমজাতীয় আরো শিরোনামে প্রকাশিত হয়েছিল একাধিক প্রতিবেদন।, ‘(সেসময় সেপ্টেম্বর’২০২৪) পবা উপজেলার ইউএনও ছিলেন আবু সালেহ মোহাম্মদ হাসনাত। প্রতিবেদনগুলোতে বলা হয়েছিল, ৯১ লাখ ৫০ হাজার টাকা ব্যয়ে আশ্রয়ণ প্রকল্পের ৩০টি ঘর নির্মাণের সার্বিক দায়িত্বে আছেন ইউএনও।
অন্তত অর্ধেক টাকা লুটপাটের অভিযোগ পাওয়া গেছে। ঘর নির্মাণেও নেই মানসম্পন্নের তেমন ছোয়া। একটি ইট ভাটাকে পুকুর কাটতে দেওয়ার মৌখিক অনুমতি প্রদানের বিপরীতে প্রকল্পের ঘর নির্মাণের জন্য ঘুষ হিসেবে নেওয়া হয়েছে হাজার হাজার ইট। আশ্রয়ণ প্রকল্পের কাজ ছাড়াও ডরমেটরি এবং শিল্পকলা একাডেমি অফিস সংস্কারের কাজও করছেন ইউএনওর চাচাতো ভাই রাজীব রনক। এনিয়ে উপজেলা চত্বর সহ সচেতন মহলের মধ্যে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় বয়েছে। অবশেষে বদলীর চিঠি চলে আসলে তিনি বদলী হয়ে যান অন্যত্র।