ছবি: রাবাব চৌধুরী।
ঢাকা বনানীতে রাস্তায় থাকা অসহায় প্রাণীদের জন্য এক মানবিক উদ্যোগ নিয়ে আমি রাবাব চৌধুরী নিয়মিতভাবে শুরু করি এলাকার কুকুরসহ পথ প্রাণীদের ভ্যাকসিন প্রদান ও প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করা।
পরিচিতি ও অনুপ্রেরণা:-
১. প্রথমেই জানতে চাই, আপনাকে কী অনুপ্রাণিত করেছে রাস্তার কুকুরদের ভ্যাক্সিন দেওয়ার কাজে নামতে?
আমার সৃষ্টিকর্তার সব জীবের প্রতি অনেক টান। কিন্তু ঢাকার রাস্তায় অসংখ্য কুকুরকে অসুস্থ, অনাহারে বা মানুষের মার খেতে দেখে মনে হয়েছে ওদেরও আমাদের মতোই বাঁচার অধিকার আছে। একসময় বুঝলাম, ভ্যাক্সিন ও স্টেরিলাইজেশন করলে কুকুরদের জীবন যেমন নিরাপদ হয়, তেমনি মানুষেরও ভয়ের কোনো কারণ থাকে না। সেই দায়িত্ববোধই আমাকে কাজে নামতে অনুপ্রাণিত করেছে।
2. অনেকেই কুকুর দেখলেই ভয় পান বা দূরে সরে যান আপনি কীভাবে তাদের প্রতি ভালোবাসা গড়ে তুললেন?
আমি ছোটবেলায় কুকুরকে খুব ভয় পেতাম। একবার স্কুল থেকে ফেরার পথে দেখি, এক ছোট্ট কুকুরছানা বৃষ্টির মধ্যে ভিজে কাঁপছে। সবাই পাশ কাটিয়ে চলে গেল, কিন্তু তার চোখ দুটো এত অসহায়ভাবে আমার দিকে তাকাচ্ছিল যে আমি আর পারলাম না। ভয়ে ভয়ে কাছে গিয়ে একটা বিস্কুট দিলাম। অবাক হয়ে দেখি সে আমার দিকে চেয়ে লেজ নাড়ছে সেই মুহূর্তেই আমার ভয়টা গলে গেল। পরে আমি তাকে আমার বাসায় নিয়ে এসে পড়ি এবং সে আমার সাথে ১২ বছর আমার বন্ধু হিসাবে আমার পাশে আমার সাথে বড় হয়েছে। সেদিনের সেই অভিজ্ঞতাই আমাকে শিখিয়েছে—কুকুর ভয় দেখানোর জন্য নয়, ভালোবাসা দেওয়ার জন্য।
৩. এই কাজ শুরু করার সময় পরিবার বা সমাজ থেকে কেমন প্রতিক্রিয়া পেয়েছিলেন?
শুরুর দিকে অনেকে হাসাহাসি করতো “রাস্তার কুকুরকে নিয়ে এত ভাবছো কেন?” কেউ বলত, “কামড়ালে কী হবে?”। কিন্তু আমি থামিনি। কিন্তু আমার পরিবারের সাপোর্ট দে ওয়ান থেকে আমার সাথে ছিল যার কারণে আমি এতদূর আসতে পেরেছি। আমার এই কাজের শুধু আমি একা নয় আমার পরিবারের অনেক বড় একটি অবদান আছে। ফিনান্সিয়াল সাপোর্ট থেকে শুরু করে কখনো যদি কোন মানুষের হেনস্তা স্বীকার হয়েছি আমার পরিবার আমাকে অনেক সাপোর্ট করেছে যেটা বাংলাদেশে অনেক uncommon।
কাজের অভিজ্ঞতা ও চ্যালেঞ্জ:
৪. একেকটা কুকুরকে ভ্যাকসিন দেওয়ার প্রক্রিয়া আসলে কেমন হয়?
প্রথমে কুকুরটিকে শান্ত করা হয়, খাবার বা পরিচিত স্বর দিয়ে। তারপর প্রশিক্ষিত টিমের সহায়তায় কুকুরকে ধরে নিরাপদভাবে ভ্যাক্সিন দেওয়া হয়। পুরো প্রক্রিয়া কয়েক মিনিটের বেশি লাগে না, তবে কুকুরকে ভয় না দেখানোই আসল কৌশল।
৫. এ কাজে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ কী কী সামনে আসে?
সবচেয়ে বড় বাধা হলো মানুষের মনজয় করা। অনেক সময় কুকুর ভ্যাকসিন দিতে গেলে মানুষ এসে বাঁধা দেয়, গালাগালি করে—“এগুলোকে মেরে ফেলাই ভালো।” তখন ভীষণ কষ্ট হয়। কিন্তু আমি জানি, কুকুর মেরে সমস্যা মেটে না। তাদের টিকা দিলে তারা নিরাপদ হয়। তাই রোদ, বৃষ্টি বা মানুষের বিরূপ মন্তব্য, সবকিছু সহ্য করেও আমি চালিয়ে যাই। কারণ শেষমেষ কুকুরগুলো আরেকটা দিনের আলো দেখতে পায়, আর সেই দৃশ্যই আমার সবচেয়ে বড় শক্তি।
৬. কখনও কি বিপদের মুখে পড়েছেন, যেমন কুকুর কামড়ানো বা মানুষের বিরূপ আচরণ?
হ্যাঁ, কিছুটা ঝুঁকি থাকে। কুকুর ভয়ে আক্রমণাত্মক হতে পারে, তবে সঠিক কৌশল ব্যবহার করলে কামড়ানোর ঘটনা এড়ানো যায়। মানুষের বিরূপ আচরণও হয়েছে অনেকে গালি দিয়েছেন বা কাজ করতে দেননি। তবে ধৈর্য নিয়ে বুঝিয়ে বললেই অনেকেই মত বদলান।
৭. প্রতিদিন গড়ে কতগুলো কুকুরকে ভ্যাকসিন দিতে পারেন?
একেকদিন পরিস্থিতির উপর নির্ভর করে। সাধারণত একটি টিম নিয়ে বের হলে দিনে ১০-১৫টা কুকুরকে ভ্যাক্সিন দেওয়া সম্ভব হয়। বিশেষ অভিযানে সংখ্যাটা আরও বাড়ানো যায়।
সমাজ ও সচেতনতা:
৮. আপনার মতে, বাংলাদেশে মানুষ এখনো কি রাস্তার কুকুরদের নিয়ে ভুল ধারণায় ভোগে?
হ্যাঁ, এখনো অনেকেই মনে করেন কুকুর মানেই ভয়, কামড়, রোগ। অথচ বাস্তবে টিকা দেওয়া কুকুর কাউকে ক্ষতি করে না। আমাদের এলাকাতেই আগে মানুষ ভয় পেত, কিন্তু আমি ১০০% ভ্যাক্সিনেশন ও স্টেরিলাইজেশন করার পর কুকুরগুলো শান্ত হয়ে গেছে। আজকাল বাচ্চারা স্কুলে যেতে যেতে ওই কুকুরদের খাবার দেয়, খেলেও। এই পরিবর্তন দেখে বুঝেছি ভুল ধারণা দূর করা যায়, যদি কেউ সাহস করে প্রথম পদক্ষেপ নেয়।
৯. মানুষকে কীভাবে সচেতন করা যায় যে ভ্যাক্সিন দেওয়া কুকুর আসলে ক্ষতিকর নয়, বরং সবার জন্য নিরাপদ?
সচেতনতার জন্য প্রচারণা দরকার—সোশ্যাল মিডিয়া, স্থানীয় মসজিদ-মাদ্রাসা, স্কুল এবং কমিউনিটি campaign মাধ্যমে। মানুষকে বুঝাতে হবে ভ্যাক্সিন দেওয়া কুকুর আসলে জলাতঙ্কমুক্ত এবং মানুষের বন্ধু।
১০. স্থানীয় কর্তৃপক্ষ বা সংগঠনগুলো কি কোনোভাবে আপনাকে সহযোগিতা করে?
আনুষ্ঠানিক সহযোগিতা খুব একটা পাওয়া যায়নি। আমি চাই স্থানীয় সরকার ও কর্তৃপক্ষ আরও সক্রিয় হোক।
ব্যক্তিগত অনুভূতি:
১১. যখন একটি অসহায় কুকুরকে ভ্যাক্সিন দিয়ে তার জীবন বাঁচান—তখন আপনার কেমন লাগে?
প্রতিবার টিকা দেওয়ার পর মনে হয়, আমি যেন একটা প্রাণকে মৃত্যুর হাত থেকে ফিরিয়ে আনলাম। ওরা তো ভাষায় কৃতজ্ঞতা জানাতে পারে না, কিন্তু চোখে মুখে, লেজ নাড়ায় এমন এক ভালোবাসা থাকে যা মানুষের মুখে শোনা হাজারটা ধন্যবাদের চেয়েও বড়। সত্যি বলতে, ওই মুহূর্তে আমি নিজেকেই নতুন করে বাঁচতে দেখি।
১২. কখনো কি এমন কোনো কুকুরের গল্প আছে যেটা আপনার মনে গভীরভাবে ছাপ ফেলেছে?
আমাদের এলাকায় একবার খুব ভীতু একটা মা কুকুর ছিল। সবাই তাকে তাড়াত, লাঠি মারত। আমি একদিন তাকে খাবার দিলাম, পরে নিয়মিত খাবার দিতে শুরু করলাম। প্রথমে সে ভয় পেত, দূরে দাঁড়িয়ে থাকত। কিন্তু ধীরে ধীরে বিশ্বাস করল। একদিন দেখলাম, আমি রাস্তায় ঢুকতেই সে দৌড়ে এসে লেজ নাড়িয়ে পাশে দাঁড়াল তারপর নিজের বাচ্চাগুলোকে আমার কাছে এনে বসিয়ে দিল। মনে হলো যেন বলতে চাইছে—“এরা এখন তোমারও দায়িত্ব।” সেই মুহূর্তটা আমার হৃদয়ে চিরকালের জন্য গেঁথে গেছে।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা:
১৩. এই কাজকে আরও বড় পরিসরে নেওয়ার কোনো স্বপ্ন আছে?
অবশ্যই। আমার স্বপ্ন হলো ঢাকার প্রতিটি এলাকায় ১০০% ভ্যাক্সিনেশন ও স্টেরিলাইজেশন নিশ্চিত করা। পরে তা সারা বাংলাদেশে ছড়িয়ে দেওয়া। তারা যেন বৃষ্টিতে একটু আশ্রয় পায় সে ব্যবস্থা করা এবং তাদের খাবার সোর্সিং এর ব্যবস্থা করা
১৪. তরুণ প্রজন্ম বা সাধারণ মানুষকে আপনি কীভাবে এই কাজে যুক্ত হতে আহ্বান জানাবেন?
আমি তরুণদের বলব—আপনারা যদি একটু সময় দেন, তবে অনেক প্রাণ বাঁচানো সম্ভব। ভাবুন তো, নিজের খাবার থেকে অল্প একটু অংশ যদি তাদেরকে দেওয়া হয় বা এক ঘণ্টা মোবাইল কম ব্যবহার করে ওদের সাথে একটু সময় কাটান, অর্থাৎ আপনি যদি সেই সময় বা খাবার একটা কুকুরকে দেন—সে শুধু খুশিই হবে না, আপনাকে অগাধ ভালোবাসা দেবে। আমি চাই, তরুণরা এগিয়ে আসুক; কারণ তারাই পরিবর্তন আনতে পারে। আজ যদি আমরা কুকুরকে বাঁচাতে শিখি, কালকে আমরা আরও বড় মানবিক পরিবর্তনের পথ তৈরি করতে পারব।
১৫. যদি সরকার বা বড় কোনো সংস্থা আপনাকে সহযোগিতা করে, তাহলে প্রথমেই কী পরিবর্তন আনতে চান?
আমার প্রথম স্বপ্ন হবে একটি জাতীয় কর্মসূচি শুরু করা। যেখানে প্রতিটি মহল্লায়, কুকুরদের ভ্যাক্সিনেশন, স্টেরিলাইজেশন এবং খাবারের ব্যবস্থা থাকবে। আমি চাই না কোনো কুকুরকে ক্ষুধায় কাঁদতে বা রোগে কষ্ট পেতে দেখতে। যদি সরকার পাশে দাঁড়ায়, তবে কয়েক বছরের মধ্যেই বাংলাদেশ হতে পারে দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম কুকুর বান্ধব ও জলাতঙ্কমুক্ত দেশ। তখন সবাই গর্ব করে বলতে পারবে আমরা শুধু মানুষ নয়, প্রাণীকেও ভালোবাসতে শিখেছি।
লেখক: প্রধান, বনানী ওল্ড ডিওএইচএস পশু কল্যাণ
সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী আবু জাফর
যোগাযোগ: । [email protected] । বিজ্ঞাপন ও বার্তা সম্পাদক: 01894944220
ঠিকানা: বার্তা ও বাণিজ্যিক যোগাযোগ : বাড়ি নম্বর-২৩৪, খাইরুন্নেসা ম্যানশন, কাঁটাবন, নিউ এলিফ্যান্ট রোড, ঢাকা-১২০৫।
© 2025 Sangbad Sarabela All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh