ছবি:সংগৃহীত।
পানির বুকেই গড়ে উঠেছে পুরো একটি গ্রাম। ঘরবাড়ি, দোকানপাট, স্কুল, উপাসনালয়- সবই আছে সেই গ্রামে। কিন্তু পানির ওপর। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ কম্বোডিয়ায় অবস্থিত এই গ্রাম। টোনলে স্যাপ হ্রদ ঘিরে গড়ে উঠেছে ‘অবিশ্বাস্য’ এই গ্রাম। এই হ্রদ কম্বোডিয়ার মেকং নদীর অন্তর্গত। চাইলেই ঘুরে আসতে পারেন এই গ্রামে।তার জন্য লাগবে-পাসপোর্ট,ভিসা আর বিমান টিকেট। এখানে গেলে দেখতে পাবেন পানি আর জীবন একে অন্যের সাথে সম্পৃক্ত।
ঘরবাড়ি সবই ভাসমান
টোনলে স্যাপের গ্রামগুলোয় শত শত পরিবার বসবাস করে ভাসমান কাঠামোর ওপর তৈরি বাড়িতে। এসব বাড়ি তৈরি করা হয় বাঁশ, কাঠ, ড্রাম ইত্যাদি দিয়ে তৈরি ভাসমান পাটাতনের ওপর। বর্ষাকাল অর্থাৎ জুন থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত গ্রামগুলো সবচেয়ে প্রাণবন্ত থাকে। এ সময় হ্রদের পানির স্তর থাকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে। শুকনা মৌসুমে অর্থাৎ নভেম্বর থেকে মে মাসে হ্রদের পানি কোথাও কোথাও কমে যায়। তখন সে এলাকায় থাকা গ্রামগুলো পরিণত হয় আর দশটা ভূমির ওপর থাকা গ্রামে।
টোনলে স্যাপ হ্রদে ২০টির বেশি ছোট-বড় ভাসমান বা স্টিল্ট গ্রাম রয়েছে। সেগুলোর মধ্যে প্রধান গ্রাম ছয়টি। গ্রামগুলো হলো চং খনিয়াস, কম্পং ফ্লুক, কম্পং খ্লাং, মেচ্রেয়, প্রিক টোয়েল ও কম্পং লুয়াং। আবার এই ছয় গ্রামের মধ্যে চং খনিয়াস, কম্পং ফ্লুক, কম্পং খ্লাং বেশি জনপ্রিয় ও পর্যটকবহুল গ্রাম।
এসব গ্রামের একেকটি পরিবার ছোট ছোট ভাসমান কাঠামোর ওপর তৈরি বাড়িতে বসবাস করে। পানির ওপর যেন সহজে ভেসে থাকতে এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগে টিকে থাকতে পারে, এসব গ্রামের বাড়ির কাঠামোগুলো সেভাবে তৈরি করা হয়। বাড়ির সঙ্গে স্কুল, উপাসনালয়, বাজার, এমনকি পশুপালনের জন্য ছোট ছোট খাঁচাও ভেসে থাকে হ্রদের পানিতে। গ্রামের একমাত্র যোগাযোগের মাধ্যম নৌকা। তাই শিশু থেকে বৃদ্ধ- সবাই নৌকা চালনায় পারদর্শী।
মাছ ধরা প্রধান পেশা
এই হ্রদ মাছের জন্য বিখ্যাত। এখানে তিন শর বেশি প্রজাতির মাছ পাওয়া যায়। তাই স্বাভাবিকভাবে গ্রামবাসীর জীবিকার প্রধান উৎস এই মাছ। প্রতিদিন ভোরে এসব গ্রামের অধিবাসীরা অসংখ্য ছোট নৌকায় চড়ে হ্রদের বুকজুড়ে জাল ফেলে মাছ ধরেন। মাছ বিক্রি করে চালাতে হয় পুরো পরিবার। বর্ষাকালে হ্রদের আয়তন ১০ গুণ পর্যন্ত বেড়ে যায়। সেই সময় পুরো গ্রামই যেন পানি দিয়ে ঘেরা এক স্বপ্নপুরীতে রূপ নেয়। আবার শুষ্ক মৌসুমে পানি কমে গেলে ঘরবাড়ি সরিয়ে নিতে হয় অন্য কোথাও। পরিবেশের প্রতিটি পরিবর্তনের সঙ্গে এখানকার মানুষদের জীবনযাপনও বদলে যায়।
মাছ ধরা ছাড়াও এ গ্রামগুলোর অধিবাসীদের অন্যতম আয়ের উৎস ভাসমান কৃষি। প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ধরে এখানকার মানুষেরা এ ধরনের কৃষির সঙ্গে পরিচিত। তারা ভাসমান বাগানে চাষ করে সবজিসহ বিভিন্ন ধরনের ফসল। মাছ ধরা ও ভাসমান কৃষির বাইরে এই গ্রামগুলোর অন্যতম আয়ের উৎস পর্যটন। এখানকার দুটি গ্রাম পাখি দেখার জন্য বিখ্যাত। মেচ্রেয় নামে গ্রামটিতে রয়েছে বার্ড স্যাংচুয়ারি। আর প্রিক টোয়েল জলচর পাখিদের অভয়ারণ্য। এ ছাড়া টোনলে স্যাপ হ্রদটিই একটি দর্শনীয় জায়গা। ১৯৯৭ সালে এ হ্রদকে ইউনেসকো জীবমণ্ডল সংরক্ষণাগার হিসেবে মনোনীত করেছে।
শিক্ষা ও স্বাস্থ্যব্যবস্থা
টোনলে স্যাপ হ্রদের ভাসমান গ্রামগুলোয় শিক্ষা ও স্বাস্থ্যব্যবস্থা খুবই সীমিত। সেখানে আছে শিশুদের জন্য ভাসমান স্কুল। ছোট ছোট নৌকায় চড়ে শিশুরা স্কুলে যায়। তবে পড়াশোনা করার সুযোগ এখানকার সব শিশুর নেই। অনেকেই পরিবারকে সাহায্য করার জন্য অল্প বয়সে মাছ ধরার কাজে যুক্ত হয়ে যায়।
লেখাপড়ার মতোই এখানে স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে সংকট রয়েছে প্রকট। প্রাথমিক চিকিৎসা থেকে শুরু করে জরুরি সেবার জন্য যেতে হয় দূরবর্তী স্থলভাগের শহরগুলোয়। এমন অবস্থায় অনেক সময় সামান্য অসুস্থতাও ভয়ংকর হয়ে ওঠে এসব গ্রামে।
পর্যটন
টোনলে স্যাপ হ্রদের এই ভাসমান গ্রামগুলো এখন পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে। স্থানীয় ও বিদেশি বহু পর্যটক নৌকায় করে ঘুরে দেখেন ভাসমান ঘরবাড়ি, স্কুল, বাজার আর এখানকার জীবনধারা। তবে পর্যটনের চাপও কিছু নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। যান্ত্রিক নৌকা, পানিদূষণ ও অতিরিক্ত কোলাহলে গ্রামের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যে বিরূপ প্রভাব পড়ছে। অনেক পর্যটন প্রতিষ্ঠান এই অঞ্চলে ভ্রমণ ব্যবসা পরিচালনা করে। তাদের প্যাকেজে থাকে নৌকায় করে গ্রাম ঘুরিয়ে দেখানো এবং স্থানীয়দের বাড়িতে গিয়ে থেকে তাদের জীবনধারার অভিজ্ঞতাও দেওয়া।
পানির ওপর গড়ে ওঠা এসব ভাসমান গ্রাম যেন এক জীবন্ত সংগ্রামের ছবি। হ্রদের ঢেউয়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলে জীবনের ওঠানামা। নেই আধুনিক সুযোগ-সুবিধা। তবু এখানকার মানুষ বাঁচে নিজেদের মতো করে, প্রকৃতিকে ভালোবেসে।
জীবন সব সময় স্থির নয়। কিন্তু পরিবর্তনের মাঝেও বেঁচে থাকার জন্য মানুষ নতুন পথ খুঁজে নেয়। এ যেন পানি আর জীবনের এক চিরন্তন গল্প।
সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী আবু জাফর
যোগাযোগ: । [email protected] । বিজ্ঞাপন ও বার্তা সম্পাদক: 01894944220
ঠিকানা: বার্তা ও বাণিজ্যিক যোগাযোগ : বাড়ি নম্বর-২৩৪, খাইরুন্নেসা ম্যানশন, কাঁটাবন, নিউ এলিফ্যান্ট রোড, ঢাকা-১২০৫।
© 2025 Sangbad Sarabela All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh