দেশের উত্তরাঞ্চলের বৃহত্তম জলাভূমি চলনবিল। প্রায় হাজার মাইলের বিস্তীর্ণ জলাভূমিতে এক সময়ে বছরের সব সময়ই থাকত পানির প্রবাহ। পানি প্রবাহের কারণে বিস্তীর্ণ এ বিলকে বলা হতো চলন্ত বিল, পরবর্তীতে যা চলন বিল নামে পরিচিতি পেয়েছে। বর্তমানে পাবনা, নাটোর, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, নওগাঁ জেলার বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়েই চলনবিল। এখন শুধু বর্ষা মৌসুম ছাড়া বিস্তীর্ণ এ বিলে পানির প্রবাহ দেখা যায় না। বিলের বিস্তীর্ণ এলাকায় বছরের বেশিরভাগ সময় জুড়েই চলে ফসলের আবাদ। তারপরও বর্ষায় বিশাল বিলের বুকজুড়ে জলরাশি।
সেই জলের ঢেউ দোলা দিয়ে যায় হৃদয়ে। সেই জলরাশিতে অসীম আকাশের স্নিগ্ধ প্রতিচ্ছবি। জীব বৈচিত্র্য আর অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি এই চলনবিল। আর সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের সময় বিস্তীর্ণ এই জলরাশি অপার্থিব সৌন্দর্যের আঁধার। নৌকায় বসে ঝিরিঝিরি হাওয়ায় উদাসী হয় মন। ইচ্ছে করে বিলের পানিতে নেমে পা ভেজাতে। বিলের সূর্যোদয়ের সময় মনে হয় আকাশের বুক থেকে যেন আগুনের রশ্মি বের হয়ে জলধারায় মিলেমিশে একাকার।
সম্প্রতি বর্ষাকাল পেরিয়ে শরতের চলনবিলে সরেজমিনে দেখা যায়, দু’চোখের দৃষ্টিসীমা জুড়ে শুধুই জলরাশি,চারিদিকে পানি আর পানি। বিশাল জলরাশির মধ্য দ্বীপের মতো ভাসমান ছোট ছোট গ্রাম। বাতাসে কান পাতলেই ভেসে আসে জলের ছলাৎ ছলাৎ শব্দ। ওপরে নীল আকাশ আর ছানা কাটা মেঘ নিজেকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। কখনো সূর্য মেঘের আড়ালে মুখ ঢাকলেও জলে তার প্রতিচ্ছবি মুগ্ধতার সৃষ্টি করে। জলের ঢেউয়ের তালে হৃদয়ে দোলা দিয়ে যায় এক অন্যরকম ভালো লাগা। হঠাৎ দূর থেকে বিশাল বিলের মাঝে লাল সাদা রঙের ব্রিজ মনে হবে একটি দ্বীপ। যেখানে ইচ্ছে করে পানিতে নেমে গা ভেজাতে। অনেকেই আবার গা ভিজিয়েও আনন্দ উপভোগ করেন।
প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমের চলনবিলের সৌন্দর্য উপভোগ করতে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছুটে আসেন দর্শনার্থীরা। পর্যটকদের জন্য এমনই অপরূপ সৌন্দর্য মেলে ধরে আছে চলনবিল। তবে ঘুরতে আসা দর্শনার্থীদের বিভিন্ন সময়ে সমস্যায়ও পড়তে হয়। তাই চলনবিলে পরিকল্পিত পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলার দাবি জানিয়েছেন চলনবিল ভ্রমণ পিপাসুরা। তবে পর্যটন কেন্দ্র করতে গিয়ে চলনবিলের ক্ষতি যেন না হয়, সেদিকে নজর রাখার পরামর্শ দিয়েছেন পরিবেশবিদরা।
বেড়ানো শেষে ফেরার পথে চলনবিলের বুকে সূর্যাস্তের দৃশ্য ছড়িয়ে দেয় মুগ্ধতার আবেশ। বিলের পানিতে সূর্যাস্তের দৃশ্য নিয়ে যায় ভালো লাগার অন্য জগতে যা প্রবাহমান জলের সেই ছায়া পড়ে ফুটে ওঠে অনিন্দ্য সুন্দর দৃশ্যপট। চলনবিলে সূর্যাস্তের সময় যেন আকাশের মেঘগুলোও লাল হয়ে যায়।তখন আকাশের দিকে তাকালে মনে হয়, মেঘের গায়ে অগ্নিশিখা। চলন বিলের থইথই পানিতে সেই সূর্যের আলো পড়ে আগুনে লাভার মতো দেখায়। এদৃশ্য প্রাকৃতিক সৌন্দর্য পিপাসুদের মনে দোলা দিয়ে যায়। চলনবিল এমনিতেই রূপে অপরূপ। এ বিলের সৌন্দর্য অসাধারণ মনমুগ্ধকর যা বিভিন্ন জায়গা থেকে অবলোকন করা যায়। সূর্যাস্তের আলো শরীরে মেখে বিমোহিত হওয়ার এক অনিন্দ্য দৃশ্যপট।
চলনবিলে বেড়াতে আসা দর্শনার্থীরা বলেন, 'দেশের সবচেয়ে বড় বিল চলনবিলে প্রতিবছরই এ সময়টাতে ভিড় বাড়ে। এ সময়টাতে নৌকায় বেড়ানো অন্যরকম মজা। চলনবিলে বেড়াতে খুবই ভালো লাগে। তবে ভালো থাকার জায়গা, খাওয়ার হোটেল, পাবলিক টয়লেটসহ বেশ কিছু সমস্যা ও সংকট রয়েছে। এগুলো নিরসনে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা ভূমিকা রাখতে পারেন। পাশাপাশি চলনবিলে পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলা গেলে আরও ভালো হয়।'
এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে চলনবিল অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের ফোকাল পয়েন্ট এলজিইডির প্রকল্প পরিচালক মমিন মজিবুল হক সমাজী বলেন, 'সরকারের সকল আইন ও বিধিবিধান মেনে এলজিইডি পরিকল্পিত, সমন্বিত ও টেকসই চলনবিল উন্নয়নের জন্য কাজ করছে। চলনবিলে যদি পর্যটন শিল্পের বিকাশ ঘটাতে হয় তাহলে ইকো টুরিজমের মতো প্যাকেজ গ্রহণ করতে হবে।'
চলনবিল রক্ষা আন্দোলনের সদস্যসচিব এস এম মিজানুর রহমান বলেন, 'চলনবিলে পর্যটন কেন্দ্র হতেই পারে। এর আগে বিশেষভাবে বিবেচনা করতে হবে যেন চলনবিল ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। এ বিষয়ে যারা বিশেষজ্ঞ ও এলাকার মানুষ আছে, তাঁদের মতামত নিয়ে কাজ করতে হবে। কারণ এরই মধ্যে বিশাল আয়তনের চলনবিল এখন মাত্র ৩৭৫ বর্গকিলোমিটারে দাঁড়িয়েছে।'