প্রতীকী ছবি
কিঞ্চিদধিক সার্দ্ধদ্বিসহস্র বৎসর পূর্বের সময়। পৃথিবী দ্বিসহস্র ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দ্বীপের সমষ্টি, যার চার মহাদ্বীপ জম্বুদ্বীপ, উত্তরকুরু, পূর্ববিদেহ ও অপর-গোযান। জম্বুদ্বীপ পৃথিবীতে শ্রেষ্ঠ। উত্তরে হিমালয়ের পার্বত্য ভূমি। দক্ষিণে গঙ্গা নদী। পশ্চিমে পাঞ্চাল রাজ্য। পূর্বদিকে গণ্ডক নদী সদানারী। ধৌলাগিরি, অন্নপূর্ণা এবং মানসলু চারদিক। কপিলাবত্থু ও দেবদহ দুই নগরের মধ্যবর্তী লুম্বিনী উদ্যান। কোলিয়শাক্যরাজ অঞ্জন কন্যা মায়াদেবী প্রসব করলেন এক পুত্র সন্তান। লুম্বিনী কাননের শালবৃক্ষ তলে বৈশাখী পূর্ণিমার শুভক্ষণে জগতের আলো ভাবীকালের বুদ্ধ ভূমিষ্ঠ হলেন। ঝরছে শালের কুসুম। যেন স্বর্গ হতে পুষ্পবৃষ্টি। মুহূর্মুহূ উলুধ্বনি ও মঙ্গলশঙ্খ ধ্বনি দিয়ে উপস্থিত সকলে নৃত্যগীতিতে চারদিক আনন্দমুখর করে তুলল। পিলাবত্থু ও দেবদহ নগরে সে বার্তা পৌঁছা মাত্র উভয় নগরের গৃহে গৃহে হুলধ্বনি হতে লাগলো। শাক্য নারীরা বাজাতে লাগলো মঙ্গলশঙ্খ। দুর্গে দুর্গে বেজে উঠলো দুন্দুভি। মন্দিরে বাজল কাঁসার ঘণ্টার ধ্বনি।
ভূমিষ্ঠ হলো জগতের আলো ভাবীকালের বুদ্ধ সে শিশু সে সময়, যখন মনুষ্য আয়ু শত বছর। জন্ম গ্রহণ করলেন জম্বুদ্বীপে, কারণ জম্বুদ্বীপ পৃথিবীতে শ্রেষ্ঠ। এই জম্বুদ্বীপে পূর্বে বহু বুদ্ধ, মহাপুরুষ ও চক্রবর্তীর জন্ম হয়েছে, এই জম্বুদ্বীপের মধ্যে শ্রেষ্ঠ মধ্যদেশ কোশলরাজ্য, তাই কোশলরাজ রাজধানী কপিলাবত্থুতে জন্ম গ্রহণ করলেন। পৃথিবীতে ক্ষত্রিয়কুল শ্রেষ্ঠ, তাই ক্ষত্রিয়কুলে জন্ম গ্রহণ করলেন। জন্ম গ্রহণ করলেন ৩২ প্রকার মহাগুণসম্পন্না, মহাপুণ্যবতী মায়াদেবীর মাতৃগর্ভ হতে এবং সর্বগুণোপতি মাতৃশুদ্ধ, পিতৃশুদ্ধ পুণ্যতেজ তেজস্বী চক্রবর্তীবংশ সমুদ্ভূত অপরিমিত ধননিধিরত্ন সমন্বাগত অভিরূপ দর্শনীয় ধর্মল ধর্মরাজ প্রজানুরঞ্জক কোশলের অধিপতি সুর্যবংশীয় শাক্যবীর শাক্যসিংহ শাক্যকুলপ্রদীপ মহরাজ শুদ্ধোদনের ঔরস্যে। লুম্বিনী কানন থেকে শোভাযাত্রা করে নিয়ে আসা হলো নবজাত রাজকুমার ও রাজমাতাকে। শাক্য পুর-ললনারা মহানন্দে মঙ্গলধ্বনিতে বরণ করলেন অশ্রুতপূর্ব অলৌকিক শিশুকে।
পুত্র জন্মাবার সাত দিন পরেই মারা গেলেন মায়াদেবী। মারা যাবার সময় নিজ পুত্রের দায়িত্ব দিয়ে গেলেন ছোট বোন মহাপ্রজাবতী গোতমীকে। রাজা শুদ্ধোদন, পুত্র সিদ্ধার্থকে মহারাজ চক্রবর্তী করবার জন্যই লালায়িত হয়ে পুত্রের জন্য শীতঋতুর জন্য রম্যাপ্রসাদ, গ্রীষ্মের জন্য সুরম্যাপ্রাসাদ এবং বর্ষার জন্য সুভাপ্রাসাদ নামক নয়তলা, সপ্ততলা, পঞ্চতলাবিশিষ্ট তিনটি অট্টালিকা নির্মাণ করলেন। সর্বদোষবর্জিতা চল্লিশ অপ্সরা সঙ্ঘ পরিবৃত দেবপুত্রের ন্যায় অনন্যপুরুষ সিদ্ধার্থ প্রাসাদত্রয়ে সুখে অবস্থান করতে লাগলেন। অতি উত্তম কণজক ভাত ও উত্তম ব্যঞ্জনাদি আহার করেন। আচার্য বিশ্বামিত্র, আচার্য কৌশিকের নিকট শাস্ত্র এবং আচার্য শাকদেবের নিকট শস্ত্রশিক্ষা করলেন।
হলকর্ষণোৎসবে বালক সিদ্ধার্থ দেখল, চাষা তার বলদকে প্রহার করছে। তিনি মনে আঘাত পেলেন। চষা ক্ষেতের উপর পড়ে আছে মৃত পোকামাকড় আর পাখি উড়ে এসে সেগুলো খাচ্ছে, ব্যাঙও মৃত কীট খাচ্ছে মনের আনন্দে, আবার গর্ত থেকে সাপ বেরিয়ে এসে সেই ব্যাঙগুলোকে খাচ্ছে। আকাশ থেকে চিল নেমে এসে আবার ছোঁ মেরে তুলে নিচ্ছে তার আহার সাপ। নিজের জীবন রক্ষার জন্য জীব জীবকে বিনাশ করছে। সিদ্ধার্থ প্রত্যক্ষ করলেন জীবনের ব্যর্থ প্রয়াস। তাঁর মন উদাস হয়ে গেল।
সিদ্ধার্থের মনোরঞ্জনের জন্য প্রাসাদ সংলগ্ন উদ্যানে নয়নাভিরাম পুষ্করিণী খনন করা। কোনটিতে আছে নীলপদ্ম, কোনটিতে শ্বেতপদ্ম, কোনটিতে রক্তপদ্ম। কাশীর চন্দন ব্যতীত অন্য চন্দনচূর্ণ তিনি ব্যবহার করেন না। তার উত্তরীয় পরিধেয় বস্ত্র কাশীবস্ত্র নির্মিত। তার মাথার উপর সর্বদা শ্বেতচ্ছত্র ধরা থাকে, যেন ঠাণ্ডা বা গরম না লাগে, মাথায় যেন গাছের পাতা, ফুলের রেণু, ধুলাবালি, শিশির না পড়ে।
ক্রমে যৌবন বয়সে পদার্পণ করলেন। সাধারণের চেয়ে যথেষ্ট দীর্ঘদেহী, উজ্জ্বল গৌরবর্ণ, প্রশান্ত মুখশ্রী। রাজা শুদ্ধোদন তাঁর বিবাহের আয়োজন করলেন। শাক্যসিংহ শাক্যবীর শাক্যকুমার সূর্যবংশীয় ক্ষত্রিয় বীর কুমার সিদ্ধার্থ অশ্বচালনা, ধনুর্বাণ, অসিচালনা একে একে সবকটিতেই জয়লাভ করে শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করে কোলিয়শাক্য রাজা দণ্ডপাণি কন্যা ভদ্রকাত্যায়নী যশোধরা গোপাকে বিবাহ করলেন। পাখির কলকাকলিতে মুখর, পুষ্পশোভিত উদ্যানে নির্মিত ভিন্ন ভিন্ন ঋতু উপযোগী প্রাসাদে আনন্দে কাটতে লাগল যুবরাজ সিদ্ধার্থ ও রাজবধু যশোধরা গোপার দিনগুলো। জন্ম নিল পুত্র রাহুল। কিন্তু এতো বিলাস, প্রাসাদগুলোর বিলাসবহুল জীবনযাপনের মধ্যেও সিদ্ধার্থ প্রাসাদের প্রাচীরের ওপারে বিশ্ব সম্পর্কে জানার জন্য অস্থির এবং কৌতূহলী হয়ে উঠলেন।
নগর ভ্রমণে বেরিয়ে সিদ্ধার্থ জরা, ব্যাধি, মৃত্যু ও সন্ন্যাসী দেখে মানবজীবনের লক্ষ্য সম্যকভাবে উপলব্ধি করলেন। দুঃখমুক্তির সন্ধানে গৃহত্যাগ করবেন সিদ্ধান্ত নিলেন। সারথি ছন্দক, অশ্বরাজ কন্থককে সজ্জিত করে নিয়ে এলেন। সিদ্ধার্থ কন্থকের পিঠে চড়ে নগর থেকে বেরিয়ে ছুটে চললেন বিদ্যুদ্বেগে। ত্রিশ যোজন পথ অতিক্রম করে অনোমা নদীর তীরে এসে উপস্থিত হলেন। ঊষাভোর সূর্যোদয়ের শিশির-স্নাত স্নিগ্ধ অরুণালোক দেখতে পেলেন গৃহত্যাগী সিদ্ধার্থ। ঘোড়ার পিঠ থেকে নেমে তরবারি দিয়ে নিজের দীর্ঘ কেশ কেটে ফেললেন। রাজ পোশাক ও অলংকারগুলো উপহার দিলেন ছন্দককে। এক ব্যাধের ছিন্ন কাষায় বস্ত্রের সাথে নিজের বসন বদল করে ভিখারী সাজলেন। কুমারের এই দীনবেশ দেখে ছন্দক রোদন করতে লাগল। সিদ্ধার্থের বিয়োগ ব্যথা সইতে না পেরে অশ্বরাজ কন্থক তখনই প্রাণত্যাগ করল। রাজপুত্র, রাজসুখ ত্যাগ করে হলেন গৃহত্যাগী সন্ন্যাসী। আষাঢ়ী পূর্ণিমা তিথিতে উনত্রিশ বছর বয়সে সিদ্ধার্থের মহাভিনিষ্ক্রমণ।
পুরুষসিংহ শাক্যসিংহ সিদ্ধার্থ সঙ্কল্পের বর্ম্মে আবৃত হয়ে সাধন সমরে প্রবৃত্ত হলেন। সকল বাসনা, সকল সংস্কার হতে মুক্তিলাভ করে সিদ্ধার্থের চিত্ত সত্যের বিমল আলোকে পরিপূর্ণ হলো। সাধনায় সিদ্ধিলাভ করে জ্ঞান প্রাপ্ত হলেন। মনশ্চক্ষুর সম্মুখে জীবের যাবতীয় দুঃখের মূলীভূত কারণ প্রকাশিত হলো। জ্ঞাননেত্রে দেখলেন “ধম্মই সত্য, ধম্মই পবিত্র বিধি, ধম্মেই জগৎ বিধৃত হয়ে আছে। একমাত্র ধম্মের মাধ্যমেই, মানব ভ্রান্তি পাপ দুঃখ হতে মুক্তিলাভ করতে পারে।” সিদ্ধার্থর প্রজ্ঞানেত্রের সম্মুখে জন্ম মৃত্যুর সকল রহস্য উদ্ঘাটিত হলো। বুঝলেন, দুঃখ, দুঃখের কারণ, দুঃখের নিরোধ এবং দুঃখনিরোধের উপায় এই চারটি আর্য্য সত্য। এই দুঃখনিবৃত্তির উপায় আটটি, সম্যক দৃষ্টি, সম্যক সঙ্কল্প, সম্যক বাক্য, সম্যক কর্ম্মান্ত, সম্যগাজীব, সম্যক ব্যায়াম, সম্যক স্মৃতি ও সম্যক সমাধি। পিপলবৃক্ষ তলে রাতের তৃতীয় প্রহরে বোধিজ্ঞান লাভ করলেন। শাক্যবংশে জন্মেছিলেন তাই হলেন ‘শাক্যসিংহ’ ‘শাক্যমুনি’ নামে পরিচিত। গৌতম বংশে জন্ম তাই অপর নাম হলো ‘গৌতম’। ‘বুদ্ধ’ নামে অবহিত হোন বোধি সম্যক জ্ঞান লাভের পর। পরম সত্য অর্জন করায় হলেন ‘তথাগত’। তাই তার নাম হলো ‘শাক্যসিংহ শাক্যমুনি গৌতম বুদ্ধ তথাগত’।
ঋষিপত্তনের মৃগদাব উদ্যানের পঞ্চশিষ্যর কাছে চৌখন্ডি স্তূপ-অষ্টকোণবিশিষ্ট স্তম্ভ স্থানে করলেন ধর্মচক্রপ্রবর্তন। তখন উত্তর ভারতবর্ষে ষোলোটি মহাজনপদ। মগধ, বৎস, অবন্তি, কোশল ছিল প্রধান সমৃদ্ধশালী। মগধের রাজধানী রাজগৃহ, রাজা বিম্বিসার। বৎসরাজ্যের রাজধানী কৌশাম্বি, রাজা উদয়ন। অবন্তীর রাজধানী উজ্জয়িনী, রাজা চণ্ডপ্রদ্যোৎ। কোশলের রাজধানী সাবত্থি, রাজা পসেনদি। বৌদ্ধ ধর্ম ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে।
বুদ্ধের ঊনআশি বছর বয়স। বেশালির মহাবনে কুটাগারশালায় চাপালচৈত্য শিষ্য আনন্দের কাছে তাঁর মহাপরিনির্বাণের সংকল্প ব্যক্ত করলেন। পবায় অবস্থান করার সময় চণ্ড নামক এক কামার সূকরমদ্দব নামে একপ্রকার ছত্রাকের ব্যঞ্জন বুদ্ধকে দান করলো। আহার শেষে বুদ্ধ আমাশয় দ্বারা আক্রান্ত হলেন, বিষম রোগ যন্ত্রণায় হলেন কাতর।
এরপর শিষ্য আনন্দের আপত্তি সত্ত্বেও অত্যন্ত অসুস্থ অবস্থায় কুশিনারা যাত্রা করলেন। কঠিন আন্ত্রিক পীড়া, নিদারুণ যন্ত্রণা, রোগযন্ত্রণায় কাতর শরীর। মধ্যাহ্নে যাত্রা করে সূর্যাস্তের সময় কুশিনারা পৌঁছালেন। আসবার পথে এতই দুর্বল ও নিস্তেজ হয়ে পড়লেন, পথিমধ্যে অনেকবার বিশ্রাম নিলেন। কুশিনারা মল্লদের উপবতির শালবনে যুগ্নশালের মধ্যে শয়ন করলেন বুদ্ধ, মহাপরিনির্বাণ শয্যায়। শায়িত অবস্থায় বুদ্ধ উপস্থিত সকল ভিক্ষু ও উপাসক উপাসিকাদের তার শেষ ধম্ম দেশনা প্রদান করলেন। বৈশাখী পূর্ণিমার জ্যোৎস্নায় প্লাবিত মল্লদের উপবতির শালবন। ঝরছে শালের কুসুম। যেন স্বর্গ হতে পুষ্পবৃষ্টি। অনন্তর সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহাকারুনিক মহাজ্ঞানী শাক্যসিংহ শাক্যমুনি গৌতম বুদ্ধ তথাগত মহাপরিনির্বাণ প্রাপ্ত হলেন। চক্রবিচিত্রতলে শায়িত সুবর্ণ আস্তরণের মতো রশ্মিবিকীরণশীল বুদ্ধ তথাগতের ঊর্ধ্বাঙ্গ যেন কনকচাঁপার গুচ্ছ। কখনো নিষ্কম্প দীপশিখা। দীপ্ততর চন্দ্ররশ্মি তাঁকে উজ্জ্বল রেখেছে। এই চন্দ্রপ্রভা বুদ্ধ তথাগতের ভেতরের। বুদ্ধের মধ্য থেকে সেই প্রভা তাঁর আর পৃথিবীর সকল প্রাণের মধ্যে সেতু রচনা করছে। সেই সেতু বেয়ে ওই প্রভা বুদ্ধের শির থেকে প্রবেশ করছে জগতের সকল প্রাণের মস্তিষ্কে হৃদয়ে। মৈত্রী, শান্তি, করুণার প্রভা। বৈশাখী পূর্ণিমা তিথিতে ৬২৩ সাধারণপূর্বাদ্ধে লুম্বিনী কাননে বুদ্ধের জন্ম এবং বৈশাখী পূর্ণিমা তিথিতে ৫৪৩ সাধারণপূর্বাদ্ধে মহাপরিনির্বাণ। ১৫ই মে ২০২২ ইং তাং রবিবার “শুভ বুদ্ধ পূর্ণিমা” ২৫৬৬ বুদ্ধাব্দ। পৃথিবী মুক্ত হোক সকল হিংসা, বিদ্বেষ, যুদ্ধ হতে। সকল প্রাণী সুখী হোক। পৃথিবী স্নাত হোক শান্তি, মৈত্রীর করুণাধারায়।
লেখক: কথা সাহিত্যিক, কবি ও প্রাবন্ধিক
সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী আবু জাফর
যোগাযোগ: । [email protected] । বিজ্ঞাপন ও বার্তা সম্পাদক: 01894944220
ঠিকানা: বার্তা ও বাণিজ্যিক যোগাযোগ : বাড়ি নম্বর-২৩৪, খাইরুন্নেসা ম্যানশন, কাঁটাবন, নিউ এলিফ্যান্ট রোড, ঢাকা-১২০৫।
© 2025 Sangbad Sarabela All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh