ছবি:সংগৃহীত।
পঁইত্রিশ বছর আগে চার বন্ধুর মনে জেগেছিল এক দুঃসাহসী স্বপ্ন। যা তখনকার দিনে অনেকের কাছেই নিছক কল্পনার প্রতিচ্ছবি ছিল। চার পথিকৃৎ নারী। ডেবোরা গ্রিফিন, অ্যালিস ডি. কুপার, সু ডরিংটন ও মেরি ফোরসাই। চেয়েছিলেন নারীদের জন্য প্রথম রাগবি বিশ্বকাপের সূচনা করতে। তাদের হাতে ছিল না অর্থের জোগান। ছিল না কোনো নির্দিষ্ট মাঠ। অন্যদিকে আইআরবি প্রথম থেকেই তাঁদের প্রচেষ্টাকে বাতিল করে দেয়। তবে হাল না ছেড়ে এই চার নারীর দৃঢ়তা ও অক্লান্ত পরিশ্রমই লিখে দেয় ইতিহাস। ১৯৯১ সালে ওয়েলসের কার্ডিফে অনুষ্ঠিত প্রথম নারী রাগবি বিশ্বকাপের গল্প।
রিচমন্ড রাগবি ক্লাবে খেলাধুলার মাঝেই চার নারীর মনে আসে এক ধারণা। তাঁরা জানতেন কিছু দেশে নারী দল আছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, সুইডেন। কিন্তু অন্য দেশগুলোকে একত্রিত করা সহজ ছিল না। তখনকার দিনে ইন্টারনেট বা সোশ্যাল মিডিয়া ছিল না। ফ্যাক্স মেশিনই ছিল তাদের একমাত্র হাতিয়ার। এদের অবিরাম প্রচেষ্টা ও একের পর এক বার্তা বিনিময়ের ফলে শেষ পর্যন্ত তারা ১২টি দেশের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে সক্ষম হন। ইতালির দল তখনও ফেডারেশনের বাধার মুখে ছিল। আর রাশিয়ার দলকে এমনকি স্থানীয়ভাবে পুতুল ও ভদকা বিক্রি করে নিজেদের খাবারের জোগান করতে হয়েছিল। তবুও সমস্ত প্রতিকূলতার মধ্যে আন্তর্জাতিক অংশগ্রহণের স্বপ্ন পূরণ হয়।
ইংল্যান্ডে ভেন্যু নিয়ে চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ায় তারা তাদের নজর ঘুরিয়ে ওয়েলসের দিকে দিলেন। এখানে মানুষ ও ক্লাবগুলো তাদের উষ্ণ অভ্যর্থনা জানাল, বুকভরা ভালোবাসা দিয়ে। সবচেয়ে বড় সহযোগিতা মিলল কার্ডিফ আর্মস পার্ক থেকে যেখানে অনুষ্ঠিত হলো উদ্বোধনী ও ফাইনাল ম্যাচ। বাকি প্রতিযোগিতার ম্যাচগুলো ছড়িয়ে পড়ল ওয়েলসের বিভিন্ন মাঠে। ওয়েলসবাসীর আন্তরিক অতিথিপরায়ণতা এবং উৎসাহপূর্ণ সমর্থন এই আয়োজনে প্রাণ সঞ্চার করল। তা সাফল্যের পথে এগিয়ে নিল।
কিন্তু সব পরিকল্পনা এক মুহূর্তে অর্থসংকটে আটকে গেল। প্রথমে প্রতিশ্রুতি ছিল। প্রতিটি দলের থাকা-খাওয়ার খরচ বহন করা হবে। কিন্তু মোট খরচ বেড়ে দাঁড়াল ৩৫ হাজার পাউন্ডে। কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো মহিলাদের খেলা ‘শখের কাজ’ বলে গুরুত্ব দিতে অস্বীকার করল। শেষপর্যন্ত দলগুলো নিজেদের অর্থ খরচ করে অংশগ্রহণ করল। স্থানীয় মানুষের সহায়তা। ছোট ছোট দান ও ভাউচারের মাধ্যমে আয়োজন চালিয়ে নেওয়া গেল। তবুও চাপ ছিল প্রচণ্ড। ট্রফির জন্য এক হাজার পাউন্ড খরচ করায় সহকর্মীরা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। আর অনেক সাংবাদিক এটিকে কেবল “কাদায় গড়াগড়ি খাওয়া মেয়েদের খেলা” বলে বিদ্রূপ করলেন।
১৯৯১ সালের ৪ এপ্রিল স্বপ্নের আয়োজনের সূচনা হয়। উদ্বোধনী দিনে শোভাযাত্রা, বহুজাতিক নারীদের গান ও হাসি-আনন্দ অংশগ্রহণকারীদের স্মৃতিতে আজও অম্লান। ১২ দল আট দিনের মধ্যে মোট ২১টি ম্যাচ খেলল। ফাইনালে যুক্তরাষ্ট্র ১৯-৬ পয়েন্টে ইংল্যান্ডকে পরাজিত করে। দর্শকসংখ্যা ছিল তিন হাজার। খেলোয়াড়রা বুঝতে পারলেন—তাঁরা শুধু নিজেদের দেশের হয়ে খেলছেন না। বরং নারীদের নতুন এক উপস্থিতি বিশ্বমঞ্চে উপস্থাপন করছেন।
তবে এই সাফল্যের পেছনে ছিল ব্যক্তিগত ত্যাগ। আর্থিক ক্ষতির পাশাপাশি তাঁদের জীবন জর্জরিত হয়েছিল মানসিক চাপে। ডেবোরা গ্রিফিন স্বীকার করেছেন, সে সময় তিনি প্রায় ভেঙে পড়েছিলেন। অ্যালিস চাকরি হারিয়েছিলেন। সু ডরিংটনের সংসার ভেঙে গিয়েছিল। দীর্ঘদিন তাঁরা এই আঘাত নিজের মধ্যে বহন করেছেন। এমনকি বিশ্বকাপকে নিয়ে কখনো প্রকাশ্যভাবে কথা বলেননি।
তবুও ইতিহাসের মূল্য সময়ের সঙ্গে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। সেই প্রথম আয়োজনই আজকের নারী রাগবির ভিত্তি গড়ে দিয়েছে। এখন, যখন লাখো দর্শক ভরা স্টেডিয়ামে নারী খেলোয়াড়রা মাঠে নামেন। তারা দাঁড়িয়ে থাকেন সেই চার নারীর কাঁধের ওপর। যাঁরা একসময় সমস্ত প্রতিকূলতার মুখোমুখি হয়ে বলেছিলেন, “এটা করতে হবে, কারণ করার প্রয়োজন আছে।”
নারী রাগবির আজকের বৈশ্বিক সাফল্য শুরু হয়েছিল মাত্র চার পথিকৃৎ নারীর স্বপ্ন থেকে। তাঁদের দৃঢ়তা প্রমাণ করেছে। খেলাধুলা কেবল খেলা নয়। কখনো কখনো এটি সমাজ পরিবর্তনের প্রেরণার অগ্নিস্ফুলিঙ্গ হয়ে ওঠে।
সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী আবু জাফর
যোগাযোগ: । [email protected] । বিজ্ঞাপন ও বার্তা সম্পাদক: 01894944220
ঠিকানা: বার্তা ও বাণিজ্যিক যোগাযোগ : বাড়ি নম্বর-২৩৪, খাইরুন্নেসা ম্যানশন, কাঁটাবন, নিউ এলিফ্যান্ট রোড, ঢাকা-১২০৫।
© 2025 Sangbad Sarabela All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh