ভারতের ত্রিপুরার কসবা কালি বাড়ি বা কালী মন্দির হিসেবে পরিচিতি পেলেও বাস্তবে মূর্তিটি দেবী দুর্গার। মহিষাস্যের মর্দিনী সিংহ বাহিনী দেবীর দশ হাতে দশ রকমের অস্ত্র। পদ প্রান্তে রয়েছে শিবলিঙ্গ। কালো কষ্টি পাথরে তৈরি দেবী মূর্তি। মায়ের এমন প্রতিমা পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টি নেই। তাই ঐতিহাসিক দৃষ্টিতে কালীবাড়ির ঐতিহ্য বিশ্বে বিরল। এছাড়াও মন্দিরটি তীর্থযাত্রীদের দৃষ্টিকোণ থেকে শুধুমাত্র সুপরিচিতই না, এই মন্দিরটি অতি জাগ্রত একটি স্থান বলে দাবি করেন স্থানীয়রা।
বলছিলাম ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের একেবারে বাংলাদেশের সীমান্তঘেঁষা শতাব্দীর প্রাচীর কসবা কালী মন্দিরের কথা।
বাংলাদেশের ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার (সাবেক কুমিল্লা জেলা) কসবা উপজেলার সীমান্তে লাগোয়া ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের সিপাহীজলা জেলার কসবায় অবস্থিত। স্থানটিকে কমলাসাগর এবং তারাপুর নামেও পরিচিত। তবে বাংলাদেশের মতো কসবা নামটিই বহুল পরিচিত।
এখানে আসতে ত্রিপুরার আগরতলা শহর থেকে বাসে ৪৪ নং ন্যাশনাল হাইওয়েতে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে মধুপুর নামক স্থানে নেমে পরবর্তি মন্দির পর্যন্ত ১৩ কিলোমিটার অটোতে যেতে হবে। তবে শহর থেকে টেক্সি বা ভাড়ায় টেক্সি রিজার্ভ করে সরাসরি মন্দিরে যাওয়াই উত্তম। ৪৪নং ন্যাশনাল হাইওয়ে থেকে পুরো ১৩ কিলোমিটার দূরত্বের মন্দির বা কমলা সাগরের রস্তাটি বাংলাদেশের ব্রাহ্মণবাড়িয়া সীমান্তঘেঁষা সড়ক বরাবর গভীর জঙ্গল বা বনের মধ্যে দিয়ে যেতে। কমলা সাগর সংলগ্ন একটি প্রাচীন মন্দির রয়েছে। তবে এটি কসবা কালী মন্দির হিসেবেই বেশি পরিচিত। কমলা সাগরের তিন পাশেই বাংলাদেশের কাঁটাতারের বেড়া রয়েছে। অর্থাৎ কমলা সাগরটির তিন পাশেই বাংলাদেশ। কমলা সাগরের পাশেই রয়েছে বিশালাকার কড়ই গাছ। এরপর একটু এগুলেই ছোট্ট টিলার উপর মন্দির। কমলা সাগরের পাশেই অবস্থিত ৫০০ বছরের প্রাচীর কসবা কালী মন্দির। আজ থেকে প্রায় ৫২০ বছর আগে অর্থাৎ ১৫শ শতকে মহারাজ ধন্য মানিক্য এ মন্দির ও মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেন। তবে কথিত আছে মহারাজ কল্যাণ মানিক্য স্বপ্নাদেশে এই মূর্তির খোঁজ পেয়েছিলেন। তিনি স্বপ্নাদেশ মতো তৎকালীন শ্রীহট্ট (বর্তমান সিলেট) জেলার হবিগঞ্জের এক ব্রাহ্মণ পরিবার থেকে অতি সম্মানের সাথে প্রতিমা কহিলার ঘরে নিয়ে আসেন। পরবর্তী সময়ে মহারাজ ধন্য মানিক্য কসবাতে মন্দির তৈরি করে প্রতিমাটি প্রতিষ্ঠা করেন। এখনো মন্দিরে পূজার সময় রাজ বংশের নামে সম্ভাব্য করা হয়। এই মন্দিরে পূজা-আর্চনাতেও রয়েছে বিরল ও ভিন্ন প্রথা। কালীবাড়ি হিসেবে পরিচিতি পেলেও এখানে সাধারণ কালী পূজার কোনো নিয়ম বা মন্ত্র উচ্চারণ হয় না। কালী নামেও ভক্তদের অঞ্জলি দেওয়া হয় না। সাধারণ কালীপূজা বা দুর্গাপূজার নিয়ম মন্ত্রাদি থেকে এই পূজা সম্পূর্ণ ভিন্ন। পূজা প্রার্থনা থেকে যে রীতি স্বপ্নাদেশ থেকে পাওয়া গিয়েছিল তা মেনেই আট প্রজন্ম ধরে পুরোহিতরা এখানে পুজো-অর্চনা করে আসছেন।
একমাত্র দেওয়ালি রাত ছাড়া এই মন্দিরে কোনো নিশি পূজা করা হয় না। সন্ধ্যা আরতির পরেই মন্দিরের দরজা বন্ধ হয়ে যায়। একমাত্র দেওয়ালি রাতেই এখানে নিশি পূজা হয় এবং মন্দিরের দোয়ার খোলা থাকে। আবার ভাদ্র মাসের আমাবস্যায় দিনের বেলায় মন্দিরে যে পূজা হয় তার নিশি পূজা হয় আগরতলা সংলগ্ন দুর্গাবাড়িতে। প্রতিবছর ভাদ্র আমাবস্যার আগেই ত্রিপুরার কসবা কালি বাড়িতে মহা ধুমধাম করে ভাদ্রমেলা অনুষ্ঠিত হয়। এই মেলাতে জাতি ধর্ম নির্বিশেষে ভারত-বাংলাদেশের প্রচুর লোকসমাগম হয়। সব মিলিয়ে ত্রিপুরাবাসীর কাছে খুব জনপ্রিয় ও জাগ্রত এই কসবা কালী মন্দির।
২০২২ সালের ৪ আগস্ট আমরা ৩ বন্ধু ত্রিপুরা ভ্রমণে গিয়েছিলাম। সেসময় এ কসবা কালী মন্দির দর্শনে গিয়ে জানাগেলো এ কালী মন্দিররের ইতিকথা। আমরা ৬ আগষ্ট গিয়েছিলাম মন্দির দর্শনে। সেদিন ভাড়া করা মিনি মাইক্রো স্থানীয় ভাষায় ‘ভ্যান’ করে মন্দিরে পৌঁছেছিলাম ঠিক সন্ধ্যার একটু আগে। যেকারণে মন্দির প্রাঙ্গণে ছিলো শুনশান নীরবতা। এখানে সন্ধ্যায় আরতি হয় না বিধায় লোকজনও ছিলো না তেমন। শুধু আমাদের মতো কয়েকজন ভ্রমণকারী ছিলেন। মন্দির প্রাঙ্গণের আশপাশে রয়েছে অসংখ্য মিষ্টান্ন ও আরতি দেওয়ার ফুলের ডালার দোকান। তবে ওইসময় প্রায় বেশির ভাগ দোকান বন্ধ হয়ে যায়। সীমান্ত সংলগ্ন হওয়ায় সেখানে সন্ধ্যার পর অবস্থান করা সিমিত করা হয় স্থানীয় সীমান্তরক্ষী বিএসএফের তরফ থেকে। আমরা দ্রুত মন্দির দর্শন শেষে পাশেই পাহাড়ের গায় শত শত বছরের পুরোনো খোদাই করা ভাস্কর্য দেখতে দেখতে ফিরতে শুরু করলাম বিশালাকৃতি কড়ই গাছের নিচে। এর পাশেই কমলা সাগর। কিন্তু সময় স্বল্পতার কারণে সে সাগর দর্শন শেষ করতে হয় একটু দূর থেকেই।
বিশাল দিঘিটার তিন দিকই কাঁটাতারে মোড়া। খোলা কেবল পূর্ব দিকটা। আর এ দিকটাতেই ভারতের ত্রিপুরা। কাঁটাতারের ওপাশ দিয়ে একটা ট্রেন ছুটে যেতে গেলো ঢাকা থেকে চট্টগ্রামের দিকে। ট্রেনের শব্দ মিলিয়ে যেতে না যেতেই মাগরিবের আজান শোনা গেলো সীমান্তের ওপাশ থেকে। স্থানটা সীমান্তের কাঁটাতারের বেড়া সংলগ্ন হওয়ায় ভারতীয় সিমের মোবাইলের নেটওয়ার্ক আসা-যাওয়া করছিলো এবং বাংলাদেশের সিমের নেট পেয়ে মেসেজ আসতে শুরু করে। এনড্রোয়েট ফোনের কারণে ভারতীয় সময়টাও আধ ঘণ্টা এগিয়ে বাংলাদেশের সময় দেখাচ্ছিলো। বিশাল দিঘিটা বা কমলা সাগরপাড় জুড়ে পামগাছের সারি। এই ভর সন্ধেতেও পানিতে দাপিয়ে গরম কাটাচ্ছে কিছু মানুষ। আর এক পাশে সীমান্ত হাটের কাঁটাতারের বেড়ার ফাঁকে মাথা গলিয়ে বাংলাদেশের কয়েকজন যুবককে ভারত দর্শন করতে দেখা গেলো। আমরাও তাই কাঁটাতারের বেড়ার কাছে গিয়ে ভারতের মাটিতে দাড়িয়ে বাংলাদেশ দর্শন করলাম এবং একটি সেলফি তুলে নিলাম।
মন্দির ও দিঘির মাঝখানে আর একটি উঁচু টিলার ওপরের ট্যুরিস্ট লজের বারান্দায় বসলে বেশ নজরে আসে কুমিল্লা শহর। দিঘির উত্তর-পূর্ব কোণায় উঁচু উঁচু কাঁটাতারে ঘেরা বর্ডার হাট। ২০১৫ সালের ১১ জুন প্রথম সীমান্ত হাট বসতে শুরু করে এখানে। শুরুর দিকে প্রতি বৃহস্পতিবার এখানে হাট বসলেও এখন বসে রোববার করে। সকাল ১০টা থেকে শুরু করে সন্ধ্যা অবধি বিকিকিনি চলে হাটে। করোনার কারণে দির্ঘদিন এ হাট বন্ধ থাকলেও সম্প্রতি তা আবার চালু হয়েছে। ২০৩৯ নম্বর সীমান্ত পিলার লাগোয়া এ বর্ডার হাট গড়া হয়েছে উভয় দেশের ১৪০ শতক জমির ওপর।
বাংলাদেশের লুঙ্গি, গামছা আর শুঁটকির বেজায় কদর এ হাটে। আরো বিক্রি হয় সবজি, ফল, পানীয়, মেলামাইন সামগ্রী। আর ভারতীয় পণ্যের মধ্যে প্রসাধন সামগ্রীই বেশি কেনে বাংলাদেশিরা। আরো কেনে বিভিন্ন ধরনের ফল।
কমলাসাগর দিঘি, প্রাচীন মন্দির আর বর্ডার হাট দেখতে দেখতে সন্ধ্যা ঘনিয়ে যাওয়ায় আমরা সবাই দ্রুত উঠে গেলাম আমাদের ভ্যান গাড়িতে (মাইক্রোবাস)। আগরতলা ফেরার জন্য বাংলাদেশ সীমান্তঘেঁষা বিশালগড়ের মূল রাস্তা দিয়ে ছুটে এলাম বন পাহাড়ের নানা পাখ-পাখালির ডাকাডাকি শুনতে শুনতে। কিছুক্ষণ পর গা ছমছম করা আধার নেমে এলো। উঁচু নিচু পাহাড়ি রাস্তার উভয় পাশে গভীর বন। জনবসতি খুব একটা চোখে পড়লো না। রাস্তার অবস্থায়ও খুব ভালো নয়। খাদা-খন্দরের কারণে গাড়িতে বসে থেকে ক্লান্ত শরীররে ঝিমুনিটা ভেঙে যাচ্ছিল বার বার। মধুপুর বাজারে আসার পরও তাই অনেক দূর মনে হলো গন্তব্যটাকে। শেষ পর্যন্ত ন্যাশনাল হাইওয়েতে উঠে আসলাম এবং কিছুক্ষণের মধ্যে আগরতলা শহরে পৌঁছে গেলাম। স্মৃতির পাতায় রয়ে গেলো কসবা কালী মন্দির, কমলা সাগর, সীমান্তের কাঁটাতার, বন-পাহাড়ের প্রকৃতির গন্ধ।
লেখক: কবি ও সাংবাদিক, শেরপুর
সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী আবু জাফর
যোগাযোগ: । [email protected] । বিজ্ঞাপন ও বার্তা সম্পাদক: 01894944220
ঠিকানা: বার্তা ও বাণিজ্যিক যোগাযোগ : বাড়ি নম্বর-২৩৪, খাইরুন্নেসা ম্যানশন, কাঁটাবন, নিউ এলিফ্যান্ট রোড, ঢাকা-১২০৫।
© 2025 Sangbad Sarabela All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh